ঢেউ তো এসে গেলো, এবার বাঁধ দেবেন না? ঠিকই ধরেছেন করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ এর কথাই বলছি। এসেই যখন গেলো এখন তো আর আলোচনার ঝড় তুলে কেন ঢেউ এলো, এটা করলে আসতো না, ওটা করলে আসতো না বলা -কোন ফায়দা হাসিল এর কায়দা নয়। কি করতে পারতাম তা নয় বরং ভাবি ঢেউয়ের উর্ধ্বমুখী চূড়া ঠেকাতে এখন কি করতে হবে আমাদের?
২.
করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় এ ঢেউটি করোনা ভাইরাসের কোন্ ধরন এর কারণে হচ্ছে তার সম্পর্কে একটা ধারণা নেয়া প্রয়োজন প্রথমেই। তাহলে সম্ভাব্য ধাক্কার প্রভাব কেমন হতে পারে তা অনুমান করা যাবে। মিউটেশন এর মাধ্যমে চেহারা ও স্বভাব বদলানো করোনা ভাইরাস এর সুনির্দিষ্ট ধরন জানতে জেনেটিক সিকোয়েন্সিং এর সাহায্য নিতে হয়। তা হাতের নাগালে না আসা পর্যন্ত আমরা বর্তমান সংক্রমণের পেছনে অনুমান করে ইউ কে ভেরিয়্যান্ট, সাউথ আফ্রিকানভেরিয়্যান্ট, ব্রাজিলিয়ান ভেরিয়্যান্ট কিংবা পুরাতন ভেরিয়্যান্টকেও দায়ী করতে পারি। বাংলাদেশে করোনার নতুন ভেরিয়্যান্ট সৃষ্টি হয়েছে এমন সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে রোগের প্রকৃতি বলছে বর্তমান দ্বিতীয় ঢেউ এর পেছনে ইউ কে ‘ র কেন্ট ভেরিয়্যান্টটিই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই যদি হয়ে থাকে তবে আশার কথা হচ্ছে আমরা মডার্নার যে টিকা নিচ্ছি তা এর বিরুদ্ধেও কার্যকর। কিন্তু এই ভেরিয়্যান্ট আগের ভেরিয়্যান্ট এর চেয়ে ৭০% বেশি সংক্রমণে সক্ষম এবং এর সংক্রমণ আর বয়স, নারীপুরুষ কোন কিছুতেই তারতম্য ঘটবে না। সকলে, সববয়সীরাই আক্রান্ত হবার সমান সম্ভাবনায় রয়েছে। আর মৃত্যুর হার আগের মতোই থাকবে। এই হঠাৎ উর্ধ্বমুখী চূড়ার ফলে চিত্র যা দাঁড়াবে বা দাঁড়িয়ে গেছে তা হল হাসপাতালগুলোর উপর উপচে পড়া করোনা রোগী -ফলশ্রুতিতে রোগীর বেড স্বল্পতা, প্রয়োজনীয় অঙিজেন স্বল্পতা তথা চিকিৎসা সংকট। সংকট উত্তরণে এই মুহূর্তের পদক্ষেপ হতে হবে সংক্রমণের বিস্তার ঠেকানো। যার একমাত্র পথ লকডাউন।
৩.
লকডাউন একটি সংক্রমণের বিস্তার রোধের জরুরি ব্যবস্থা যেখানে লোকজন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তার এলাকার বাইরে যেতে পারবে না। দুইধরনের লকডাউন হতে পারে আংশিক অথবা পূর্ণ। পূর্ণ লকডাউনে বাড়ির বাইরে বের হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করা হয়।বর্তমানে সরকার আংশিক লকডাউন- ই জারী করেছে।
১৫০০ বৎসর পূর্বে একটি এলাকায় মহামারী সংক্রমণের খবর পেয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছিলেন তোমরা ঐ এলাকায় যাবে না, ঐ এলাকার লোক তার এলাকা ছেড়ে বের হবে না। এটিই সম্ভবত লকডাউন এর প্রথম ধারণা।
চীনের উহান প্রদেশের করোনা সংক্রমণ যখন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেল তখন লকডাউন জারী করায় দু’মাস এর মাথায় মৃত্যু ও সংক্রমণ অর্ধেক এ নেমে এসেছিল তার মানে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে এটি কার্যকরী।
৪.
একথা অনস্বীকার্য লকডাউন অবস্থায় কিছু পেশা, বা কর্মকাণ্ড সাময়িক বিঘ্নিত হবে, জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জীবন বাঁচলে তবেই তো জীবিকা নির্বাহের প্রশ্ন। সরকার প্রধানসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ ব্যাপারটি আমলে নিয়েই হয়তো পূর্ণ লকডাউন এ না গিয়ে আংশিক লকডাউনকে বেছে নিয়েছেন। আর যদি আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিকল্প কোন উপায় বের করতে পারি, তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি তবে সেটাও কোন সমস্যা নয়।কিন্তু লকডাউন সফল করতে ব্যর্থ হলে সংক্রমণ এর চূড়া বাড়বে সরকারকে আরও কঠোর লকডাউন এ যেতে হবে। উপরন্তু আমাদের মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হবে একসপ্তাহের আংশিক এ লকডাউনের ফলাফল দৃশ্যমান হবে না, বর্ধিত করা প্রয়োজন পরবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু আমরা আরও কঠিন আর পূর্ণ লকডাউন এ নিশ্চয়ই যেতে চাই না।
৫.
লকডাউন সময়ে আগের মতোই স্বাস্থ্য বিধিকে ( মাস্ক, হাতধোয়া, সামাজিক দূরত্ব) সঙ্গী করে রাখতে হবে। আর অবশ্যই করোনা ভ্যাকসিন নিতে হবে। অযথা ভ্যাকসিন এর ত্রুটি খুঁজতে যাবেন না,ঝুঁকি আর সুবিধা তুলনা করে সুবিধার দিকটাই সবচেয়ে বেশী বলে ভ্যাকসিন প্রয়োগের জন্য অনুমোদিত হয়েছে।ভ্যাকসিন এ রোগের তীব্রতা কমায় ।তীব্র আর জটিল করোনা না হলে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়ে না, মৃত্যুঝুঁকিও কিছুটা কমে।
৬.
সরকার বিধি নিষেধ আরোপ করতে পারবে, চিকিৎসক আক্রান্ত হলে তার হাতে থাকা সমস্ত কিছু দিয়ে চিকিৎসা
দিতে চেষ্টা করতে পারবে কিন্তু প্যানডেমিক ঠেকানো আপনার সচেতনতা আর আন্তরিকতা ছাড়া সম্ভব নয়। সচেতনতা আর সমন্বিত প্রচেষ্টা হতে পারে- ঢেউ ঠেকানো বাঁধ।
লেখক : সিনিয়র মেডিকেল অফিসার, চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতাল