করোনা শনাক্তের এক বছর পূর্ণ হলো গত ৮ মার্চ। পুরো বছরটি কেটেছে দুঃসহ যাতনায়। মৃত্যুর সারি ডিঙিয়ে মানুষকে অতিবাহিত করতে হয়েছে দিন। আজাদীতে গতকাল প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমন মৃত্যুর মিছিল পৃথিবীর মানুষ দেখেনি। দুর্যোগের সময় মনুষ্যত্বের পরীক্ষা হয়। পরস্পরকে সহায়তা করার, মানবতা প্রদর্শনের অফুরন্ত দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। আর এসব দৃষ্টান্ত শোনায় মানবতার বাণী। করোনা বদলে দিয়েছে আমাদের আগের বহু অভ্যাস। বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে যাপিত জীবনে। গত বছর ৮ মার্চ থেকে চারদিকে যেন ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছিল। করোনা প্রতিরোধের কড়াকড়িতে কর্মহীন ছিলেন চট্টগ্রামের নিম্নআয়ের অনেক মানুষ। সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটবে, তাই নিয়ে যত দুশ্চিন্তা। এমন সংকটে ছোট ছোট উদ্যোগ নিয়ে, সহায়তার হাত বাড়িয়ে, বন্দরনগরীর পথে নেমেছেন মানবিক কিছু মানুষ, কিছু সংগঠন। তাদের কেউ দিয়েছেন চাল-ডাল, কেউ সাধারণ মানুষের জন্য বানিয়েছেন জীবাণুনাশক। করোনা শুরুর পর থেকে সংক্রমণের লাগাম টানতে শুরু হয় লকডাউন। চট্টগ্রামে গত বছর ৪ এপ্রিল প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর থেকে বিভিন্ন এলাকা লকডাউন করা হয়। সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করে লকডাউন দেওয়ায় খাদ্যাভাবে ভুগতে হয় গৃহবন্দিদের।
তবে বাংলাদেশ করোনা মোকাবেলায় ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে। করোনা মোকাবেলা এবং অন্য অনেকে দেশের নাগরিকের আগে বাংলাদেশে নাগরিকের ভ্যাকসিন প্রাপ্তি রীতিমত বিস্ময়কর। কোভিড-১৯ অতিমারি কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্যগত ও আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ গৃহীত ব্যাপকভিত্তিক পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করলেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজ। দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের অভূতপূর্ব সাফল্যের অতীত রেকর্ডের উদাহরণ টেনে মহাসচিব গুতেরেজ বলেন, কোনো ঝুঁকি নিরসণের বৈশ্বিক নেতৃত্বে বাংলাদেশ সর্বদাই শীর্ষস্থানীয়, তাই কোভিড অতিমারি মোকাবিলায় বাংলাদেশের এ ধরনের সাফল্য দেখে আমি মোটেও অবাক হইনি। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তার সুদৃঢ় প্রতিশ্রুতির উচ্চকিত প্রশংসা করেন।
উল্লেখ্য, করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ, আর বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২০তম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের প্রকাশিত মাসিক ‘কোভিড রেজিলিয়েন্স র্যাংকিংয়ে’ এই তথ্য এসেছে। র্যাংকিংয়ে আগের চাইতে ৪ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। তালিকায় দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, সৌদি আরবের মতো দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। র্যাংকিংয়ের জন্য ১০টি প্রধান বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এর মধ্যে রয়েছে, কোভিড-১৯ কেসের সংখ্যা বৃদ্ধি, সামগ্রিক মৃত্যুহার, পরীক্ষা ক্ষমতা, স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা, অর্থনীতির ওপর ভাইরাস সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞার প্রভাব এবং চলাচলের স্বাধীনতা ইত্যাদি। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সক্ষমতার শীর্ষে রয়েছে নিউজিল্যান্ড। ( স্কোর ৮২-৪০), তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, সিঙ্গাপুর, ফিনল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া শীর্ষ দশে রয়েছে। বাংলাদেশের স্কোর ৫৯-২, পাকিস্তানের ৫৪-ভারতের স্কোর ৫০, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান যথাক্রমে ৩০ ও ৩৭তম।
সারা বিশ্বে মানুষ যেখানে টিকার জন্য ব্যাকুল, বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো যখন হন্যে হয়ে সর্বত্র টিকা খুঁজে বেড়াচ্ছিল, তখন বাংলাদেশ সরকার শুধু প্রথম দিনের জন্যই তার টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে সাড়ে পাঁচ লাখ ডোজ টিকা পাঠিয়ে রেখেছিল। অস্বীকার করার উপায় নেই যে টিকা প্রশ্নে এটি সরকারের বড় সাফল্য। যাঁরা এ সাফল্যকে স্বীকার করতে চান না, তাঁরা সাধারণ মানুষকে টিকা না নেওয়ার জন্য বিভ্রান্তি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বিশ্বের পরিস্থিতি এবং গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে সাধারণ মানুষের স্বতঃপ্রবৃত্ত অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে এসব অপপ্রচার মানুষ আর বিশ্বাস করছে না।
আমরা প্রত্যাশা করবো করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচির ব্যবস্থাপনাগত ব্যাপারে যেন কোনো সমস্যা না থাকে। কেননা এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কর্মকাণ্ড এবং এর সঙ্গে বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলার সম্পর্ক রয়েছে। যদি কোথাও করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচিতে সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে সে সমস্যা দ্রুত বিবেচনায় নিয়ে দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। টিকা নিয়ে জনগণের মধ্যে এখন আর বিভ্রান্তি ও ভয়ভীতি নেই। প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে এ কর্মসূচি নিয়ে জনগণের মধ্যে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে। তবে করোনা এখনো যায়নি। তাই সচেতনতা অবলম্বন করেই পথ চলতে হবে আমাদের।