নারীর অধিকার ও নিগ্রহের প্রতিবাদ নিয়ে নারী এবং সচেতন পুরুষ সবাই সোচ্চার। কিন্তু আদতে হচ্ছে কী। এখনো সর্বস্তরে নারী বঞ্চিত হচ্ছে নিগৃহীত হচ্ছে– এই কথা অস্বীকার করার জো নেই। এই উন্নয়নের যুগে নারী যখন সর্বত্র সমানভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে, সেই সময় কিছু হীনম্মন্য, লোভী, অসৎ পুরুষ কর্তৃক নারীর নিগ্রহের ঘটনা ঘটে চলেছে অহরহ। যা কোনো সুস্থ মানুষ, সমাজ, দেশ মেনে নিতে পারে না। নারীর প্রতিভা একটি ঘরের জন্য, একটি সমাজের জন্য এবং একটি দেশের জন্য ততোটাই গুরুত্বপূর্ণ যতটা একজন পুরুষের মেধা দিতে পারছে। বরং নারী আরও অধিক আন্তরিক সংসারী কর্মনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী।
আমরা যদি প্রতিটি জীবনের শুরুটা দেখি, ছেলে হোক মেয়ে হোক প্রতিটি মানুষের জীবন শুরু হয় পিতৃগৃহ থেকে। এই পিতৃগৃহ ততদিন মেয়েটির থাকে যতদিন সে শিশু থাকে। বাঙালি জাতির বৈশিষ্ট্য বলে, শৈশব পার হতে না হতেই অর্থাৎ কৈশোরে অবতীর্ণ হলে পিতামাতার চিন্তা শুরু হয়ে যায় কী করে একটা ভালো ঘরগার্হস্থ্যে মেয়েটিকে তুলে দিয়ে দায় মুক্ত হওয়া যাবে। এখানে দেখা যায়, পিতামাতাই অপ্রাপ্ত বয়সে সন্তানকে তুলে দিচ্ছেন ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে।
যদিও ১৯২৯ সালের বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন অনুসারে বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়ের বয়স ১৮ ও ছেলের বয়স ২১ হতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গ্রামাঞ্চলের বিয়েগুলোতে এই আইন মানা হয় না। আবার এ–ও দেখা যায়, ছেলেমেয়েদের জন্ম নিবন্ধনের কোনো দলিল নেই। বিবাহ আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে কাজী সাহেব বয়স পরীক্ষার জন্য জন্ম নিবন্ধন সনদ বা এসএসসি সার্টিফিকেট বা ডাক্তারি সার্টিফিকেট দেখে সন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু আদতে তা হয় না। শহরের শিক্ষিত মানুষের ক্ষেত্রেও এই একই চিন্তা বিরাজমান বিশেষ করে কিছু কিছু এলাকায় যারা এখনো কুসংস্কারে জড়িয়ে আছে। ভালো ছেলে পেলে স্কুল না পেরুতেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দায় সারতে চান। ছেলে এবং মেয়ের বয়সের পার্থক্য কতো, সেটাও ভাবেন না পরিবার।
আজকাল মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ তাদের ছেলে সন্তানের মতো মেয়ে সন্তানকে সমান ভাবে শিক্ষা দেয়ার কথা ভাবছে। কেউ কেউ অর্থ সংকট থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে নিজের কায়িক শ্রমের মাধ্যমে। দেখা যায় রিক্সা চালক কিংবা কোনো ড্রাইভার বা বস্তিবাসী কুলিমজুরের মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে আসলো। হয়তো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হলো। সম্পূর্ণ বৈমাত্রিক পরিবেশে থেকেও কেবল মেধাবী হওয়ায় এই সাফল্য অর্জন করছে তারা।
যদিও গ্রামীণ পরিবেশ ও শহুরে পরিবেশের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিরাজমান। যেমন অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী নয় এমন গ্রামীণ পরিবারের ছেলে এবং মেয়েদের পড়াশোনার জন্য ছেলের পড়াশোনাকেই প্রাধান্য দেয়া হয় বেশি। মেয়েদের বিনামূল্যে কিংবা শিক্ষা ভাতার বিনিময়ে যেটুকু পড়ানো যায় সেটুকুই। অনেক সময় তাও হয় না মেধা এবং আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও। তাই প্রাথমিক শিক্ষা পর্যন্ত, বেশি হলে এসএসসি এর বেশি এগুতে পারে না মেয়েরা। শুধু তাই নয় বিয়ের বয়স অর্থাৎ আঠারো বৎসর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে উঠতে হয় অনেক মেয়েকে। সেখানেও নারীর সম্মতির তোয়াক্কা করা হয় না। যে বয়সে মেয়েটি পুতুলের জন্য খেলাঘর বানাবে পুতুলের বিয়ে বিয়ে খেলবে সে বয়সে তাকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। উঠে যেতে হয় নতুন একটা পরিবারে নিজের নতুন ঘরবর সাজাতে। তারপর দেখা যায় বছর না ঘুরতেই সন্তানের জননী হয়েছে মেয়েটি।
আর যাদের পিতামাতা স্বাবলম্বী ছেলে মেয়ে সবার পড়াশোনার খরচ চালাতে পারে, তাদের জীবনে পরিবর্তন আসে তবে যতসামান্য। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে এমন গ্রামীণ মেয়েদের সংখ্যা হাতে গোনা। আর পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে গেছে এমন মেয়ের সংখ্যা গুটিকয়েক বলা যায়। কিন্তু গ্রামে বলি শহরে বলি, পড়াশোনার ক্ষেত্রে ছেলেদের অগ্রাধিকার দেয়া হয় এটা শতভাগ সত্য। মেয়েদের পদে পদে আছে নানান সমস্যা। মেয়েটি যদি সুন্দরী হয় বখাটে ছেলেরা তার পিছু লাগে। এক পর্যায়ে মা–বাবা বাধ্য হয় মেয়ের পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়ে বিয়ের কথা চিন্তা করতে। সমাজের উঁচু স্তরের কথা আলাদা। তাঁরা সবধরনের সুযোগ সুবিধা দিতে পারে। তাই এই ধরনের উটকো ঝামেলা পোহাতে হয় না। যত সমস্যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মেয়েদের। বেড়ে উঠতে উঠতে তাদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এরমধ্যে দু‘একজন বেড়িয়ে আসে, অধিকাংশই ঝরে যায়। এই ঝরে যাওয়ার পিছনে প্রথমত আমাদের সমাজ ব্যবস্থাই দায়ী। দায়ী ঢিলেঢালা আইন, দায়ী পরিবারের সৎসাহসের অভাব এবং হীনমন্যতা।
পড়াশোনা শেষ করে একটি মেয়ে যখন চাকরির জন্য যায়, সেখানেও বিভিন্ন বাধা এসে দাঁড়ায়। একটি ছেলে যেকোনো চাকরি করতে পারবে, কিন্তু একটি মেয়ের পরিবার সব ধরনের চাকরি করতে অনুমতি দেন না। আবার চাকরি দাতারাও সব চাকরিতে মেয়েদের নেবেন না। তাই অনেক মেধাবী পরিশ্রমী মেয়েও ঘুরে ফিরে স্কুল কলেজে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে। এর ওপর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতে দরকার হয় বাপদাদার পরিচয়, স্মার্ট সুন্দরী, হয়তো আরও অনেক কিছু। কিন্তু যে মেয়েটির বাবা রিকশা চালক, যে মেয়েটির মা ঘরে ঘরে বুয়ার কাজ করে মেয়েটিকে শিক্ষিত করলো নতুন কোনো জীবনের আশায়, তাদের কী হবে তাদের শিক্ষার কি কোনো মূল্য থাকবে না। তাদেরও ঘুরে ফিরে গার্মেন্টসে ঢুকতে হয়। সেখানে গরীব হওয়ার কারণে সুশিক্ষিত মেয়ে হিসেবে যেটুকু সম্মান পাওয়ার কথা তা কিন্তু পায় না।
বিবাহিত নারীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। মানুষ হিসেবে যেটুকু সম্মান ভালোবাসা পাওয়ার কথা একজন নারী তা কখনোই পুরোপুরি পায় না। প্রথমত একজন নারী সে শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত অশিক্ষিত কর্মজীবী যাই হোক না কেন, পরিবারের সকলের সেবা করার দায়িত্ব কেবল তারই ওপর বর্তায়। শ্বশুর শাশুড়ির সেবা, দেবর ননদের সেবা, ভাসুর ননাসের সেবা, সব করার পাশাপাশি স্বামীর রাত্রিকালীন চাহিদা মেটানো সন্তানের জন্য রাত্রি জাগরণ, সকলের তিন বেলা খাবার রন্ধন এবং পরিবেশনা নিশ্চিত করা। অসুখ হলে সেবা দেয়া, সন্তানের পড়াশোনা করানো, স্কুলে পাঠানো– সবই ঐ একটি নারীর ঘাড়ে এসে পড়ে। কেউ দেখে না মেয়েটির বয়স কতো, ওজন কতো সে কি পারবে সব কিছু করে নিতে। সবাই ধরেই নেয় এই মেয়েটি সব পারবে। মেয়েরা পেরেও যায় কারণ তাকে পারতে হয়। আর এই পারতে গিয়ে চল্লিশ না পেরুতেই রোগে–শোকে বুড়িয়ে যায় মেয়েটি। এই সময় যদি মৃত্যু আসে বেঁচে গেলো সে। কিন্তু সবার ভাগ্য তো এমন সুপ্রসন্ন হয় না। কর্মজীবী নারীরা কর্মস্থলে ততটা নিরাপদ নয়। সেখানেও তারা যৌন হয়রানির শিকার হয়। শুধু কর্মস্থলের কথা বলি কেন, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, পথে ঘাটে সর্বত্র মেয়েরা ইভটিজিং এর শিকার হচ্ছে। সবচেয়ে করুণ কাহিনি হলো যে মানুষটির কাছে নারী সবচেয়ে নিরাপদ থাকার কথা অর্থাৎ স্বামীর কাছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেখানেই নারী সবচেয়ে বিপন্ন। পুরুষের নারীর ওপর ডমিনেট করার প্রবণতা থাকে সবসময়। নারীকে চাকরি করতে হলে অবশ্যই স্বামীর মতামত থাকতে হবে। কেমন চাকরি করবে সেটাও নির্ভর করে পুরুষের পছন্দের ওপর। এমন কি ঘর থেকে বাইরে যেতে হলেও স্বামীর অনুমতি নিতে হবে।
তার ওপর আছে সন্দেহ বাতিকগ্রস্ততা। এই রোগে প্রায় প্রতিটি পুরুষ আক্রান্ত। যার কারণে প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও নারী সেই স্তরে পৌঁছাতে পারে না, যেখানে একটা পুরুষ সহজে পৌঁছেতে পারে। কর্মস্থল থেকে একটু দেরী করে ফিরলে চাকরিজীবী নারীকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়।
বাঙালি নারী সে যে ধর্মের হোক না কেন স্বামীকে দেবতার আসনে বসিয়ে রাখে। স্বামীর সমস্ত আদেশ কর্তব্য মনে করে শিরোধার্য করে নেয়। স্বামীর মতামতের সাথে সুর মিলিয়ে হা বলাও রীতিমতো নিয়মে দাঁড়িয়ে আছে। এ ছাড়া উপায়ও নেই। বিয়ের ক্ষেত্রে যৌতুক বিরোধী অনেক কথা শোনা যায়। কিন্তু যৌতুক প্রথা অবসানের কোনো নজির নেই। আইনের শিথিলতার ফাঁক ফোঁকরে নারীর ওপর ঘটে যাচ্ছে হাজারো অন্যায় অনিয়ম। নির্যাতিত হচ্ছে নারী। কিন্তু কোনো বিচার পাচ্ছে না। শিশু ও নারী নির্যাতনের শাস্তি স্বরূপ বেশ কিছু আইন আছে। যেমন কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, সে মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে। এমন কি ধর্ষণের চেষ্টা করা হলেও, উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বৎসর বা অন্যূন পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে। কিন্তু দুষ্কর্মকারীরা আইনের বার হাত বের করে ঠিকই বের হয়ে আসে। আসার পর কী ঘটে সে ব্যাপারে সবাই ওয়াকেবহাল। ঐ শিশুর বা মেয়ের বা পরিবারের বেঁচে থাকা মৃত্যুর চেয়েও দুর্বিষহ জঘন্য হয়ে যায়। তাহলে কী হবে নারীর। সতীত্ব বর্মা পরলে কেমন হয়? তাতেও কি নারী রেহাই পাবে? কিন্তু অন্দরমহলের নিপীড়ন সেটা কি করে বন্ধ হবে। মেয়েদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। আইন আছে, আইনের আশ্রয় নিতে হবে। ভয় বা লজ্জা পেলে হবে না। মেয়েরা মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে হবে। শিক্ষা ছাড়া প্রতিটি মেয়েই দুর্বল। মেয়েদের শিক্ষিত হতে হবে। মেয়েদের স্বাবলম্বী হতে হবে। নিজে স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে না করাই সমীচীন হবে। স্বামীকে দেবতা না ভেবে নিজের বন্ধু ভাবতে হবে। মেয়েদের চলনে–বলনে শালীন হতে হবে। স্বাধীনতা মানে উচ্ছৃঙ্খলতা নয়। স্মার্টনেস মানে নিজের সংস্কৃতি ছেড়ে অপসংস্কৃতিতে ডুবে যাওয়া নয়– এটা বুঝতে হবে। জীবনে সবকিছু মনের মতো হয় না। দুজনকেই মানিয়ে নিতে হয়। সবশেষে বলবো, জীবন একটাই। সময় বয়স কোনো ফ্যাক্টর নয়। জীবনকে নিজের মতো করে ভালোবাসতে হবে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক