মহামারি-উত্তর বিশ্বে ঝুঁকি প্রশমন : কর্মক্ষেত্রে সুযোগ প্রসারণ। ওহপষঁংরড়হ রহ ড়িৎশঢ়ষধপব: ঈযধষষবহমবং ধহফ ঙঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃরবং রহ ধ চড়ংঃ- চধহফবসরপ ডড়ৎষফ এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আজ ২রা এপ্রিল, ১৪তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালিত হচ্ছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে। মিডিয়ার কল্যাণে এখন অটিজম শব্দটি বেশ পরিচিত বিশ্বব্যাপী, আর আমাদের দেশে আরও বেশি পরিচিত বর্তমান অটিজম ও সকল প্রতিবন্ধী বান্ধব সরকার এবং আমাদের অটিজম বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সম্মানিত চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ এর বদৌলতে। দিবসটি পালিত হচ্ছে ২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছর জাতি সংঘের ডাকে। উদ্দেশ্য জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে অটিজম যাদের আছে তাদেরকে সমাজে একীভূত করা, জীবনমান উন্নয়নে একত্রে কাজ করা, সহনশীল হওয়া তাদের প্রতি, সারাবিশ্বকে এব্যাপারে সচেতন করা যাতে সর্বক্ষেত্রে অটিজম ব্যক্তিরা সমাদৃত হয় মায়ার আলিঙ্গনে।
সেন্টার ফর ডিজিস কনট্রোল আমেরিকার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে প্রতি ৫৪ জনে একজন শিশুর অটিজম , ছেলেরা ৪.৩ গুণ বেশি মেয়েদের তুলনায়।
ইতিহাস থেকে জানা যায় ১৯১১ সালে সাইকিএট্রিস্ট ইউগেন ব্লুলার অটিজম বিষয়ে বলেন যাকে তিনি বলেন সিজোপ্রেনিয়ার একটা অবস্থা যাতে আক্রান্তরা সামাজিক মেলেমেশা করতে পারে না। এর পর ১৯৪৩ সালে শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ লিওকেনার অটিজমকে বিশেষায়িত করেন সামাজিক এবং আবেগীয় ডিসঅরডার বলে।
১৯৪৪সালে জার্মান বিজ্ঞানী হেনস্ এসপারজার যুক্ত করেন স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন কিন্তু সামাজিক মেলামেশা এবং ভাববিনিময়ে অপারগ এমন সমস্যাও অটিজমে আছে ।
এর পর অটিজমকে সিজোপ্রেনিয়া থেকে পৃথকভাবে সংজ্ঞায়িত করা শুরু হলো ১৯৮০ সালে। অটিজম বিষয়ে বছরের পর বছর চলে গবেষণা, ২০১৩সালে আমেরিকান সাইকিএট্রিস্ট এসোসিয়েশন অটিজমকে এককভাবে সংজ্ঞায়িত করেন এবং এর ভয়াবহতার গুরুত্ব উপলব্ধি করে ২০০৭ সালের ১৮ই ডিসেম্বর জাতীয়সংঘ বিশেষ অধিবেশন ৬২/ ১৩৯ এর মাধ্যমে ২রা এপ্রিল কে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী অটিজম সচেতনা দিবস পালনের জন্য সকল সদস্যরাষ্ট্রকে নির্দেশনা দেন।২০০৮ থেকে সেই মোতাবেক প্রতিবছর বিশ্বঅটিজম সচেতনতা দিবস পালিত হচ্ছে বাংলাদেশ সহ সকল দেশে।
২০১৯ এর ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত সারা বিশ্ব পার করছে করোনা মহামারীর ভয়াবহতা। করোনা মহামারীর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম হলো অটিজমসহ সকল প্রতিবন্ধীরা। অটিজম সারা জীবনের সমস্যা, সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে অটিজম থেকে উত্তরণ ঘটানো যায়, কিন্তু অটিজমকে সারানো যায় না, কারণ এর কোন ওষুধ নেই আজ পর্যন্ত নিরাময়ের। তাই পরিচর্যায় যখন বিঘ্ন ঘটে, ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যায় না তখনই পিছিয়ে যাই তারা, পরিবারগুলোকে পড়তে হয় মানসিক, আর্থিক সংকটে; এ করোনা মহামারী ঠিক সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে অটিজমের ক্ষেত্রে।
অটিজম শিশু-কিশোরদের নিয়ে পরিবারের সংকট, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রশিক্ষণের সুযোগ যেমন নেই, তেমনি অনেক পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে অনলাইন প্রশিক্ষণেএ যোগ দিতে পারছে না অনেক পরিবার। কর্মক্ষম অটিজমের ব্যক্তিরা অনেকেই কাজের অভাবে চরম আর্থিক সংকটে।
তাই এবারের বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসের প্রতিপাদ্যকে যথার্থ গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি করা আমাদের সকলের প্রয়োজন এবং করোনা মহামারী এ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে সহায়তা এবং পুনর্বাসনের জন্য সরকারী বেসরকারি সংশ্লিষ্ট সকলকে যথাযথ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এদের পাশে, এদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে। অটিজম কমিউনিটিও অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের মতো অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার, বিশেষ করে করোনা মহামারীতে এ বৈষম্য প্রকট হয়েছে আর্থিক, সম্পদের বন্টন, স্বাস্থ্যসেবা, আইনগত এবং রাজনৈতিক সুরক্ষা।
অথচ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৮নং লক্ষ্যমাত্রা হলো সকলের সাথে প্রতিবন্ধীদেরকেও একসাথে নিয়ে কর্মক্ষেত্র ও কর্মপরিবেশের কথা বলা হয়েছে।
আর জাতি সংঘের ২৭নং ধারায় প্রতিবন্ধীব্যক্তির অধিকার বিষয়ে বলা হয়েছে- ঃযব ৎরমযঃ ড়ভ ঢ়বৎংড়হং রিঃয ফরংধনরষরঃরবং ঃড় ড়িৎশ, ড়হ ধহ বয়ঁধষ নধংরং রিঃয ড়ঃযবৎং, ধহফ ঃড় ধ ড়িৎশ বহারৎড়হসবহঃ ঃযধঃ রং ড়ঢ়বহ,রহপষঁংরাব ধহফ ধপপবংংরনষব ঃড় ঢ়বৎংড়হং রিঃয ফরংধনরষরঃরবং.
আমাদের ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী এবং অটিজম বিষয়ক আইনেও এবিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ আছে সমন্বিত বা রহপষঁংরড়হ বিষয়ে সকল ক্ষেত্রে- শিক্ষা, সেবা, স্বাস্থ্য, চাকরি- কর্মক্ষেত্র সব জায়গায়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় অটিজম সহ সকল প্রতিবন্ধীরাই এখনও আইনে উল্লেখিত সকল সেবা – সুযোগ পুরোপুরি পাচ্ছে না।
এ সুযোগ সুবিধা ভোগ করার জন্য, সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য, তাদেরকে সমাজে একীভূত করার জন্য সরকারের সাথে সাধারন জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে।
করোনা মহামারী সংকট যেমন সৃষ্টি করেছে তেমনি অনেক সুযোগ সুবিধাও দোরগোড়ায় এনে দিয়েছে।ঘরে বসে অনলাইনে অনেক বেশী সংখ্যক অভিভাবক, শিক্ষক প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন, অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানদের নিজেযুক্ত থেকে অটিজম উত্তরণে সহায়তা করতে পারছেন। যেসব অভিভাবক গ্রামেগঞ্জে থাকেন, শহর থেকে অনেক দূরে থাকেন, যেখানে তাদের বিশেষ সন্তানদের প্রশিক্ষণের কোন সুযোগ ছিল না, এ করোনা মহামারীতে তারাও অনলাইনে অনেক প্রশিক্ষনের সুযোগ পেয়েছেন এবং পরবর্তীতে এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের যে কোন জায়গা থেকেই প্রশিক্ষণগুলোর সুযোগ নিতে পারবে সংশ্লিষ্ট সকলেই; অথচ করোনাপূর্ব সময়ে এব্যাপার তেমন কোন ভাবনাই ছিলো না। অটিজমের শিক্ষাপ্রশিক্ষণের সুযোগ আছে কেবল বড় বড় শহরগুলোতে, আর করোনা মহামারী সে সুযোগ বিস্তৃত করেছে শুধু সারা দেশব্যাপী নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। সুতরাং একটু আত্মিক সহায়তা পেলে, অটিজম এবং সকল প্রতিবন্ধীদের যেকোন অবস্থান থেকেই প্রশিক্ষিত করা সম্ভব।
বাংলাদেশ অটিজম আন্দোলনে বিশ্বব্যাপী অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে আমাদের জাতীয় অটিজম ও স্নায়ুবিক বিকাশজনিত সমস্যাবিষয়ক চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের হাত ধরে। সরকারি সকল উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং অটিজম ও সকল প্রতিবন্ধী বান্ধব। তার মধ্যে অন্যতম জাতীয় প্রতিবন্ধী আইন ২০১৩ এবং নিউরোডেভালোপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা।এ আইন ও ট্রাস্ট এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সকল স্বার্থ, ঊন্নয়ন, জীবন জীবিকার সহায়তা, পুনর্বাসনের সকলকিছুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে।
করোনা মহামারীতেও ত্রাণ সহায়তা নিয়ে বিশেষ পরিবার গুলোর পাশে থাকার চেষ্টা করেছে আমাদের বর্তমান প্রতিবন্ধী বান্ধব সরকার, যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এনডিডি ট্রাস্ট বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে এ মহামারীতে পরিবারগুলোকে সহায়তা করার জন্য, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্যে, ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি ব্যবস্থা করেছে বিশেষায়িত স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবক প্রশিক্ষণের অনলাইনের মাধ্যমে; এতে করে অনেক অভিভাবক কিছুটা হলেও সহায়তা পেয়েছে এবং পাচ্ছে তাদের সন্তানদের লালন পালনে। কিন্তু বিশাল জনগোষ্ঠীর অটিজমসহ সকল প্রতিবন্ধীকে পুরোপুরি সহায়তা করা অনেকটাই দুরূহ ব্যাপার। আমাদের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন পরিসংখ্যান মতে দেশের প্রায় ৯% জনগণ কোন না কোন প্রতিবন্ধিতার শিকার। বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিবন্ধিত অটিজমের সংখ্যা ৬০ হাজারেরও অধিক যদিও এ সংখ্যা বাস্তবে আরও অনেক বেশি। অনেকে নিবন্ধন সম্বন্ধে এখনও জানেন না, আবার অনেকে সন্তানের ভিন্নতা জেনেও লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতে চান অজ্ঞতা, কুসংস্কারের কারণে। অটিজম ব্যক্তিদের খুবই কমসংখ্যক কর্মজীবী, তাও এ করোনাকালে তাদের অনেকেই কাজ হারিয়েছে। তাই সরকারের সাথে সহযোগী হয়ে কর্মক্ষম অটিজম ব্যক্তিদের প্রয়োজনে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপার্জনশীল ব্যক্তিতে পরিণত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে, এরা যেনো কারো বোঝা না হয়ে কর্মজীবী মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে পার,দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে, সহায়ক, মানবিক পরিবেশ যেনো পায়।
সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমাদেরকেই সৃষ্টি করতে হবে সহায়ক পরিবেশ এ বিশেষ সন্তান, ব্যক্তিদের জন্য তবেই হবে এবারের বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উদযাপনের সার্থকতা, প্রতিপাদ্য ২০২১ এর সার্থকতা, প্রতিটিদিনই হোক অটিজম সচেতনতা দিবস, এ বিশেষ শ্রেণি ও তাদের পরিবার বেঁচে থাকুক সকল সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে। আসুন সবাই মায়া ছড়াই, মানুষ মানুষের জন্য হোক না সে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন; মানবতার জয় হোক, সকল প্রতিবন্ধীরা সম্মান নিয়ে পথ চলবে এটাই কাম্য।
লেখক : শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; সভাপতি, নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন,চট্টগ্রাম