সংস্কারের রূপরেখায় আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন

নাসের রহমান | সোমবার , ৪ নভেম্বর, ২০২৪ at ৮:২০ পূর্বাহ্ণ

এসময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় সংস্কার। এ বিষয় নিয়ে যতো বেশি আলোচনা হয় ততোই ভালো। আলোচনার মধ্য দিয়ে অনেক কিছু বেরিয়ে আসে। সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়াটা স্বাভাবিক। এ বিষয়ের সাথে আরো অনেক কিছু জড়িত। অনেক ব্যাপার বিবেচনায় আনতে হয়। সব কিছু এতো সহজে আনা যায় না। কোনো কোনো বিষয় অনেক জটিল। দীর্ঘ সময় ধরে জট পেকে আছে। যে কোনো ধরনের পুরানো জট সহজে খোলা যায় না। কোনো কোনো জটলা খুলতে গেলে হাজারো সমস্যা বেরিয়ে আসে। এসব সমস্যা দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত। একটার সমাধান করতে গেলে অন্য সমস্যাগুলো আরো প্রকট আকারে দেখা দেয়। তারপরও সমাধানের পথ বের করতে হয়। সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। যদিওবা সব সমস্যার পুরাপুরি সমাধান করা যায় না। তবুও সমাধানের চেষ্টা করতে হয়।

সংস্কার একটা বড় ব্যাপার, ব্যাপক একটি বিষয়। অনেক বিস্তৃত এর পরিধি। যে কোনো ধরনের সংস্কার সহজে হয় না। সময় সাপেক্ষ দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপার। তাড়াহুড়া করে সংস্কার করা যায় না। অনেক ভেবে চিন্তে সংস্কারের পদক্ষেপ নিতে হয়। সম্ভাব্য বৈপরীত্যগুলো বিবেচনায় আনতে হয়। বর্তমান, ভবিষ্যৎ উভয় কালকে ধারণ করে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। অতীতের ভুল ভ্রান্তি, ত্রুটি বিচ্যুতি এবং সব ধরনের অসঙ্গতি পরিহার করা এতো সহজ নয়। এ ধরনের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়াও যায় না। দীর্ঘদিনের এসব অনিয়মকে ভেঙে চুরে চুর্ণ বিচূর্ণ করে দিতে গেলে অনেক প্রশ্ন এসে যায়। এমনকি বাধাও এসে দাঁড়ায়। অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো যতো সহজ নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠা করা এতো সহজ নয়। তার জন্য আরো বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আরো বেশি দৃঢ়তার প্রয়োজন হয়। সক্ষমতার প্রয়োজন হয়। সঠিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়।

যে কোনো বড় অর্জনকে ধরে রাখতে হলে তার ভিত তৈরি করতে হয়। তা না হলে বড় অর্জনের সাফল্য দীর্ঘমেয়াদী হয় না। আবার এমন কিছু ব্যর্থতা এসে যায় যেগুলো বড় অর্জনের সাফল্যকে ম্লান করে দিতে পারে। তখন ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সংশোধন করা বা এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিনের পুরানো জঞ্জাল বা আবর্জনা সরাতে গিয়ে যেন মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হয়। অনেক বড় সাফল্য বা অর্জন কোনো কোনো সময় সাধারণ মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। এজন্য লক্ষ্য নির্ধারণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এসব লক্ষ্য সর্বজনীন কিনা তাও বিবেচনার বিষয়। সর্ব সাধারণের স্বার্থকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। যেসব পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত বেশির ভাগ মানুষের কল্যাণে আসে না, সেসব সিদ্ধান্ত পরিহার করা সমীচীন। সর্বদা বৃহত্তর স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে হয়। ক্ষুদ্র স্বার্থ বা বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া হলে বৈষম্য তৈরী হয়। এ বৈষম্য মানুষের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করে।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন তা ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশাসন, নির্বাচন, সংবিধান এসব ক্ষেত্রে সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। একই সাথে অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত ব্যাংকিং সেক্টরেও সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে ব্যাংকিং সেক্টরকে পুরোপুরিভাবে সংস্কারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এছাড়া আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ খাত রয়েছে যেগুলোর সংস্কার প্রয়োজন। বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাত, যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম খাত রেলওয়ের ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সংস্কারের মাধ্যমে জনবান্ধব করে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই। শিল্প খাত কিংবা উৎপাদন খাত এগুলো অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প খাতের গার্মেন্টস শিল্পে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এসব খাত, অব্যবস্থাপনা ও নানাবিধ সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার করা না হলে এসব খাত বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারবে না। এভাবে প্রায় সব ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের রূপরেখা প্রণয়নের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর জন্য যে ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন তাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রূপরেখা প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করার তাগিদ রয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তৈরী সময় সাপেক্ষ হলেও কার্যক্রম শুরু হলে এক সময়ে সম্পন্ন হয়ে যাবে। তবে সংস্কারের মত বৃহৎ কর্মপরিকল্পনা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা দুরূহ। এসব পরিকল্পনায় বিতর্কিত কাউকে সম্পৃক্ত করা যায় না। এসব ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ খুঁজে পাওয়াও এতো সহজ নয়। আবার সবার কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কী রকম তাও বিবেচনায় আনতে হয়। শুধু বিশেষজ্ঞ দিয়ে এসব পরিকল্পনা তৈরী করা যায় না, এর সাথে বাস্তব জ্ঞান সম্পন্ন অভিজ্ঞদের সমন্বয় ঘটাতে হয়। যে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করার পূর্বে এর প্রয়োগিক দিকগুলো পুঙ্খানুরূপে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাধারণ মানুষের মতামতের প্রয়োজন। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের মতামত সংস্কারের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। দল মত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার রয়েছে সংস্কারের মতামত প্রদানের। এরকম জন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণের মতামতের প্রতিফলন আবশ্যকীয়। তবে এ জাতীয় বিষয়ে জনমত যাচাই যতো সহজে করা যায় মতামত গ্রহণ এতো সহজ নয়। সরাসরি মতামত প্রদানেরও সুযোগ নেই বললে চলে। বিপুল জনগোষ্ঠীর মতামতের প্রতিফলন কোন সহজ বিষয় নয়। এক সময়ে হানা ভোটের মাধ্যমে জনমত যাচাই করা হতো। বর্তমান সময়ে এটা কোন গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হতে পারে না। তবে এ কথা সহজ বলা যায় সবাই সংস্কার চায়। সংস্কারের পক্ষে সবার মত আছে। সংস্কার ছাড়া সামনের দিকে এগিয়ে চলার পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। তারপরও জনগণের মতামতের প্রতিফলন বাঞ্চনীয়। ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ব্যতীত সংস্কারের মতো বৃহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন দুরূহ।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী, সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী এবং অন্যান্যদের সাথে সংস্কারের বিষয়ে মত বিনিময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হলে এসব মত বিনিময় অর্থবহ হবে। যদিওবা এসব সংগঠনে সাধারণ মানুষের স্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত থাকে। সাধারণের মতামত কখনো প্রাধান্য পায় না। তারপরও সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ, সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করা গেলে অনেক বিষয়ে অভিন্ন মতামতে পৌঁছা যাবে। এতে করে সংস্কার নিয়ে সুশীল সমাজের যে চিন্তাভাবনা তার বাস্তব রূপ দেয়ার পথ সুগম হতে পারে। সংস্কার প্রশ্নে অনেক মত ভিন্নতা থাকতে পারে। বিভিন্ন উপায়ে সংস্কার করা যায়। কিন্তু সংস্কারের সঠিক পথটা খুঁজে বের করা সবচেয়ে জরুরি। সঠিক পথ চিহ্নিত করা না গেলে কখনো সংস্কারের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে না। তখন চলমান প্রক্রিয়া ব্যহত হবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থবিরতা এসে যেতে পারে।

পর্যায়ক্রমে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন মানুষেরা সম্পন্ন করবে। এক্ষেত্রে মানুষের মানসিকতার সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। পরিচ্ছন্ন মানসিকতা ছাড়া অন্য মানুষেরা সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে নিতে পারবে না। এজন্য অনেকের মানসিকতার পরিবর্তন খুবই দরকার। উন্নত মানসিকতার লোকেরা এ ধরনের পরিবর্তনের সাথে সহজে একাত্ব হতে পারে। নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে। আবার অনেকের সময় লাগে। পুরনো ধ্যান ধারণার পরিবর্তন সহজে করতে পারে না। এজন্য এসব বিষয় নিয়ে যত বেশি আলোচনা হয় তাতে গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। একসময়ে বিষয়গুলো সর্বজনীন হয়ে যায়। এখানে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে কাজ করার চেয়ে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির ব্যাপারে অধিক মনোযোগী থাকে। এর ফলে কখনো কখনো অনেক ভালো উদ্যোগও শেষ পর্যন্ত সফল হয় না।

বর্তমানে বহুল আলোচিত যে সংস্কার কর্মসূচী তার প্রতি মানুষের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। আলোচনা সমালোচনা চলতে থাকে। আলোচনার দ্বার সবসময় উন্মুক্ত থাকে। এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে সংস্কারের প্রশ্নে মানুষের ঐক্যমত্য আগে তৈরি হয়ে গিয়েছে। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যে ছয়টি বিষয়ের সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে তা সবার মনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। ছাত্র জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে যে আশা আকাঙ্ক্ষার তৈরি হয়েছে তার বাস্তবায়নের জন্য সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। এ ঐতিহাসিক সংস্কার কমিশনের দিকে পুরো জাতি তাকিয়ে আছে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু
পরবর্তী নিবন্ধচলতি মাসে লঘুচাপ, পরিণত হতে পারে নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড়ে