সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার যে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে তিন মাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দেয়ার কথা রয়েছে। এরপর তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে যাবে সরকার। সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক মতৈক্য গড়ে সংস্কার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার, সুনির্দিষ্ট কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশোধনী এনে তারপর নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সংস্কার না করার ফল কী হয়েছে তা এতোদিন রাজনৈতিক দলগুলোর উপলব্ধি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এর আগে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক মতৈক্য গড়ে সংস্কার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার সুনির্দিষ্ট কোন কোন ক্ষেত্রে সংশোধনী এনে তারপরেই আমরা নির্বাচনের কথা ভাবছি। রাজনৈতিক দলগুলোও ইতিমধ্যে স্পষ্ট করেছে আগে সংস্কার তারপরে তারা নির্বাচনে যেতে চান। দেশের ছয়টি খাতের সংস্কার নিয়ে ছয়টি কমিশনের বিষয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন রিজওয়ানা হাসান। খবর বিডি/বাংলা/বিবিসি বাংলার।
তিনি বলেন, আপাততের জন্য শুধু যিনি নেতৃত্ব দেবেন, তার নামটা ঠিক করেছি। উনিই আসলে ঠিক করবেন, আমাদের সকলের সঙ্গে আলোচনা করে, অন্য কমিশন মেম্বার কারা হবে। আর সংস্কার প্রস্তাব যেগুলো আসছে, সেগুলো কিছু কিছু জিনিস পত্রপত্রিকায় আছে, জনগণের মতামত হিসেবে আছে, কারও কারও গবেষণা হিসেবে আছে। ওইগুলো নিয়ে তারা কাজ শুরু করে দেবেন। এর মধ্যে ‘কংক্রিট’ যে প্রস্তাবগুলো আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আহ্বান করেছি, সেগুলো চলে আসবে। ফলে উনাদের টার্মস অব রেফারেন্স– কর্মপরিধি ঠিক করতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ লেগে যাবে। নবগঠিত কমিশনগুলোর কর্মপরিধিরি বিষয়ে উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেন, কিন্তু আমরা মনে করেছি, এই দুই–তিন সপ্তাহ বসে না থেকে হাতে যা আছে তা নিয়েই উনারা শুরু করুক। উনারা কোথায় বসবেন, এটাও মোটামুটি ঠিক করা হয়েছে, মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ এই কমিশনগুলোতে সাচিবিক সহায়তা দেবে। প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘ সম্মেলন শেষ করে আসার পর কর্মপরিধি এবং কারা থাকবেন কমিশনে তা ঠিক হবে। তিন মাসের মধ্যে কমিশনগুলো তাদের প্রতিবেদন দিতে পারবে বলেও এক প্রশ্নের জবাবে বলেন রিজওয়ানা হাসান।
একজন সাংবাদিক জানতে চান– এরশাদ সরকারের সময় এই ধরনের কমিশন করা হয়েছিল। কিন্তু ওই কমিশনের প্রতিবেদন আলোক মুখ দেখেনি। এবার কি সেটা হবে? জবাবে রিজওয়ানা হাসান বলেন, এরশাদ সরকারের সাথে এই সরকারের ফাউন্ডেশনেই একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। এই সরকার একটি গণঅভ্যুত্থানের আউটকাম। সেই গণঅভ্যুথানে দুটি মূল শব্দ ছিল। একটি হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী এবং আরেকটি সংস্কার। এটার উদ্দেশ্যে হচ্ছে একটি প্রকৃত গণতন্ত্রের দিকে দেশকে নিয়ে যাওয়া। যেহেতু এরশাদ সরকারের সঙ্গে আমাদের ফাউন্ডেশনেই অনেক পার্থক্য আছে, কাজেই তার সঙ্গে কর্মপদ্ধতি কর্মপরিকল্পনা এবং উদ্দেশ্যেকে আমরা কোনভাবেই মিলিয়ে ফেলব না। প্রাথমিকভাবে আমরা আশা করছি কমিশনগুলো তিন মাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দিতে পারবেন।
কমিশন গঠন করে সংস্কারের প্রচেষ্টায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সতর্কতার দিকটি সম্পর্কে অবহিত করেন পানি সম্পদ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, এগুলো আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না, সেটা নির্ভর করবে রাজনৈতিক ঐক্য এটার সপক্ষে আমরা গড়ে তুলতে পারি কি না। এ জন্য সংস্কারের বিষয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোরও মতামত চাচ্ছি।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নিশ্চয়ই এত দিনে এই উপলব্ধি আসছে যে, আপনি বললেন এরশাদ সরকার করে যেতে পারেনি। আর তার ফল কী হয়েছে, এটা রাজনৈতিক দলগুলো দেখেছে। তারাও (রাজনৈতিক দল) কোনো সংস্কার করেনি। এর ফল কী হয়েছে, সেটাও ৫ অগাস্ট গোটা জাতি দেখেছে। সংস্কারের লক্ষ্য বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, কোনো রাজনৈতিক দল নিশ্চয়ই অজনপ্রিয় হয়ে আবার একই রকম ফলাফল দেখতে চাইবে না। এ জন্য প্রথম থেকেই আমরা মতবিনিময়ে তাদেরকে (রাজনৈতিক দল) অন্তর্ভূক্ত করেছি। এক পর্যায়ে আমরা সংলাপে যাব। ওই সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক মতৈক্য গড়ে সংস্কার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে তারপরে আমরা নির্বাচনের কথা ভাবছি। রাজনৈতিক দলগুলো ইতোমধ্যে স্পষ্ট করেছে যে আগে সংস্কার এবং পরে তারা নির্বাচনে যেতে চায়। কাজেই আজকের দিনে বাস্তবতাটাও ভিন্ন, প্রেক্ষিতটাও ভিন্ন।
গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়ায় শেখ হাসিনাকে উপস্থিত থাকতে হবে: এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ‘জুলাই গণহত্যা’র বিচার প্রক্রিয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে (উপস্থিত) থাকতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন রিজওয়ানা হাসান। তবে কোন পদ্ধতিতে তার প্রত্যাবর্তন হবে, সেটা আইনি প্রক্রিয়া শুরু হলে দেখা হবে। শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য ও দেশটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে নেতিবাচক মন্তব্য আসার পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরে এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানতে চান একজন সাংবাদিক। এ ব্যাপারে রিজওয়ানা হাসান বলেন, শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে আমাদের অবস্থানটা স্পষ্ট। গণহত্যার যে অভিযোগ রয়েছে, তার বিচারের স্বার্থে এবং নির্যাতন–নিপীড়নসহ সর্বোপরি একটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার মুখপাত্র হিসেবে বিচারের প্রক্রিয়ায় তাকে থাকতে হবে। কারণ দায়–দায়িত্বের এখানে একটা ব্যাপার আছে। যেই প্রত্যাবর্তনের কথা বলা হয়েছে, সেই প্রত্যাবর্তনটা কোন প্রক্রিয়ায় হবে, দুই দেশের মধ্যে কীভাবে কথা হবে, সেই প্রক্রিয়া পরের ব্যাপার। যখন আইনি প্রসেসটা শুরু হবে, তখন এগুলো আমরা দেখব।
নেতিবাচক মন্তব্য প্রশ্নে তিনি বলেন, নেতিবাচক বিভিন্ন মন্তব্য রয়েছে। আমরা গত ১৫ বছর বেশিরভাগ মানুষই এই দেশে ছিলাম। সেই বাস্তবতাটা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু আমাদের চেষ্টা হবে আমাদের পাশের দেশসহ সকল দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা। তবে সেটা হতে হবে ন্যয্যতা আর সমতার ভিত্তিতে। এটা বারবার স্পষ্ট করা হচ্ছে। এখানে কোনো নতজানু নীতির বিষয় নেই। যেটা আমাদের অধিকার, আমাদের প্রাপ্য এবং যেটা আমাদের বিবেচনায় সঠিক, সেই কথাগুলো যে যে চ্যানেলে আমাদের বলা দরকার, তা সেটা কূটনৈতিক হোক, রাজনৈতিক হোক বা ব্যক্তিগত বা আন্তর্জাতিক হোক; আমরা সেটা বলব।
মন্ত্রণালয়ের টাকা কেন দুর্বল ব্যাংকে, তদন্ত হবে : সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের টাকা বিগত আওয়ামী লীগ সরকার বিভিন্ন দুর্বল বেসরকারি ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট (এফডিআর) করে রেখেছে। এ টাকাগুলো কোন বিবেচনায় এসব ব্যাংকে রাখা হয়েছে, তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বন, পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সেয়দা রিজওয়ানা হাসান। রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমার (বন, পরিবেশ ও জলবায়ু) মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডে সরকার ৫৯৭ কোটি টাকা দেয়। বিগত সরকার এ টাকা ফারমার্স ব্যাংকে রাখে, যেটি বর্তমানে আমরা বলি পদ্মা ব্যাংক। ফারমার্স ব্যাংকে রাখা টাকা সুদে আসলে বেড়ে হয়েছে ৮৭৩ কোটি ৮১ লাখ ৬৫ হাজার ৮৫৩ টাকা। বারবার টাকা চাওয়ার পরও বর্তমান পদ্মা ব্যাংক সেই টাকা দিতে পারছে না। তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে কোনো কনসালটেশন না করেই পদ্মা ব্যাংক বছর বছর এফডিআর রিনিউ করছে। তাদের বর্তমান বক্তব্য ২০৩৮ সালের আগে তারা এ টাকা দিতে পারবে না। না সুদ, না আসল। এ রকম সমস্যা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়েও আছে। তিনি বলেন, এসব টাকা দুর্বল ব্যাংকে কোন বিবেচনায় রাখা হয়েছে, বলতে পারি না। এটি তো পাবলিক মানি। সিদ্ধান্ত হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে বলা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেসব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসে রোডম্যাপ তৈরি করে দেবে, যাতে এ পাবলিক মানি আমরা ফেরত পেতে পারি।
লোডশেডিংয়ের সমাধান দুই–তিন সপ্তাহের মধ্যে : লোডশেডিং বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রিজওয়ানা হাসান বলেন, লোডশেডিং শুধু আপনাদের প্রভাবিত করছে না, আমাদেরও প্রভাবিত করছে। আমরা গ্রাম এলাকা থেকে অভিযোগ পাচ্ছি। আমাদের যা পাওনা–দেনা আছে, তা মিটিয়ে দিতে হবে, সেই মিটিয়ে দেবার জন্য আমরা অগ্রাধিকারও ঠিক করছি। কোথায় কোথায় পাওনা–দেনা মিটেয়ে দিলে, মানুষের যে ভোগান্তি বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকার কারণে, সেই ভোগান্তি যাতে মিটে যায়। সেখানেও একটা কথা গতকাল (বুধবার) বলা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করব দুই–তিন সপ্তাহের মধ্যে এই সমস্যার একটা সমাধানে পৌছে যেতে।
‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ গঠন : উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে শহীদ পরিবার ও আহতদের চিকিৎসাসহ দীর্ঘমেয়াদে সহায়তার জন্য ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ গঠন করা হয়েছে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসকে সভাপতি ও শহীদ মুগ্ধের ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধকে এই ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে সাতজন সদস্যের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। এই কমিটির মোট সদস্য হবেন ২১ জন। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এক সভায় এই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকের পর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং যুব ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া এই ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এর আগে তথ্য ও সমপ্রচারবিষয়ক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এই কমিটি গঠনের কথা বলেছিলেন।