সংশোধিত ধর্ষণ আইন: ধর্ষণের আওতায় থাকবে বলাৎকারও, বাড়ছে অর্থদণ্ড

হরোকিয়া ফারহিন | শনিবার , ১৯ এপ্রিল, ২০২৫ at ১১:১৪ পূর্বাহ্ণ

গত বছর স্বৈরাচার সরকার পতনের পর এবং অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি বেড়ে চলে ধর্ষণ এবং নারী সহিংসতার মতো ঘটনাগুলো। এরই ফলশ্রুতিতে আপামর জনতার সহযোগে গঠিত হয় ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ। এই মঞ্চ থেকে নিম্নোক্ত দাবীদফাগুলো পেশ করা হয়:

আছিয়ার মামলার ক্ষেত্রে ধর্ষণ ও নিপীড়নবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে সাতদিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা এবং এক মাসের মধ্যে আছিয়ার ধর্ষকের বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন সাপেক্ষে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের আদেশ নিশ্চিত করতে হবে। বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন আছিয়ার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রত্যেক ধর্ষণ মামলার বিচারে ধর্ষণ ও নিপীড়নবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দ্রুত মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন করে সকল ধর্ষণের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

নারী ও শিশুর নিরাপত্তার প্রশ্নে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, নারী ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টার ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে জবাবদিহি করতে হবে।

সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে ‘নারী ও শিশু নিপীড়নবিরোধী সেল’ গঠন ও সেলের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হবে।

ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাইবার বুলিং সংক্রান্ত আইনের সংশোধন করে অপরাধের স্পষ্ট ও যথাযথ সংজ্ঞায়ন করতে হবে।

এসব দাবীর প্রেক্ষিতে সচিবালয়ে ধর্ষণবিরোধী মঞ্চের নেত্রীবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন আইন উপদেষ্টা। সেসময়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধনে সরকারের পদক্ষেপের বিষয়ে ধর্ষণবিরোধী মঞ্চের নেত্রীবৃন্দকে জানানো হয় যে একটা খসড়া (সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন) আইন প্রণয়ন করা হবে, আইনটি যথাসম্ভব কঠোর করার চেষ্টা করা হবে এবং ধর্ষণের মামলার বিচার যাতে শুধু দ্রুতই নয়, বিচারটা যাতে নিশ্চিত এবং যথাযথ হয় সেবিষয়গুলো লক্ষ্য রাখা হবে। এরই ফলশ্রুতিতে সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে নতুন অধ্যাদেশ জারি করেছে, যেখানে ধর্ষণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। বলাৎকারকেও ধর্ষণের অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ধর্ষণ মামলার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়াকে দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার বিধান করা হয়েছে। নতুন আইনে বলাৎকারকেও ধর্ষণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যার ফলে নারী, শিশুর পাশাপাশি ছেলেশিশুর ক্ষেত্রে ঘটলেও এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। তবে, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা হয়নি। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ধর্ষণের মামলার তদন্ত ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে, যা পূর্বে ছিল ৬০ কার্যদিবস। প্রয়োজনে আরও ১৫ কার্যদিবস সময় নেওয়া যেতে পারে। বিচার কার্যক্রম অভিযোগ গঠনের তারিখ থেকে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করতে হবে। এছাড়াও, ধর্ষণের শাস্তি পূর্বের মতোই মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড থাকবে। তবে অর্থদণ্ডের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। ধর্ষণের ফলে মৃত্যু হলে আগে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হতো, যা বাড়িয়ে কুড়ি লাখ টাকা করা হয়েছে। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ক্ষেত্রেও অর্থদণ্ডের পরিমাণ কুড়ি লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। দহনকারী বা বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহার করে নারী বা শিশুকে হত্যা বা বিকৃত করার অপরাধে অর্থদণ্ড দশ লাখ থেকে কুড়ি লাখ টাকা করা হয়েছে। ধর্ষণের উদ্দেশ্যে নারী বা শিশুকে মারাত্মক জখম করলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে দশ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

এছাড়াও, কারো ক্ষতির উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলা দায়ের করলে ট্রাইব্যুনাল নিজ উদ্যোগে তা আমলে নিতে পারবে এবং শাস্তি দিতে পারবে। এই অপরাধে দুই বছরের কারাদণ্ড ও ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিধান রাখা হয়েছে। শিশু ধর্ষণের মামলার জন্য প্রতি জেলায় ও মহানগরে পৃথক শিশু ধর্ষণ অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুযোগ রাখা হয়েছে। যৌতুকের মামলাগুলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের আওতার বাইরে আনা হয়েছে। এপ্রসঙ্গে বাংলাদেশের আইন বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ‘‘নতুন আইনে বলাৎকারকে ধর্ষণের আওতায় আনা ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে লক্ষ্য রাখার বিষয় যে অর্থদণ্ড বাড়ানোর ফলে সাজা কার্যকর হওয়ার হার কমে যেতে পারে। পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিচার শেষ না হলে কী হবে, সে বিষয়ে আইনে তেমন কিছু বলা হয়নি। এছাড়া জামিনের সুযোগ নিয়ে আসামিরা বিদেশে পালিয়ে যেতে পারে, যা বিচারের কার্যকারিতা ব্যাহত করবে।”

তবে এটাও সত্য, এরকম আশংকা থাকার পরও এই সংশোধনী আইন বিচার প্রক্রিয়াকে আরও কঠোর ও দ্রুত বাস্তবায়নের সুযোগ নিয়ে এসেছে। আইনের যথাযথ বাস্তবায়নই এই সংশোধিত আইনের সফলতা নিশ্চিত করবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাটি ও বালুবোঝাই ট্রাক চাপায় বেহাল সড়ক
পরবর্তী নিবন্ধপর্যটন শিল্পে নারী : সমস্যা ও সম্ভাবনা