২০০৩ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, কক্সবাজার উপকূলে কচ্ছপের ডিম পাড়ার উপযোগী ৫২টি পয়েন্ট ছিল। এসব পয়েন্ট মা কচ্ছপের কাছে ছিল নিরাপদ আশ্রয়স্থল। কিন্তু গত ১০ বছরে ১৮টি পয়েন্ট নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমানে ৩৪টি পয়েন্টে রয়েছে কচ্ছপের ডিম পাড়ার। এই ৩৪টি পয়েন্টেও নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে গভীর সাগর পাড়ি দিয়ে ডিম পাড়তে আসা মা কচ্ছপগুলো। ফলে প্রতিবছর বেড়েই চলছে মৃত্যুর সংখ্যা।
এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত বছরের (২০২৪ সাল) প্রজনন মৌসুমসহ পুরো সময়ে কক্সবাজার উপকূলে মারা গিয়েছিল ২৯টি মা কচ্ছপ। কিন্তু চলতি বছর মাত্র দুই মাসেই কক্সবাজার উপকূলে পাওয়া গেছে শতাধিক মৃত কচ্ছপ।
গত বছরের মৌসুমে কচ্ছপের মৃত্যুর ৯টি কারণ খুঁজে পেয়েছিল কক্সবাজারস্থ বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট (বোরি)। তার মধ্যে প্রধান কারণ উপকূলের কাছাকাছি বসানো কারেন্ট জাল। এছাড়া রয়েছে কূলে কুকুরের আগ্রাসী আচরণ ও সমুদ্রে চলাচলকারী নৌযানের ধাক্কা। সাথে ডিম পাড়ার আবাস্থলকে সংকুচিত হওয়াও কচ্ছপের অন্যতম বড় মৃত্যুর কারণ। প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম) বলছে, সামুদ্রিক মা কচ্ছপ এখন মহাবিপদে রয়েছে। ১০ বছর আগে ২০০৩ সালে সংস্থাটির এক জরিপে দেখা গেছে, কক্সবাজার উপকূলের ৫২ পয়েন্টে কচ্ছপ ডিম দিতে আসতো। ওই সময় এসব পয়েন্ট মা কচ্ছপের কাছে ছিল নিরাপদ আশ্রয়স্থল। কিন্তু বর্তমানে কমে ৩৪ পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে।
সোনাদিয়ার পরিবেশকর্মী গিয়াস উদ্দীন জানান, সোনাদিয়ায় ১০ বছরের সময় ধরে দুটি উন্নয়ন সংস্থার কৃত্রিম আবাস্থল তৈরি করে কচ্ছপের ডিম পাড়ার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতো। কিন্তু বর্তমানে দুটি সংস্থাই তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। এতে সোনাদিয়ায় কচ্ছপের ডিমপাড়ার কোনো নিরাপদ পরিস্থিতি নেই। তাই চলতি মৌসুমেই ১৫টির বেশি কচ্ছপের মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
উপকূলের পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠন, দরিয়ানগর গ্রিন ভয়েস’র সভাপতি মোশারফ হোসেন পারভেজ জানান, কক্সবাজারের নাজিরারটেক থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত ২০টির বেশি ডিমপাড়ার স্থান ছিল। কিন্তু বর্তমানে খুঁজলে ১০টিও পাওয়া যাবে না। কিছু জোয়ারে পানির আঘাত ও বাকিগুলো লোকজন বিচরণ করে নষ্ট করেছে। ফলে স্থান না পেয়ে এদিক–ওদিক ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে কুকুরের আঘাতে কচ্ছপের মৃত্যু ঘটছে।
কক্সবাজারস্থ বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট (বোরি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুহাম্মদ শিমুল ভূঁইয়া জানান, ২৪, ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত টানা চারদিন টেকনাফের সাবরাং জিরো পয়েন্ট থেকে উখিয়া উপজেলার রূপপতি, সোনারপাড়া, পেঁচারদ্বীপ ও হিমছড়ি পর্যন্ত স্থান থেকে ৭০টি মৃত কচ্ছপ উদ্ধার করা হয়। ২৮ জানুয়ারি একদিন বিরতি দিয়ে ২৯ জানুয়ারি শেষ দফার অনুসন্ধানে নাজিরারটেক থেকে পেঁচারদ্বীপ–মংলাপাড়া পর্যন্ত স্থান থেকে আরও ১৪টি মৃত কচ্ছপ পাওয়া যায়। এছাড়া সোনাদিয়ায় ১৫টির বেশি মৃতদেহ পাওয়া যায়। অধিকাংশের পেটে ছিল ডিম। এসব মৃতদেহ থেকে নেয়া আলামত পরীক্ষার কার্যক্রম চলছে; শেষ হলে কারণগুলো জানা যাবে।
প্রজনন মৌসুমে এত সংখ্যক কচ্ছপের মৃত্যু ভাবিয়ে তুলেছে গবেষকদের। এভাবে কচ্ছপের মৃত্যু হলে তাদের বংশবৃদ্ধি ধ্বংস হয়ে যাবে। নেকমের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপক আবদুল কাইয়ুম বলেন, নির্জন সৈকতে কচ্ছপ ডিম দিতে আসে। নানা কারণে ডিম দেওয়ার স্থানগুলো এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পর্যটনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি কক্সবাজার সৈকতে আলোকায়ন, সমুদ্রে পরিত্যক্ত জাল ফেলে দেওয়া, ডিম ছাড়ার মৌসুমে বিচ ডাইভিং, খেলাধুলা, সৈকতে হাঁটা ইত্যাদির কারণে কচ্ছপের ডিম দেওয়ার স্থান নষ্ট হচ্ছে। একই কারণে ডিম দিতে এসে তাদের পুনরায় গভীর সাগরে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে মা কচ্ছপ।