দেশ এখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে রাজনৈতিক দলসমূহের মতপার্থক্য সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন বিষয়ে। জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) রাজনীতির মাঠে তেমন চমক দেখাতে পারেনি। বরং নানান বিতর্কে তাদের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের পছন্দে অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূস সরকার গঠিত হলেও সরকারের উপর এখন তাদের কর্তৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণ বলতে গেলে তেমন দৃশ্যমান নয়। এ অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা আগামী বছর এপ্রিলে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলে তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ক্রিয়া– প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। এ অবস্থায় লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূসের সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক ক্রান্তিকালীন সময় অতিক্রমে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে মানুষের প্রত্যাশার পারদ তুঙ্গে উঠেছিল। কিন্তু প্রত্যাশার বেলুন ফুটো হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। অন্তর্বর্তী সরকার জনজীবনের সমস্যা সংকট দূরীকরণে তেমন সময় দিতে পারেনি, যতটা না তাদের ব্যস্ত থাকতে হয়েছে বিভিন্ন পেশা–গ্রুপের দাবি–দাওয়া নিয়ে রাজপথে মিছিল সমাবেশ ও সড়ক অবরোধের মত ঘটনাসমূহ মোকাবেলা করার কাজে। এই সমস্যাটি সরকার নিজেই সৃষ্টি করেছে বা এমনও হতে পারে তাদেরকে দিয়ে তা করানো হয়েছে। ফ্যাসিবাদি শাসনের অবসানের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার আগেই সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতির হিড়িক পড়ে যায়। এমনও হয়েছে একই ব্যক্তি সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতির একদিন পর যুগ্মসচিব, তার একদিন পর অতিরিক্ত সচিব, তার একদিন পর সচিব এবং তার পরদিন আবার সিনিয়র সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। সবকিছু করা হয় বঞ্চিত ছিলেন এই বিবেচনায়। আবার পুলিশের সর্বোচ্চ পদ আইজিপি এবং অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার ডিএমপি কমিশনার পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় অবসরপ্রাপ্তদের। এটা করার পর ক্যাডার– ননক্যাডার সবাই মাঠে নেমে পড়েন দাবি আদায়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার দিশেহারা হয়ে পড়ে। অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংশোধনসহ এমন সব পদক্ষেপ ও কার্যক্রম সম্পন্ন করার কাজ হাতে নেয় যা নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই হওয়া উচিত।
এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল গণঅভ্যুত্থানে। ৩৪ বছর পরে এসে এই নিবন্ধ লিখতে গিয়ে মনে পড়ে সেদিনের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা। তখন তরুণ একজন রিপোর্টার হিসেবে প্রায় প্রতিদিনই দিনে বা রাতে যে কোনো সময়ে কারফিউ জারি করা হত। এর মধ্যেই কত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছি সংবাদ সংগ্রহে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে তখন আমরা সাংবাদিক, আইনজীবী, প্রকৌশলীসহ পেশাজীবীরাও সক্রিয়। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি এরশাদ চট্টগ্রাম আসেন আগ্রাবাদে শিশু হাসপাতাল উদ্বোধন করতে। এদিন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক কোটি টাকা অনুদান দিতে তাঁর আসার কর্মসূচি বাতিল করা হয় স্বৈরাচারের কাছ থেকে অনুদান গ্রহণে সাংবাদিক সমাজের অস্বীকৃতি জানানোর পর। শিশু হাসপাতালে থাকার সময়ই খবর আসে জাতীয় প্রেসক্লাব ও হাইকোর্টের মাঝামাঝি স্থানে সরকারের লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন ডা. শামসুল আলম খান মিলন। অন্যসব কর্মসূচি বাতিল করে ঢাকা ফিরে যান এরশাদ। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে হয়ে ওঠে দেশ। জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। সংবাদপত্রের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে বলা হয়, যে কোনো সংবাদ প্রকাশের আগে সরকার নিয়োজিত কর্মকর্তাকে দেখিয়ে নিতে হবে। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সাংবাদিক সংগঠনের আহবানে সাংবাদিক সমাজ লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দেয়। এরশাদের পতন পর্যন্ত টানা ৯ দিন দেশে জাতীয় ও আঞ্চলিক কোনো সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়নি। এরশাদের পদত্যাগের পর ৭ ডিসেম্বর থেকে সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে থাকে। শুধু দেশের নয়, বিশ্ব সাংবাদিকতার ইতিহাসে এটি একটি বিরল ঘটনা।
সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে বিনা রক্তপাতে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজে ক্ষমতা দখল করেন। প্রথমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই ছাত্র–জনতার আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। সেজন্য ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে তিনি বিভিন্ন দল থেকে নেতা ভাগিয়ে আনাসহ হেন কোজ নেই করেন নি। এরশাদ ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত নয় বছর ক্ষমতায় ছিলেন। নয় বছরই তাঁকে আন্দোলন মোকাবেলা করতে হয়। এরশাদ ক্ষমতা নিয়ে যে ক‘জনকে জেলে পাঠান তন্মধ্যে ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। পরে তাঁকে মুক্তি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং এরপরে উপরাষ্ট্রপতি করা হয়। রাজপথে আছে তিনজোট। তখন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। এরশাদের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তিনজোট সমঝোতায় পৌঁছে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের বিষয়েও তারা একমত হয়। কিন্তু বিচারপতি সাহাবুদ্দিন রাজি নন। পরে অনেক জোরাজুরিতে রাজি হন এই শর্তে যে, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন শেষে তিনি আবার স্বপদে অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি পদে ফিরবেন। সংবিধান তা অনুমোদন করে না। তিনজোটের তাদের রূপরেখায় ঐকমত্য পৌঁছাল নির্বাচনে যে দল বা জোট ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা প্রধান বিচারপতি পদে ফেরার বিষটি অনুমোদন করবেন। তিনজোট রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় ফিরার অঙ্গীকারও রূপরেখায় প্রকাশ করে।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এরশাদ তাঁর ক্ষমতাবলে প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদকে অব্যাহতি দেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই উপরাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ দেন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে। তার কিছুক্ষণ পর এরশাদ নিজে পদত্যাগ করেন রাষ্ট্রপতি পদ থেকে। তখন সংবিধান অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তিনমাসের মধ্যে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন সরকার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। সেই সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সর্বসম্মতভাবে সংবিধান সংশোধন করে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় ফেরা হয় এবং প্রধান বিচারপতি পদে সাহাবুদ্দিন আহমদের প্রত্যাবর্তন বিলটি পাস হয়।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র সংগঠনসমূহের নেতারা সে সময়ে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এরশাদ পতনের পর ‘স্বৈরাচারের দালাল’ তালিকায় নাম ওঠানোর ভয় দেখিয়ে বড় বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদা নিয়ে ‘রাজপথ কাঁপানো’ ছাত্রনেতাদের সিংহভাগ হঠাৎ করে বিপুল বিত্ত–বৈভবের মালিক বনে গেলে তাদের জনপ্রিয়তা দ্রুতই তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র নেতাদের কেউই এ পর্যন্ত জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়ার সুযোগ পাননি।
২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন ছিল মূলত কোটাপ্রথা বাতিলের দাবিতে। সেটি পরে শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনে পরিণত হলে সর্বস্তরের মানুষ তাতে অংশ নেন। হাসিনার বিদায় পরবর্তী সময়ে সারাদেশে মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে ভাংচুর, দখল প্রবণতা ছড়িয়ে পড়লে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরেও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ কোত্থেকে আসছিল, কারা দিচ্ছিল সে ব্যাপারে একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের অভিজ্ঞতার ঘাটতি যেমন ছিল, তেমনি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিও পরিলক্ষিত হয় নানাক্ষেত্রে। ফলে একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি অন্তর্বর্তী সরকারকে মোকাবেলা করতে হয়। সমপ্রতি রংপুরে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বাসভবনে হামলা এবং তৎপরবর্তী মব ভায়োলেন্সের ঘটনাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী। ফলে পরিস্থিতি আর অবনতির দিকে যেতে পারেনি। খেলা দেখতে বিনা টিকেটে স্টেডিয়ামে প্রবেশে মব সৃষ্টির মত আরো কিছু ঘটনায় সেনাবাহিনীর এ ধরনের হস্তক্ষেপে জনমনে স্বস্তি লক্ষ করা গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেনাবাহিনীর উপর মানুষের আস্থার প্রতিফলন দেখা যায়। জাতীয় নির্বাচনের সময় ছাড়াও সংস্কার, ট্রাইব্যুনালের বিচার সম্পন্ন করা, জুলাই সনদ, সংবিধান সংশোধনসহ বেশ কিছু বিষয় নিয়ে মতানৈক্য তৈরি হয়েছে। তাও দূর হতে হবে রাজনৈতিক দলসমূহের মতৈক্যে, যেভাবে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনজোটের রূপরেখার মাধ্যমে অনেক কিছুর সহজ সমাধান হয়েছিল।
প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরকালে তাঁর সাথে তারেক রহমানের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে এপ্রিলে নয়, রোজার আগে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন। এটি চলমান সংকট সমাধান এবং পারস্পরিক দূরত্ব মোচনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল মনে করছে। তবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে শুধু একটি দলের নেতার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণকে নেতিবাচকভাবে দেখছে এনসিপি। সংস্কার আর বিচারকে পাশ কাটিয়ে সরকার যে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না বলে মন্তব্য করে এনসিপির মূখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী বলেছেন, এভাবে নির্বাচন হলে আরেকটি ফ্যাসিবাদের জন্ম হবে।
আন্দোলনকারী ছাত্রদের সমন্বয়ে গঠিত দলের সাথে বিএনপিসহ অন্যন্য দলের এই মতপার্থক্যও দূর হতে পারে সমঝোতার ভিত্তিতে, যা হয়েছিল অতীতে। সংকট যত বড়ই হোক তা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য।
লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।