নানা সংকট ও অস্থিরতা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা চলছে দেশের তৈরি পোশাক খাতে। এ কথা আজ অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্প। দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করতে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান অপরিসীম। বাংলাদেশ মূলত কৃষিপ্রধান দেশ হলেও জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্প স্থাপন ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। আর এক্ষেত্রে গার্মেন্টস শিল্পের অবদান অপরিসীম। এটি সময়ের দাবি। সারা বিশ্বে তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। রফতানি বাণিজ্যেও তৈরি পোশাক শিল্পের আছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বেকার সমস্যা সমাধান, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই শিল্প। এ শিল্পের হাত ধরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে পেয়েছে নতুন পরিচিতি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে এই খাত। তৈরি পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্র, সুতা, আনুষঙ্গিক উপকরণ, প্যাকেজিং ইত্যাদি শিল্পেরও ঘটেছে সম্প্রসারণ। এর বাইরেও পরিবহন, ব্যাংকিং, শিপিং এবং ইন্স্যুরেন্স সেবার চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এ খাতের অস্থিরতা কখনো কাম্য হতে পারে না। সাম্প্রতিক সময়ে আশার কথা প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। এতে জানা যায়, দীর্ঘ সময় তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতা বিরাজ করলেও এখন স্থিতিশীলতা ফিরে আসছে। কারখানাগুলোতে পুরোদমে কর্মযজ্ঞ চলছে। ক্রেতাদের মধ্যেও আস্থা ফিরে আসছে। নতুন নতুন অর্ডার আসছে। গেল পাঁচ মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে রপ্তানিও বাড়ছে। এদিকে সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের নিকট এ খাতের উদ্যোক্তাদের অনেক প্রত্যাশা। সরকার ভালোভাবে উদ্যোগ নিলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক আরও শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারবে বলে আশা তাদের। তবে স্থানীয়ভাবে বেশ কিছু সংকট এখনও রয়ে গেছে। এগুলো জরুরিভিত্তিতে সমাধান চান তারা।
এদিকে অপর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, উৎপাদন খরচ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় এই খাতের উদ্যোক্তারা মুনাফা করতে পারছেন না। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্রেতারা রফতানি হওয়া বাংলাদেশের পোশাকের দাম কমিয়েছেন প্রায় ৫ শতাংশ। আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দাম প্রায় ৮ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে।
তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দাম কমে যাওয়ার কারণে তারা উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। উদ্বিগ্ন হওয়ার একাধিক কারণ উল্লেখ করে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, পোশাকের দাম বাড়ানো না হলে বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে। নাম প্রকাশ না করে একজন গার্মেন্টস মালিক বলেন, খরচ বেড়ে যাওয়ায় নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন এবং ৯ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেওয়া তার জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। শ্রমিকদের বেতন দিতে গিয়েই তিনি হিমশিম খাচ্ছেন। এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্থিক সংকটে পড়েছে বেশিরভাগ গার্মেন্ট কারখানা এবং কিছু কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। বিশেষ করে অতীতে ভালো অবস্থানে থাকা কারখানাগুলোও এখন সংকটে পড়েছে। এই খাতের উদ্যোক্তাদের কয়েকজন বলছেন, বায়াররা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারত, পাকিস্তানসহ অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। শিল্প মালিকদের মন্তব্য– জ্বালানি সংকট, শ্রমিক অসন্তোষ ও ব্যাংক খাতের অস্থিতিশীলতা, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, গ্যাস–বিদ্যুতের ঘাটতি, বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বেশ কয়েকটি কারণে তৈরি পোশাক রফতানিতে ঝুঁকি বাড়ছে। গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা জানান, বিশ্ববাজারে সবচেয়ে বড় পোশাক রফতানির গন্তব্য দেশ যুক্তরাষ্ট্র। পোশাক রফতানি আয়ের ২০ থেকে ২২ শতাংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিন্তু বর্তমানে এই মার্কেটে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ মাসে পোশাক খাতে ১০০ কারখানা বন্ধ হয়েছে। বেকার হয়েছে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার শ্রমিক। শ্রমিকদের ঠিকমতো বেতন দিতে পারছে না অন্তত ১৫৮টি কারখানা। এদিকে ইউরোপীয় পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর–এই ১০ মাসে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দাম কমিয়েছে ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।
তবে আশার কথা হচ্ছে, এ খাতে ধীরে ধীরে অস্থিরতা দূর হচ্ছে, কাটিয়ে উঠছে সমস্ত সংকট। বিশেষজ্ঞরা বলেন, পোশাক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেক উন্নতি হয়েছে। কারখানাগুলোতে কাজের পরিবেশ ফিরে এসেছে। নতুন নতুন অর্ডার আসছে। তাঁরা বলেন, বর্তমান সরকার প্রধানের নিকট ব্যবসায়ীদের অনেক প্রত্যাশা। তাকে সারাবিশ্ব চেনে। বিশ্ব নেতারা তার পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। তাঁরা বিশ্ব নেতাদের অনুরোধ করলে তারা নতুন নতুন চুক্তিতে আগ্রহী হবে। এতে সহজে বিভিন্ন দেশে পোশাক রপ্তানির সুযোগ তৈরি হবে। তবে অভ্যন্তরীণ বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে গ্যাস–বিদ্যুতের সংকট, ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা, এনবিআরের পলিসিগত সমস্যার সমাধান জরুরি। তবে ক্রেতারা এখনও পর্যবেক্ষণ করছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে। আমরা আশাবাদী, অন্তর্বর্তী সরকার ক্রেতাদের আস্থা ফেরাতে পারবে।