আমি যখন ১৯৬৭ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি দোভাষীদের লঞ্চে করে কর্ণফুলীতে আসলাম তখন কিন্তু লঞ্চ সরাসরি ভিড়তো না। লঞ্চ এর কাছে কয়েকটা সাম্পান থাকতো। বড় জাহাজ যেমন লাইটারিজ জাহাজ এর ফ্রিডিং করে তেমনি সাম্পানে উঠেই আমরা পুরান চাক্তাই ঘাটে নামলাম। এই ঘাট কিন্তু ৩ বার চেঞ্জ হয়েছে। পুরান চাক্তাই, নতুন চাক্তাই আর ওমর আলী মার্কেট। এভাবে ৩ বার চেঞ্জ হয়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে আসা লঞ্চের যাত্রীদের নামার জন্য।
তখন চট্টগ্রাম শহর এত বেশি আরবানাইজড ও ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজড হয়নি। তবু এবসলুটলি চট্টগ্রাম ছিল ট্রেডিং এর শহর। আমি নেমেই দেখলাম যে খুব প্রাতে মানুষ গোসল করছে নদীতে। কেউ কেউ পানি সংগ্রহ করছে টিনের কৌটায়। হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর গিয়ে চোখে পড়ল বিখ্যাত নওজোয়ান অয়েল মিল। বলে রাখি সকল রাইস মিলগুলো ছিল চাক্তাই। যেখানে ধান থেকে চাল হয়ে ভৈরবসহ সমগ্র বাংলাদেশ যেতো। এখানে বড় বড় গ্রোসারি শপগুলো ছিল। এই গ্রোসারি শপগুলোতে আমাদের গোষ্ঠীর কেউ কেউ চাকরি করতো। ইলিয়াছুর রহমান রুশনীর বাবা আবুল হাশেম একটা বড় দোকানে চাকরি করতেন।
লঞ্চ থেকে নেমে আর কিছুদূর গেলেই দেখতে পাওয়া যায় গরুর গাড়ি বসে আছে। তখন সড়ক পথে যানবাহনের প্রধান মাধ্যম ছিল গরুর গাড়ি। আমাদের গ্রামের আমীর আলি বলে একজন গরুর গাড়ির চালক ছিল। এই যে ওমর কায়সারদের মনসা স্টোর এটা তখনকার দিনে বিখ্যাত দোকান ছিল। মনসায় চালের ব্যবসা ছিল। সিআই শীড এর সেসময় ও ব্যবসা হতো। সিআই শীড মানে টিন। তখন খুব দামী ছিল। তখন দেশে ইন্ডাস্ট্রি হয়নি বিদেশ থেকে সিআই শীড আমদানি করা হতো।একটু ডানে পার হয়ে একটা ব্রিজ। চাক্তাই এর পরে একটা বিটলিগঞ্জ আছে, এরপরে চলে গেছে কোরবানিগঞ্জ।
খাতুনগঞ্জে আসলেই আমি একবার দেখা পাই বিরাট রেস্টুরেন্টের একজন পারসেল আমাদের গ্রামের লোক। খুব সুগন্ধি মাখিয়ে সকালে তিনি হাঁটছেন। খাতুনগঞ্জের আমিন মার্কেটে যারা থাকতো তারা বেশিরভাগ ব্রোকার এবং মুৎসুদ্দি ছিল। তাদের কাছে পাসবুক থাকতো সেগুলো বিক্রি করতো। তারপর হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পাই দাদা লিমিটেড এর দোকানগুলি। বাঙালিদের তেমন একটা দোকান ছিল না বেশিরভাগই বিহারিদের। ইলিয়াস ব্রাদার্স এর এজেন্সি, আদম লিমিটেড, দাদা লিমিটেড, বোষ ব্রাদার্স এর অফিস ফেলে এলে ড. ইউনূস /হাজী দুলামিয়া সওদাগরের দুইটা জুয়েলারি দোকান ছিল। তারপর কোরবানিগঞ্জে এসে মফজল সওদাগরের একটা দোকান ছিল ওরা রমনা সিগারেট, আজিজ বিড়ির এজেন্ট ছিলেন। কাঁচাবাজার এর জন্য বকশীর হাট বিখ্যাত ছিল। সেখানে জমজমাট বাজার ছিল।
বদর শাহ‘র মাজার, শাহ আমানত শাহ‘র মাজার ছিল কাছাকাছি দূরত্বে। পীর আউলিয়ার মাজার হিসেবে জানি পরে। একই এলাকায় একটা সমুদা হোটেল ছিল। এই হোটেলের লুচি আর ভাজি এত মজার ছিল যে আমার মুখে এখনো স্বাদ লেগে আছে। আশেপাশেই ওপেন গাঁজা আর আফিমের দোকান ছিল। লালদিঘির পাড়ে তেমাথায় যেখানে সোনালী ব্যাংক মুসলিম লীগার সৈয়দ আহমদ সাহেবদের বারও ওপেন ছিল। আইয়ুব খান এর আমলে বারে গাঁজা, মদ, আফিম বিক্রি হতো। বার সদরঘাটেও ছিল। তার কাছাকাছি ছিল বেশ্যা পাড়া। এসব মূলত নাবিকদের মনোরঞ্জন এর জন্য। লঞ্চে যারা ল্যান্ড করতেন দেশি–বিদেশি তারাও যেতেন।
চট্টগ্রাম এর অন্যতম বস্ত্র সরবরাহ এর বড় বাজার হচ্ছে টেরিবাজার। তখন থেকেই চট্টগ্রাম বিভাগের প্রায় সব জেলায় বস্ত্র যেতো এখান থেকে। টেরিবাজার ফেলেই বিখ্যাত আন্দরকিল্লা মোড়। আন্দরকিল্লা মোড়কে বলি ‘আমার হৃদয়ের রাজধানী‘। আন্দরকিল্লাকে সার্কেল করে ঘাটফরহাদবেগ, সাব–এরিয়া, খলিফাপট্টি, রাজাপুকুর লেইন এসব জায়গায় আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে।
রিজোয়ান মাহমুদ সামপ্রতিক সময়ে আমার জন্মদিনে লিখেছেন আমি ঘরকুনো, হোমসিক। আমি গ্রামের জন্য যেভাবে কেঁদেছি ঠিক সেভাবেই আন্দরকিল্লার জন্য কাঁদি। এই আন্দরকিল্লায় দুইটা দামী রেস্টুরেন্টই ছিল বিহারিদের। একটা হচ্ছে দ্যা ম্যাজেস্টিক আরেকটা হচ্ছে আজমীর হোটেল। যারা পয়সাওয়ালা লোক তারা ওখানে নাস্তা করতে পারতো। আরেকটা ছিল কদম মোবারক লেইনের অপজিটে দস্তগীর হোটেল। এখানে তেহারি নেহারির জন্য এখনো বিখ্যাত। তখনো আমি দেখেছি মুসল্লীরাই শেষ করে ফেলতো।
আন্দরকিল্লা ছিল সংবাদের তীর্থস্থান। লালদিঘি পাড়ে কোনো মিটিং মিছিল হলে খবর আসতো আন্দরকিল্লা মোড়ে, কোনো পত্রিকা বের হলে, টেলিগ্রাম বেরুলে, ঊনসত্তর এ কোনো শ্রমিক নেতা মারা গেলে, ছয় দফা আন্দোলনের সব খবর–ই আসে সেখানে। আমি খবরাখবর জানার জন্য খুব শঙ্কা এবং আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম আন্দরকিল্লা মোড়ে। আমার জীবনের প্রায় পঞ্চাশ বছর কেটেছে আন্দরকিল্লাকে ঘিরে।
চেরাগী ছিল আমাদের অনন্য প্রিয় জায়গা। এখানেই অবস্থিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদী’। এই পত্রিকা তখন আমাদের প্রিয় ছিল এবং পড়তাম।
আমি যেটা বলছিলাম চট্টগ্রাম শহরকে ট্রেডিং এর শহর কেন বলছি? কারণ ট্রেড এর সবচেয়ে বড় জায়গা ছিল এটি। সব অয়েল মিল, রাইস মিল, সিআই শীড আমদানি, বিহারিদের কাছে ইন্ডাস্ট্রি এবং ব্যবসা, বৃহৎ বস্ত্র মার্কেট, বৃহৎ খাদ্যের বাজারসহ চট্টগ্রাম বিভাগের চাহিদা পূরণ করে এমন সব পণ্যের কেনাবেচার জায়গা এই চট্টগ্রাম শহর।
চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা : জার্মান কনফেডারেশন অব স্মল বিজনেস/টেকনো এশিয়া, সিঙ্গাপুর–এর যৌথ প্রজেক্ট রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট থেকেই আমাদের মেলা। এই প্রজেক্ট থেকে আমাদের ৬৪ সাবজেক্ট এর ট্রেনিং, ১২০ টি ‘পদক্ষেপ’ ম্যাগাজিন বের করা এবং বিজনেস ডেভেলপমেন্ট সেন্টার করার কাজ শুরু হয়েছিল।
টেকনোলজি এক্সপজিশন বিষয়টি নিয়ে সেক্রেটারি মাহমুদুল হক চৌধুরী সাহেবকে আমি বললাম, ‘স্যার টেকনোলজি এক্সপজিশন’ মানে মনে হয় কোনো প্রযুক্তির প্রদর্শন। পরে আমি ঢাকায় কথা বললাম এই ব্যাপারে। তারা বললেন, আমরা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দেশীয় পণ্যের এক্সিবিশন করার জন্য একটা মেলা হবে। সেই হিসেবে আমি নামকরণ করলাম ‘চট্টগ্রাম শিল্পপণ্য মেলা’।
ইঞ্জিনিয়ার আলী আহমদ এর সময়ে আমাদের প্রথম চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা শুরু করি সিজেকেএস জিমনেসিয়ামে মাত্র ৩৭ টি স্টল নিয়ে। ৬ আগস্ট ১৯৯২ সালে মেলার উদ্বোধন করেন তৎকালীন বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমান। তিনদিনের এই মেলার ক্লোজিং করেন জহির উদ্দিন খান। মেলার শেষ সময়ে তিনি যখন কনক্লুশন ভাষণ দিচ্ছেন সেসময় ক্রেতা– বিক্রেতার অনুরোধে আরো দুইদিন সময় বাড়িয়ে দেন। মাইকে আমার নাম উচ্চারণ করে ঘোষণা দেন, অতিরিক্ত সচিব ওসমান গণি চৌধুরী এই মেলার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন তার সুবাদে আমরা আরো দুইদিন মেলার সময় বাড়ালাম। এটা শোনার সাথে সাথে আমি খুব শিহরিত হলাম। সেদিন রাত একটায় দৈনিক আজাদী অফিসে গিয়ে চিফ রিপোর্টার শ্রদ্ধেয় ওবায়দুল হক সাহেবকে মেলার সময় বৃদ্ধির নিউজটা জানাই।
১৯৯৮ পর্যন্ত এই মেলা জিমনেসিয়াম এর ভেতর এবং বাইরে উভয় স্থানেই করেছি। থাইল্যান্ডসহ আমাদের অনেক পার্টনার কান্ট্রিও জয়েন করতো মেলায়। ১৯৯৮–১৯৯৯ সালে চট্টগ্রাম পলোগ্রাউন্ড মাঠে মেলার স্থানান্তর করি। আরো বড় এবং ব্যাপকভাবে এই মেলার কার্যক্রম, প্রচার, প্রসার সবকিছু হয়। পলোগ্রাউন্ড মাঠ তখন ডার্ক স্পট ছিল। রাস্তায় লাইট ছিল না, দিনে দুপুরেও চুরি ও ছিনতাই হতো, একদিকে রেলওয়ে ওয়াগন ছিল। মানে এই ধরনের একটা রিস্কি জায়গায় মেলা করাটা খুবই টাফ এবং চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমার বোর্ড আমাকে প্রশ্ন করেছিল ‘আপনি পারবেন কিনা’। আমি বলেছিলাম, ইনশাআল্লাহ স্যার পারব। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী স্ট্রিট লাইটের ব্যবস্থা করে দেন পানির ব্যবস্থা করে দেন। সেখানেই আমি সর্ব প্রথম চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা করি।
তারপরের ইতিহাস তেইশটি মেলা আমি আয়োজন করি। তেইশটি মেলার ব্যবস্থাপনা, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, তদারকি আমি করতাম। সারাদিন চেম্বারে অফিস করতাম অফিস শেষ করে মেলায় চলে যেতাম। কোনো দুর্যোগ কিংবা সমস্যা হলে রাত একটা–দুইটা পর্যন্ত সেখানে থাকতাম অথবা যেকোনো সময় ছুটে যেতাম।
সিআইটিফকে কেন্দ্র করে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইপিক হেলথ কেয়ার, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, সন্ধানী এবং রাইট একশন ফর ডিজএবিলিটি–র্যাড রক্তদান কর্মসূচী, প্রতিবন্ধী ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এর জন্য ৮–১০ টি বিনা ভাড়ায় বরাদ্দ রাখার ব্যবস্থা করতাম। সে দোকানগুলোর ক্যাশমূল্য ছিল এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকা। এছাড়াও মেলায় আগত দর্শনার্থী এবং অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের জন্য ফ্রি অস্থায়ী চিকিৎসা ক্যাম্প স্থাপনসহ ডিজিএফআই, এনএসআই, এলিট ফোর্স র্যাব, পুলিশ সদস্যবৃন্দ, প্রাইভেট সিকিউরিটি এবং সিসিটিভি এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ মেলা এলাকায় নিরাপত্তা বলয় তৈরীর প্রক্রিয়াও করা হয়েছে। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনার জন্য সবসময় একটিভ থাকতো ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। ২০০২ সালে এসে ওমেন এন্টারপ্রনারদের জন্য একটা বড় প্লেইস আমরা বিনামূল্যে দিয়ে দিই।
সেখানে এক গভীর রাতে ভিজিট করতে গিয়ে দেখি থামি পরা এক নারী দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি হলেন মনোয়ারা হাকিম আলী। এই সাহসী নারী বড় বড় মিটিং বা অনুষ্ঠানে এখনো বলেন, ‘ওসমান ভাইয়ের সহযোগিতায় আমি ওমেন ট্রেডবডিতে এসেছি’। তিনি আমাদের স্ট্যান্ডিং সাব কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। পরবর্তীতে চিটাগং ওমেন চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট হন। জেডডিএইচ/টিএ এর দুজন মানুষের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি একজন সরকারের যুগ্ম সচিব ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান। তিনি দীর্ঘ এক দশক ধরে জেডডিএইচ/টিএ এর বাংলাদেশের কো–অর্ডিনেটর হিসেবে আমাদের গার্ডিয়ানশিপ দিয়েছেন। অত্যন্ত বিবেচক লোক ছিলেন এবং আমাকে পছন্দ করতেন। অন্যজন হচ্ছে হে কু জি ওয়েশ্চ তিনি সিঙ্গাপুর অফিসে বসতেন। টেকনো এশিয়ার শাহাবুদ্দিন নামে একজনও বসতেন। সিঙ্গাপুর অফিসে দেখেছি সেই ছোট অফিসে তারা নিজেরা কফি বানিয়ে পান করছে। সিঙ্গাপুরে একটা সেমিনারে আমি পার্টিসিপেট করি ও পেপার প্রেজেন্ট করি।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার; সাবেক সচিব, চট্টগ্রাম চেম্বার।