ষাট দশকের ছাত্র-আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ

মুহাম্মদ তাহের আলমদার | সোমবার , ২০ নভেম্বর, ২০২৩ at ১০:১৫ পূর্বাহ্ণ

পূর্ব প্রকাশিতের পর

২৫শে মার্চ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ঐ দিন আমি সকাল ১০/১১টার দিকে আন্দরকিল্লা আওয়ামীলীগ অফিসের উত্তরদিকে বন্দুকের দোকানের সামনেই ছিলাম। শহরের মানুষজন যেন চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন পার করছে। থমথমে অবস্থা, মনে হল যেন কিছু একটা নির্দেশনার অপেক্ষায় সমগ্র জনগণ। পরের দিন ২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণার কথা এম. . হান্নান প্রচার করেছিলেন। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ২৫শে মার্চ থেকে চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত সারা বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক সর্বস্তরের মানুষ মুক্তির লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২৬ ও ২৭শে মার্চ ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ সশস্ত্র বাহিনীর অভাবনীয় বিদ্রোহ এবং গণমানুষের অসীম উৎসাহ, অপরিমেয় তেজ ও অদম্য সাহসে সশস্ত্র সংগ্রামের যে অগ্নিশিখা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তা ইতিহাসে বিরল। চট্টগ্রাম শহরে মেজর রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ইপিআর বাহিনীর সেনারা শুরু থেকেই হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায় এবং শহরের বিভিন্ন অংশে সংঘর্ষ অব্যাহত রাখে।

এদিকে চট্টগ্রামের অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সশস্ত্র বিদ্রোহ পরবর্তীতে চট্টগ্রাম শহর থেকে সেনারা দক্ষিণ চট্টগ্রামের দিকে অর্থাৎ কালুরঘাট ব্রিজের দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থান নেওয়া শুরু করে। কক্সবাজার ও রামগড় থেকে ইপিআরসহ বাঙালী সেনারাও এতে যোগ দেয়। ৩০শে মার্চের পর থেকে ১৬ এপ্রিল সকাল পর্যন্ত পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম ছিল কার্যত শত্রুমুক্ত, তথা স্বাধীন। এলাকায় ও সর্বত্র দোকানপাটে তখনও উড়ছিল বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পটিয়া কলেজে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সশস্ত্র বাহিনীর বেশকিছু সেনাদলের অবস্থান ছিল। অবস্থানরত রেজিমেন্ট সেনাদের খাদ্যের রসদ যোগানোর জন্য বিভিন্ন হাটবাজার থেকে আমরা পর্যাপ্ত চাউলডালসহ সকল খাদ্য উপকরণের ব্যবস্থায় নিয়োজিত ছিলাম। মনে পড়ে আলমদারপাড়ার মরহুম তহসিলদার আবু ছৈয়দ তালুকদারের কথা। তিনি স্থানীয় অলির হাট থেকে খাদ্যের রসদ নিয়ে ক্যাম্পে পাঠাতেন।

এদিকে কালুরঘাট সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে দক্ষিণ চট্টগ্রামে হানাদার বাহিনীর অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে নিয়োজিত বাঙালি সেনা ও সহযোদ্ধাদের উপর পাকিস্তানী বিমান ও পদাতিক বাহিনী ১১ই এপ্রিল সকালে কালুরঘাট এলাকায় প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে। এতে কয়েকজন বাঙালি সেনা ও সহযোদ্ধা আহত হন। এ পর্যায়ে অস্ত্রগোলাবারূদসহ শক্তির দিক দিয়ে দুর্বল মনে হওয়ায় অনেকে চলে যান রামগড়ের দিকে ও পটিয়ায়। কালুরঘাট এলাকার প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ায় পটিয়া সদর ও আশপাশে অবস্থানরত বাঙালি যোদ্ধাদের এলাকা থেকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে হয়।

এরই মধ্যে পাকিস্তানী সৈন্যরা কালুরঘাট সেতু ও কর্ণফুলী নদী হয়ে বোয়ালখালীপটিয়া সীমান্তের মিলিটারিরপুল এলাকায় অবস্থান নেয় এবং বিভিন্ন বাড়িঘরে হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাকিস্তানী বাহিনীর ধারণা ছিল, পটিয়ায় বাঙালি যোদ্ধাদের বড় ঘাঁটি রয়েছে। পটিয়া ও দক্ষিণ চট্টগ্রাম দখলে নিতে হয়তো প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে ১৬ই এপ্রিল, শুক্রবার, জুমার দিন পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর জন্য চরম বিভীষিকাময় একটি দুর্বিষহ ও দুঃখ ভরাক্রান্ত দিন হয়ে নেমে আসে। সেদিন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর জঙ্গি বিমান বহর পটিয়া সদরে দুই দফায় আকস্মিক বোমা হামলা ও মেশিন গানের এলোপাথারি গুলি চালায়। এতে প্রায় ২০জন নিরীহ লোক শহীদ ও অর্ধশতাধিক আহত হন।

প্রথম দফা হামলা চলে সকাল প্রায় ১১টায়। এখবর পাওয়া মাত্র আমি আলমদারপাড়া নিজ বাড়ি থেকে পটিয়া সদরে পৌঁছার পর দেখি সবাই নিরাপদ স্থানে সরে যায়। আমিও যেন নিরাপদ আশ্রয়ে থাকি, সেজন্য আমাকে বারবার বলা হচ্ছিল। তখন তাড়াহুড়া করে জুমার নামাজ আদায়ের জন্য পায়ে হেঁটে পটিয়া মাঝের ঘাটা জামে মসজিদে গমন করি। বেলা প্রায় একটার পর, মসজিদে তখন জুমার নামাজের জন্য মুসল্লিরা প্রস্তুত, আল্লাহু আকবর বলে নিয়ত বাঁধার মুহূর্তে হানাদার বাহিনী দ্বিতীয় দফা বোমা হামলা শুরু করে।

এরকম জুমার সময় আবারো নিষ্ঠুর বোমা হামলা ও গুলির তাণ্ডবে চারদিকে হাহাকার, পাঁচছয় মিনিটের বর্বর তাণ্ডবে সব ওলটপালট হয়ে যায়। দ্রুত নামাজ শেষে বেরিয়ে পড়ি। লোকজনের আহাজারিতে থানামোড়, কলেজ রোড, পিটিআই রোড, স্টেশন রোর্ডসহ আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে যায়। চারদিকে ভয়ানক আর্তনাদ, আতঙ্ক, হাহাকার; যে যেদিকে পারছে ছুটছে এদিকসেদিক। বোমার আঘাতে ভস্মীভূত হয় থানা মোড়ের আজিজিয়া কুতুবখানাসহ বেশকয়েকটি লাইব্রেরি ও দোকানপাট। বোমা হামলা ও গুলিতে থানার মোড়ে নিজ চেম্বারে অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান হাইদগাঁও গ্রামের অশীতিপর হোমিও চিকিৎসক ছৈয়দ আহমদ ও তাঁর একজন রোগী। লোকজন বুঝতে পারছিল, পাকিস্তানী হানাদার বিমান বাহিনী এ আক্রমণ চালাচ্ছে। ওই দিনই হানাদার বাহিনী পটিয়ার দিকে অগ্রসর হয় এবং পটিয়া তাদের দখলে চলে যায়।

এরপর থেকে পাকিস্তানী ঘাতক বর্বর সৈন্য বাহিনীর কুদৃষ্টি পড়ে যায় গ্রাম বাংলার দিকে। চোখে দেখা চিহ্নিত লুঠেরাদেরকে কারো কিছু বলারও সাহস ছিলো না। এদিকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ছনহরা গ্রামে এক সঙ্গে ১১জন নিরীহ গ্রামবাসীকে ব্রাশফায়ারে হত্যা এবং হিন্দু সমপ্রদায়ের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার বিভীষিকাময় দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। এই পরিস্থিতিতে এলাকায় ও পটিয়ায় ছাত্র, যুব ও সর্বস্তরের মানুষদের সংগঠিত হবার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার এবং তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান ও প্রচেষ্টা আমরা অব্যাহত রাখি। এই ধারাবাহিকতায় ছাত্র ও যুব সমাজের অনেকে ভারতে চলে যায় এবং বিভিন্ন ক্যাম্পে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এদিকে আমার স্নেহময়ী অন্ধপ্রতিবন্ধী অসুস্থ মাকে ফেলে ভারতে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না হলেও মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ছিলাম প্রতিটা মুহূর্তে।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, আমি তখনকার দিনে সম্মিলিত ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১দফা ও আওয়ামীলীগের ৬ দফা সহ ৬৯র গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত পটিয়ায় ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসাবে এবং পরে থানা কমিটির সদস্য ও ১৯৭০৭১ সালে ছনহরা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সহসম্পাদক এবং একজন সচেতন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে দেশের স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রপ্রস্তুত ও প্রকৃত সংগঠকের দায়িত্ব পালনসহ ভারত ফেরৎ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধের ময়দানে সহায়তা ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখি।

মনে পড়ে, শহরের খাতুনগঞ্জ ও চান্দ মিয়া লেইনে ঢোকার পথে রাত তিনটার সময় শক্তিশালী গ্রেনেড চার্জের সময়ও সহায়তায় ছিলাম এবং চট্টগ্রাম শহর ও পটিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের ভ্রাম্যমাণ সহকারী যোদ্ধা হিসাবে দায়িত্বরত ছিলাম। এদিকে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে যারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিজ দেশে পরবাসীর মত ছিল, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল আতঙ্কের, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হিংস্র আক্রমণ ও গোলাগুলির তাণ্ডবে মানুষ ছিল দিশেহারা, এমন একটা সময় কক্সবাজার রুটের বাসে করে শহরে আসার পথে কালুরঘাট ব্রীজের দক্ষিণ পাড়ে হানাদার সৈন্য বাহিনী সবাইকে বাস থেকে নামিয়ে লাইনে দাঁড়াবার জন্য বলে (আমিও সে বাসে ছিলাম)। নাম, পিতার নামসহ শারীরিক চেকআপে (তাদের ভাষায়) মালাউন বা হিন্দু লোক সন্দেহে যুবকদের লাইন থেকে আলাদা করা হয়।

খবর নিয়ে পরে জানতে পারি, বেছেবেছে বেশ কয়েকজনকে নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যার পর নদীতে ফেলে দেয় পাকিস্তানি হানাদারেরা। আমার নিজ গ্রামের উত্তর পাশে পালপাড়া নামক গ্রামের এক সুন্দর সুপুরুষ ছিল, (নাম মনে পড়ছে না) সবেমাত্র ১মাস আগে তার বিয়ে হয়। চট্টগ্রাম নিউ মার্কেটের কাপড়ের দোকানের সেলসম্যান ছিল সে। কালুরঘাট ব্রীজের নিচে তারও একই অবস্থা হয়। আর কর্ণফুলিতে ফুলেফেঁপে কতো লাশ যে দেখতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। এভাবে প্রতিনিয়ত মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে (মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস) চট্টগ্রাম শহর, পটিয়া ও গ্রামে যাওয়াআসার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সব কর্মকাণ্ডের সাথে থাকতে হয়েছে আমাকে।

লেখক: ষাট দশকের ছাত্রনেতা

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাষার শক্তি দেখে বিস্মিত হই
পরবর্তী নিবন্ধফিলিস্তিন বন্ধুদের জন্যে সহমর্মিতা ও সংহতি