পরাধীনতার অর্গল ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাড়ে পাঁচ দশক হতে চললেও এ দেশের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে ‘ষড়যন্ত্র থেমে নেই’ মন্তব্য করে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, কারও রক্তচক্ষু বাঙালি জাতি কোনোদিন মেনে নেবে না। প্রয়োজন হলে বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতি দেশের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব–সম্মান রক্ষা করবে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পূর্তির প্রাক্কালে গতকাল সোমবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ কথা বলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, এই ভূখণ্ড যুগ যুগ ধরে ঔপনিবেশিক শক্তির লক্ষ্যবস্তু ছিল। নানা সময়ে বিদেশি শক্তিরা এদেশ নিজেদের কব্জায় নিয়ে শাসন করেছে, সম্পদ লুট করেছে, শোষণ করেছে। কোনোদিনই বাঙালি পরিপূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম আর ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন–সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণভাবে মুক্তিলাভ করে।
শেখ হাসিনা বলেন, কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমাদের এই স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্বকে খর্ব করার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র আজও থামেনি। ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও ওঁত পেতে বসে আছে কীভাবে বাংলাদেশের অগ্রসরমান অভিযাত্রাকে স্তব্ধ করা যায়। একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও পঁচাত্তরের ঘাতক এবং তাদের দোসররা এখনও তৎপর রয়েছে পরাজয়ের বদলা নিতে। সুযোগ পেলেই তারা আঘাত হানবে। তাদের সামনে একমাত্র বাধা আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগকে ছলে–বলে–কৌশলে নিচিহ্ন বা দুর্বল করতে পারলেই পরাজিত শক্তির উত্থান অনিবার্য। কাজেই কান্ডারী হুঁশিয়ার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালি বীরের জাতি। যুদ্ধ করে আমরা এদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়– জাতির পিতা নির্দেশিত এই বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করেই আমরা দেশ পরিচালনা করি। আমাদের কোনো প্রভু নেই, আছে বন্ধু।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারও আওয়ামী লীগের ওপর ‘আস্থা রাখায়’ দেশের নাগরিকদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য, যে উন্নয়ন–অগ্রগতি আমরা এখন পর্যন্ত সাধন করেছি, তা আরও এগিয়ে নিয়ে বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত–সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। যে বাংলাদেশ হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা–দারিদ্র্য–মুক্ত অসামপ্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ।
জাতির উদ্দেশে তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫৪তম দিবসে আসুন, সকল কূট–কৌশল–ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন–অগ্রযাত্রাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাই।
দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেকাংশে পূরণ করেছি : ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে পঞ্চমবারের মত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার প্রসঙ্গ ধরে তিনি বলেন, দেশবাসীর প্রতি আমার কর্তব্য হিসেবে এবং আমার পিতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার কাজ আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমি বার বার এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি। আমি চেষ্টা করেছি সকলের সমর্থন এবং সহযোগিতা নিয়ে এদেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের মাধ্যমে তাদের মুখে হাসি ফোটাবার। আজকে ২০২৪ সালে স্বাধীনতার ৫৩তম বার্ষিকীতে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, আমরা দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেকাংশেই পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি।
কুসমাস্তীর্ণ ছিল না : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসকের ক্ষমতাগ্রহণ এবং যুদ্ধ–বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জাতির পিতার নেওয়া সকল কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ার কথা প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে তুলে ধরেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর দেশকে আবার উন্নয়নের মহাসড়কে তুলতে যা যা করা হয়েছে, সবিস্তারে তার বিবরণ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আপনাদের ম্যান্ডেট নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিগত পনের বছরের অধিক সময় ধরে সরকার পরিচালনা করছে। এই পনের বছরের অভিযাত্রা একেবারেই কুসমাস্তীর্ণ ছিল না।
হতে হবে অতন্দ্র প্রহরী : শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ছয় বছর নির্বাসনে কাটিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করতে গিয়ে তাকেও বার বার মৃত্যুর মুখোমুখি এবং কারাবন্দি হতে হয়েছে। তাকে হত্যার জন্য কমপক্ষে ১৯ বার সশস্ত্র আক্রমণ চালানো হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাজারও শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্র বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কখনই ভুলুণ্ঠিত হতে দেবে না। উচ্চ আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পথ আমরা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছি। দেশের সকল গণতান্ত্রিক দল এবং সাধারণ মানুষকে গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার জন্য অতদ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের সংবিধানই গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেওয়া ও সমুন্নত রাখার সর্বোচ্চ রক্ষাকবচ। সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে বা পদদলিত করে কোন কিছু করার চেষ্টার অর্থ হচ্ছে গণতন্ত্রকে খর্ব করা।