ষড়ঋতুর চাটগাঁইয়া গান

নাসির উদ্দিন হায়দার | সোমবার , ২১ অক্টোবর, ২০২৪ at ১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ

(প্রথম পর্ব)

ঝর পরেদ্দে লোচা রে

উজান উডের কই,

এনঅ বরিষার কালে

থাইক্কুম কারে লই (আঁই)

এখন চারদিকে কাশফুলের সৌরভ। ক্যালেন্ডারের পাতায় বর্ষা বিদায় নিলেও কদিন আগেও প্রকৃতি ছিল বর্ষণমুখর। তবে এখনো শারদপ্রভাতে হঠাৎ আকাশের মন ভার হয়, বারি বর্ষণ হয় বিরহী নারীর চোখের জলের মতই।

হ্যাঁ, বিরহী নারীর কথাই বলছিলাম। মুষলধারে বৃষ্টি হলে, সেই বৃষ্টিতে জলা ছেড়ে যখন ডাঙ্গায় লাফিয়ে ওঠে কই মাছ, তখন বিরহী নারী আকুল হন উপরের গানের মতোই এমন ঘনঘোর বরষায় একাকী ঘরে কারে নিয়ে থাকবে সে? তাইতো কণ্ঠে ঝরে পড়ে সুরধারা।

বাড়ির পিছে ঝিঙার ক্ষেতি

টুনি পঙ্খীর বাসা

দিনত খায় চরিবরি রে

রাইতে ফিরি আসা রে।।

টুনি পাখি সারাদিন ‘চরেবরে’ রাতে বাসায় ফিরে আসে, কার টানে আসে? বন্ধুর কেন মনে থাকে না তার জন্যও ঘরে কেউ একজন দীর্ঘ অপেক্ষায় আছে! বন্ধুবিহীন ঘরে অবলা নারীর যে কত ভয় জাগে!

এক মাসর লাগিরে গেলা

বছর পার অই যার,

বনর বাঘে ন খায় আঁরে রে

মনর বাঘে খার।।

কন সাঁয়রের কূলত যাই

আছ রে লুকাই (বন্ধুরে)

কত শত ভ্রমর আসি

বইসত চায় আঁর ফুলত রে।।

এক মাসের জন্য পরবাসে গিয়েছিল বন্ধু, বছর পার হলেও তার আসার নাম নেই। এখানে ফুলবনে যে কতশত ভ্রমরের আনাগোনা, সেটা কি বন্ধু জানে!

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান বা চাটগাঁইয়া গানের একটি সমৃদ্ধ ধারা হলো ষড়ঋতুর গান। ষড়ঋতু নিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় অনেক জনপ্রিয় গান রচিত হয়েছে। বিশেষ করে গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতকাল নিয়ে সবচেয়ে বেশি গান রচিত হয়েছে। এসব গানে প্রকৃতির রূপববৈচিত্র্য যেমন চিত্রিত হয়েছে তেমনি চট্টগ্রামের মানুষের জীবনধারা, সুখদুঃখ, প্রেমভালোবাসা এমনকি আকালের কথাও এসেছে।

আষাঢ় শ্রাবণ মানেনা তো মন

ঝরো ঝরো ঝরো ঝরো ঝরেছে,

তোমাকে আমার মনে পড়েছে

তোমাকে আমার মনে পড়েছে।।

লতার কণ্ঠে এই গানটির ভাষা বাংলা। নীনা হামিদের কণ্ঠে ‘আষাঢ় মাসের বৃষ্টিরে/ ঝমঝমাইয়া পড়ে রে/বন্ধু আমার রইলো বৈদেশ গিয়া’ গানের ভাষাও বাংলা। কিন্তু ‘ঝর পরেদ্দে লোচা রে লোচা’ গানটি রচিত হয়েছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়। গানের ভাষা যাই হোক না কেন আষাঢ়শ্রাবণে একেলা নারীর যে বেদনা,সেটার ভাষা কিন্তু একটাই। এবার ষঢ়ঋতুর গান প্রসঙ্গে।

আস্কর আলী পণ্ডিত (১৮৪৬১৯২৫আনুমানিক) চাটগাঁইয়া গানের একজন মহাজন। তিনি মূলত মরমী ঘরানার বাংলা লোকগীতির স্রষ্টা। কালক্রমে আস্কর আলীর পুঁথিকাব্যের অনেক পদ এই অঞ্চলে গীত হিসাবে দারুণ সমাদৃত হয়েছে। তাঁর ‘পঞ্চসতী প্যারাজান’ কাব্যের ‘গীত বারমাস’ পর্বে শামলা সখী ছয় ঋতুর প্রতি মাসেই সখাকে পেতে চায় নবরূপে। সখার দর্শনঅদর্শনে সখীর যে আনন্দবেদনা তা চিত্রিত হয়েছে রঙ্গেঢঙ্গে।

মাঘেত শীতের জ্বালা যে নারীর্ত্তে জরের পালা

দিশা হা্‌ইরাইলে নিশা খাইব।।

যুবক নারী আশা করে নৌকায় চরিয়া বন্ধু আইব।।

আস্কর আলী পণ্ডিতের গীত বারমাস শুরু হয়েছে মাঘের ‘শীতের জ্বালা’ দিয়ে, শেষ হয়েছে পৌষ মাসে সখাকে আঁচলে বাঁধার কিংবা নিজেই বাঁধা পড়ার আশা নিয়ে।

পুশেত হেমন্ত বলি

যুবক নারীর কমল কলি

আঞ্চলে বাঁধিলে সুশী যাইব। (আস্কর আলী পণ্ডিত: একটি বিলুপ্ত অধ্যায়শামসুল আরেফীন)

ছয় ঋতুর মধ্যে শীত নিয়েই বোধহয় সবচেয়ে বেশি আঞ্চলিক গান রচিত হয়েছে। শীতকাল নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় গানটির রচয়িতা কালজয়ী সঙ্গীতজ্ঞ আব্দুল গফুর হালী। আঞ্চলিক গানের রানী হিসেবে খ্যাত কল্যাণী ঘোষের কন্ঠে গানটি চার যুগ ধরে সমান জনপ্রিয়।

শীতর ডরে বুইজ্জা গোছল ন গরে

১০টা বাজি গেলেও বুইজ্জা কেঁথা ন ছারে।।

(সূত্র : আবদুল গফুর হালীর চাটগাঁইয়া গান শিকড়, সম্পাদনা : মোহাম্মদ আলী হোসেন সোহাগ)

আবার আঞ্চলিক গানের রাজা হিসেবে খ্যাত সঞ্জিত আচার্যের গানটিও দারুণ জনপ্রিয়

এন গরি ক্যা শীত পরে

বন্ধু আঁর নাই ঘরে,

ফুলর চাদর বিছাই গইল্যাম

ফুলেরই বিছানা

ও সোনা বন্ধুরে তোঁয়াল্লাই মন দিওয়ানা।।

ছোটবেলায় কক্সবাজার অঞ্চলের জনপ্রিয় শিল্পী ‘ও কালা চাঁন গলার মালা’ গান খ্যাত বুলবুল আক্তারের কণ্ঠে শুনেছিলাম একটি গান

আঁত্তুন ও ভাই পেট পুরেদ্দে শীতর লাই

শীতকাল বঅর আরামর দিন

হক্কল কিছুর মজা থায়।।

এক মজা কেঁথার তলে ওম

বুইজ্জাবুড়ি সুখে যায় দে ঘুম,

আরেক মজা ধুই পিডা

যদি রসত বুরাই হাই।।

চাঁটগাইয়া গানে গ্রীষ্ম এসেছে নানা রঙেঢঙে। এম এন আখতার চাটগাইয়া গানের একজন মহাজন। তাঁর গানে বৈশাখজৈষ্ঠ এসেছে মধুর ও প্রেমঅনুষঙ্গে।

চৈত বৈশাখ খরানে

ঘুম ন ধরের তুই সোন্দরীর

বিছইন বিনে।। (সূত্র : মানবদরদী সুরধাক এম এন আখতারের গান)

আঞ্চলিক গানে গ্রীষ্ম ঋতু এসেছে মর্সিয়া ক্রন্দন হিসেবেও। কারণ গ্রীষ্ম শুধু গেলায় ধান ভরার মৌসুম নয় এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও সময়, এই সময় বেশ ঝড়তুফান হয়, মানুষ নিদারুণ কষ্টে পড়েন।

শতবর্ষ ধরে ঝড়তুফান নিয়ে অসংখ্য আঞ্চলিক গান রচিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে পুরনো গানটির রচয়িতা কবিয়াল রমেশ শীল। তাঁর একটি গান এমন

মিরসরাই সীতাকুণ্ড, ডুলাজারায় অদ্ভুত কাণ্ড

যারা কূলের কূলবালা, বৌঝিয়ারি লজ্জাশীলা

নিষ্কলুষ নিষ্পাপ যারা, আগে মরিল তারা

কোন বিধির বিধানে।।

( ১৯৬৩ সালের তুফানের কবিতা : রমেশ শীল)

এক্ষেত্রে চাটগাঁইয়া গানের আরেক লিজেন্ড সৈয়দ মহিউদ্দিন রচিত নিচের গানটিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর কিভাবে নতুন জীবনের সূচনা হয় তা উল্লেখ করা হয়েছে অপূর্ব শব্দ ও ছন্দে।

গর্কি তুয়ান বন্যা খরা মহামারি ঘূর্ণিঝড়

ভাসাই মারে ধ্বংস গরে

মাইনষে ত আর বই ন রঅর।

হক্কল হামর ধান্ধা চলের

আবার নয়া সষ্টি অর।

ভাঙা গাছত নয়া ঠেইল

পাতা মেলি দেখার খেইল

পাখি আবার উড়ের ঘুরের

চুপ্পে প্রেমর কথা কঅর।।

(চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান : কল্যাণী ঘোষ)

(চলবে)

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধএবং বিশ্বজিৎ