শ্রীশ্রী কালী পূজা : একটি সারসংক্ষেপ

ডা. দিলীপ দে | রবিবার , ১২ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:৩০ পূর্বাহ্ণ

উনবিংশ শতাব্দীর সংস্কৃত ভাষার বিখ্যাত অভিধান শব্দকল্পদ্রুমএ বলা হচ্ছে-‘কাল শিবহ্‌। তস্য পত্নীতি কালী।’ অর্থাৎ‘শিবই কাল বা কালবোধক। তাঁর পত্নীই কালী’। কালী হচ্ছেন মা দুর্গার বা পার্বতীর ভয়াল অপর রূপ। তিনিসময়ের, পরিবর্তনের, শক্তির, সংহারেরদেবী। তিনি কৃষ্ণবর্ণা বা মেঘবর্ণা এবং ভয়ংকরা। হিন্দুরা ভয়ংকরেরও পূজা করেন। তিনি অশুভ শক্তি’র বিনাশ করেন। শক্তি সৃষ্টিতত্ত্ব মতে এবং শাক্ত তান্ত্রিক বিশ্বাস মতে তিনিই পরম ব্রহ্ম। কালীকে এই সংহারী রূপের পরেও আমরা মাতা সম্বোধন করি। তিনি সন্তানের কল্যাণ চান তিনি মঙ্গলময়ী,তিনি কল্যানী। অথর্ব বেদ এ কালীর উল্লেখ থাকলেও বিশেষ্য হিসেবে কথক গ্রাহ্যসূত্রে (১৯.) প্রথমবার কালীর উল্লেখ ঘটে। কালী অগ্নিদেবের সাতটি জিহ্বার একটি নাম,অগ্নিদেব হচ্ছেন আগুনের ঋগ্বেদীয় দেবতাযার উপস্থিতি মুন্ডুক উপনিষদে বর্তমান; তবে এখানে কালী বলতেদেবী কালীকেই উল্লেখ করা হয়েছে একথা সুনিদৃষ্টভাবে নির্ণীত করা কঠিন। কালী’র বর্তমান রূপের উপস্থিতি আমরা পাই মহাভারতের সুপ্তিকা পার্বণে,যেখানে তিনি কালরাত্রি হিসেবে অভিহিতা, যিনি পান্ডব সৈন্যদের স্বপ্নে দৃশ্যমান এবং পরে দ্রোণাচার্য পুত্র অশ্বত্থামা যখন তাদের আক্রমণ করলেন তখন তিনি প্রকৃত স্বরূপে আবির্ভূতা।মহাদেবী’র একটি শক্তি হিসেবে তিনি ষষ্ঠ শতাব্দীর ‘দেবী মাহাত্ম্যম’এ প্রসিদ্ধ,এবং‘রক্তবীজ’ নামক অসুরকে পরাভূতকারী দেবী হিসেবে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখিত। রক্তবীজকে নিশ্চিহ্ন করতে দেবীনরসিংহী, বৈষ্ণবী, মহেশ্বরী, ব্রাহ্মী, বরাহী, ঐন্দ্রী, চামুন্ড বা কালী এই অষ্টমাতৃকা রূপে সংস্তিতা। দশম শতাব্দীর ‘কালিকা পুরাণে’ পরম সত্য হিসেবে কালীকে স্তুতি করা হয়। তবে ভিন্ন ও সতন্ত্র এক দেবী হিসেবে ষষ্ঠ শতাব্দীতে কালী প্রথম উল্লেখিত। এবং এ সকল তন্ত্রেগ্রন্থে তিনি বহির্বৃত্তে বা প্রান্তিক সীমায় বা যুদ্ধ ক্ষেত্রে স্থিতা বা চিহ্নিতা, এবং বিবিধ পুরাণে শিবের উপস্থিতির সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। হিন্দু ধর্মমতেকালী বা কালিকা হচ্ছেন শক্তির দেবী। কালিকা পুরাণে তাঁকে বলা হচ্ছে ‘আদি শক্তি’, তিনি প্রকৃতির সীমার বাইরেও অধিষ্ঠাত্রী ‘পরা প্রকৃতি’।

১৬৯৯ শকাব্দে(১৭৭৭ খ্রীষ্টাব্দে)কাশীনাথ বিরচিত ‘শ্যামাসপর্যায়বিধি’তে এ পূজার সর্বপ্রথম উল্লেখ লক্ষনীয়। পূজার প্রমাণ স্বরূপ এ গ্রন্থে পুরাণ ও তন্ত্রের বচন উল্লেখিত। সপ্তদশ শতাব্দীতে বলরাম বিরচিত কালিকামঙ্গলকাব্যে একটি বাৎসরিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান কালীকে নিবেদিত মর্মে উল্লেখিত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বাংলায় প্রথম কালীপূজার প্রবর্তন করেন। উনবিংশ শতাব্দীতে কালীপূজা বাংলায় বিশেষ প্রাধান্য লাভ করে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র এবং কোলকাতার সমাজের বিত্তবান ও উচ্চ শ্রেনীর লোকজনের মধ্যে এ পূজার প্রচলন বৃদ্ধি পায়। ক্রমে দুর্গা পূজার সাথে সাথে কালী পূজাও বিশেষতঃ বাংলায় একটি প্রধান হিন্দু ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়। একটা ধারণা আমাদের মধ্যে বর্তমান আছে যে, শিব পার্বতীর স্বামী এবং মা কালীর ভাসুর। কথাটি আদৌ সত্য নয়।অসুররক্তস্নাত কোপান্বিতা দেবীর এই সংহারী মূর্তিকে কিছুটা নিবৃত্ত ও প্রশমিত করতে শিব তাঁর চলার পথে শুয়ে থাকলেন। দেবী পথ চলতে গিয়ে তাঁর স্বামী শিবকে পায়ে মাড়ালেন। এই পাদস্পৃষ্ঠতার লজ্জায় ও তার অনুশোচনায় মায়ের জিহ্বায় কামড় পড়লো। তাঁর কোপভাব স্থিমিত হলো, ছেদ পড়লো। তান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাঁর ভয়াল রূপ সত্ত্বেও রাত দুপুরে শ্মশানে তাঁর মুখোমুখি হওয়ার সাহস অর্জন এবং অন্যদিকে তাঁর প্রতি বাঙালিদের শিশুর মতো শর্তহীন ভালবাসাউভয় ক্ষেত্রে মৃত্যুর সঙ্গে পরিচিত হওয়া ও তাকে মেনে নেওয়াই মূখ্য কাজ। দুর্গার মতো কালীও সাধারণভাবে সর্বজনীন হিসেবে বিবেচিত। সবচেয়ে সরাসরি বহুল ভাবে তিনি পূুজিত হন মহাকালী বা ভদ্রকালী রূপে।আদি পরাপ্রকৃতি(দেবী দুর্গা) অথবা ভাগ্যবতীর দশ মহাবিদ্যা রূপের একটি রূপে কালী পূজিতা হন।দেবী বন্দনারএই অর্গলা স্তোত্রম্‌ নিম্নরূপ– ‘ওঁ সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বত্ব সাধিকে, স্মরণ্যে স্ত্রম্ভকে গৌরী নারায়নী নমোহস্তুতে।ওঁ জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী, দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোহস্তুতে।’ এই মন্ত্রে সর্বসংহারকারিনী মা কালী মঙ্গলদায়িনী ‘মঙ্গলাকালী’ এবং সুখদায়িনী ‘ভদ্রকালী’ রূপে বন্দিত। মধ্যযুগের শেষের দিকে বাঙ্গালীর ভক্তিমূলক সাহিত্যে কালী ব্যাপক স্নান করে নিয়ে বিরাজমান আছেন। সাধক রামপ্রসাদ সেন(১৭১৮১৭৭৫) এর মতো কালী ভক্ত উপাসকরা কালীকে নিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য ভক্তিমূলক গান।

বাংলাদেশে অনেক কালী মন্দির আছে। সুপ্রাচীন প্রায় লুপ্ত ঢাকার রমনা কালী মন্দির তেমনি একটি পুরাতন কালী মন্দির। ব্রহ্মযামলে উল্লেখ আছে– ‘কালিকা বঙ্গদেশে চ’; অর্থাৎ ‘বঙ্গদেশে দেবীকালিকা বা কালী নামে পূজিতা হন।’ নানা রূপে নানা স্থানে কালী পূজিতা হন, যেমন দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী গুহ্যকালী, মহাকালী, চামুন্ডা ইত্যাদি। নামে মাহাত্ম্যে এ কালীর মধ্যে কিছু কিছু ভিন্নতা বর্তমান।অন্যদিকে বিভিন্ন মন্দিরে দশ মহাবিদ্যা, ব্রহ্মময়ী, ভবতারিণী, আনন্দময়ী, করুণাময়ী ইত্যাদি নামে কালী’র পূজা হয়। চট্টগ্রাম শহরের চট্ট্‌শ্েবরী কালীবাড়ী, গোলপাহাড় শ্মশান কালীবাড়ী, দেওয়ানহাটের দেওয়ানেশ্বরী কালীবাড়ী, সদরঘাট কালীবাড়ী,পটিয়া পিঙ্গলা কালীবাড়ী, ধলঘাট বুড়াকালী বাড়ী সহ চট্টগ্রামে অনেক প্রসিদ্ধ কালী মন্দির বর্তমান। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা’র দিন কালীপূজা বিশেষভাবে পালিত হয়। সর্বজনীন মন্ডপে যেখানে দুর্গাপূজা হয় সেখানে অধিকাংশ মন্ডপে দিন বিশেক পরে কালীপূজাও হয়ে থাকে। অনেক কালীসাধক বিখ্যাত, শ্রীরামকৃষ্ণ কালীর উপাসক ছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দও কালীর ভক্ত ছিলেন। কালী প্রশস্তিমূলক গান তথা শ্যামাসঙ্গীত বাংলা গানের একটি ভিন্ন ধারা। কালী সাধক রাম প্রসাদ সেন, কমলাকান্ড ভট্টাচার্য দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং কাজী নজরুল ইসলামও এ ধারার উৎকৃষ্ট মানের গান রেখে গেছেন। নিরক্ষর শ্রীরামকৃষ্ণ দেবী কালী সচেতনতায় অনবদ্য বাণী উচ্চারণ করতেন যা শ্রীশ রচিত ‘রামকৃষ্ণ কথামৃততে স্নান পেয়েছে।‘মৃত্যুরূপা কালী’ দেবী কালীকে নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ রচিত একটি সুবিখ্যাত সুদীর্ঘ কবিতা।ভগিনী নিবেদিতা ‘মাতৃরূপা কালী’ নামক একটি কালী বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। দীপাবলী বা দীপান্বিতা বা কার্তিক মাসের অমাবস্যায় অনুষ্ঠিত কালীপূজা উপলক্ষে দেবী মূর্ত্তির দক্ষিণা কালীর অবয়বে তৈরী হয়, এক্ষেত্রে দেবী বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছেদেবী করলাবদনা, কৃষ্ণবর্ণা, নীলবর্ণা বা মহামেঘবর্ণা,দেবী আলুলায়িত কেশা, রামপ্রসাদী গানে ভক্তিভরে মাকে বলা হচ্ছে,‘..এলোকেশী সর্বনাশী..’,মা এলোকেশী,রক্তচক্ষু, লোল জিহ্বা, চতুর্ভূজা, নৃমুন্ডমালিনী,, নরহস্তের কোমরবন্ধ, বাম করযুগলে উন্মুত্ত খড়গ এবং নরমুন্ড, ডান করদ্বয়ে বর ও অভয়মুদ্রা ,দক্ষিণা কালী’র দক্ষিণ পা শিবদেহে স্পর্শমান, বাম পা খানিকটা দুরত্বে, স্বামীর গায়ে পা পড়ায় অসুর রক্ত পানে সিক্ত জিহ্বায় কামড়। ত্রিনয়নী মা অসুর হত্যার মহাঘোরে হাস্যরতা ও ভয়াল দর্শন। মায়ের গলায় নৃমুন্ডমালায় সাধারণতঃ ১০৮টি অথবা ৫১ টি নরমুন্ড বর্তমান। ১০৮ হিন্দুদের জন্য একটি পবিত্র সংখ্যা, রামচন্দ্র ১০৮ নীলপদ্মে অকাল বোধন করেছিলেন। মন্ত্রপাঠের সময় গুনার জন্য জপমালায় ১০৮টি গুটিকা থাকে। দেবনাগরী বর্ণমালায় সর্বসমেত ৫১টি বর্ণ আছে, হিন্দুদের বিশ্বাস সংস্কৃত একটি চলমান জীবন্ত ভাষা, এবং এর ৫১ টি বর্ণমালায় অপার শক্তি নিহিত আছে। সতীর পবিত্র পীঠস্থানও ৫১টি। পরিশেষে, কালী মায়ের কোন চিরস্থায়ী গুণ বা প্রকৃতি নেই যার মানে দাঁড়ায় বিশ্ব প্রকৃতি ধ্বংসের পরেও তিনি বর্তমান থাকবেন।

লেখক : শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, লেখক, গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে