আজ ১লা মে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০ টি দেশ এদিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে থাকে। আজ এ দিবসটি এমন এক সময়ে পালিত হচ্ছে, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বৈশ্বিক উষ্ণতায় প্রচণ্ড তাপদাহে ভয়াবহ অবস্থা। আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে দেশজুড়ে টানা তাপপ্রবাহের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা এ মৌসুমের সর্বোচ্চ। জানা যায় দেশের ৫৫ জেলার উপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে চলছে যা চলতে পারে ৪/৫ মে পর্যন্ত। আবহাওয়াবিদদের মতে, ১৯৪৮ সাল থেকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের যে ডেটা রয়েছে তা থেকে জানা যায় চলতি মৌসুমের আগের ৭৫ বছরের মধ্যে টানা সর্বোচ্চ ২৩ দিন তাপপ্রবাহ বয়ে চলে ২০২৩ সালে। ওই বছরের এপ্রিলের শেষ ১৮ দিন ও মে মাসের শুরুর ৫ দিন দাবদাহ ছিল দেশে। এবার বৃষ্টিপাতের প্রবণতা না থাকায় চৈত্র মাসের শেষ সময় থেকে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। এখন পর্যন্ত টানা ৩০ দিনের তাপপ্রবাহ যা গত ৭৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সময়। এ প্রচণ্ড তাপদাহে সবচেয়ে ভুক্তভোগী শ্রমিক শ্রেণি। কারখানার শ্রমিক থেকে শুরু করে দিন মজুর। দেশে হিট এলার্ট জারি হলেও জীবন ও জীবিকার তাগিদে অসহ্য তাপদাহে পুড়ছে শ্রমজীবী মানুষ। হিট–স্ট্রোকের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। প্রচণ্ড তাপদাহে মানুষ ঘরের বাইরে যেতেও ভয় পাচ্ছে অন্যদিকে উপার্জনহীন অবস্থায় অনাহার–অর্ধাহারে দিনযাপনের দুঃখ–কষ্ট। জীবন ও জীবিকার সমন্বয়ে বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ আজ এক ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি। তবু আমরা মে দিবসের সংগ্রামী ঐতিহ্যের কথা, সুদীর্ঘ সংগ্রামের অর্জনগুলোর কথা স্মরণ করছি। আমাদের শ্রমজীবী মানুষের অনুপ্রেরণার উৎসস্থল এ মে দিবস।
১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকেরা আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। সেদিন শ্রমিকেরা ১০–১২ ঘণ্টার কর্মদিবসের বিপরীতে আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন। সেই আত্মদানের পথ ধরে পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমজীবী মানুষদের দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করতে হয়েছে ন্যায্য মজুরি, অবকাশ, মানবিক আচরণ, স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবিতে। আট ঘণ্টার কর্মদিবসের দাবি অর্জিত হয়েছে, কর্মপরিবেশেরও কিছুটা উন্নতি হয়েছে; কিন্তু শ্রমজীবীদের পেশাগত জীবনে নিরাপত্তা ও মানবিক অধিকারগুলো অর্জিত হয়নি।
কার্ল মার্ড হিসাব করে দেখিয়ে ছিলেন মালিকের মুনাফা বাড়ানোর পথ দুটি। শ্রমিকের শ্রম, সময় বাড়ানো আর যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো। ফলে কর্মঘণ্টা বাড়ছে, উৎপাদন বাড়ছে। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকারত্ব। বিপুলসংখ্যক বেকার শ্রম বাজারে রিজার্ভ আর্মির কাজ করছে বলে কম মজুরিতেই তাদের কাজ করানো সম্ভব হচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশের শ্রমিকদের অবস্থা কেমন! এ বিষয়ে রাজেকুজ্জামান রতন তাঁর এক লেখায় বলেন, প্রতি বছর শ্রমবাজারে কাজ প্রত্যাশী ২০/২২ লাখ তরুণ–যুবক আসে যাদের মাত্র দুই লাখের মতো কর্মসংস্থান রাষ্ট্র করতে পারে। এরপর, সাত থেকে ১০ লাখ মানুষ পাড়ি জমায় বিদেশে কাজ করতে। আর বাকিরা দেশে কোনোমতে কাজ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে। দেশের ছয় কোটি ৩৪ লাখ শ্রমজীবীর মধ্যে প্রায় তিন কোটি কাজ করে কৃষিখাতে। যেখানে বছরে ৩ মাসের বেশি কাজ থাকে না ফলে বহু ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজের মাধ্যমে তারা টিকে থাকার চেষ্টা করে। এর বাইরে ৪০ লাখ শ্রমিক গার্মেন্টসে; ৩০ লাখের বেশি নির্মাণ খাতে; ৫০ লাখ পরিবহন খাতে; ১০ লাখের বেশি দোকান কর্মচারী; পাট, চা, চামড়া, তাঁত, রি রোলিং, মোটর মেকানিক, লবণ, চিংড়ি, হাসপাতাল–ক্লিনিক, পুস্তক বাঁধাই, হকার, রিকশা–ভ্যান চালক, ইজি–বাইক চালক, সিকিউরিটি গার্ডসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করছে। শ্রম শক্তির ১ কোটি ২ লাখ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে আর বাকিরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকে। মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে ৪৩টি সেক্টরের শ্রমজীবীদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের ব্যবস্থা থাকলেও বাকি কোটি কোটি শ্রমিকের ‘কাজ নাই তো মজুরি নাই‘ নীতিতে কাজ করানো হয়ে থাকে। শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার পথে আইনি এবং আইন বহির্ভূত অসংখ্য বাধা। যদিও আজ বাংলাদেশের শ্রম পরিবেশ অতীতের তুলনায় যতটা এগিয়েছে, তার পেছনেও রয়েছে শ্রমিকদের ত্যাগ ও সংগ্রাম। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরির দাবি এখনো উপেক্ষিত, এখনো তাঁদের বিরাট অংশ মৌলিক মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের দুঃখ–দুর্দশার কমতি নেই। আশার কথা বিভিন্ন সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের। খাবার স্যালাইন, ডাবের পানি ও ছাতা দিয়ে বিভিন্নভাবে সাহায্য করছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। শ্রমিক শ্রেণি তথা খেটে খাওয়া মানুষদের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাদের। আজ এ মহান দিনে আমরা বাংলাদেশের ও সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষকে মে দিবসের শুভেচ্ছা ও সংহতি জানাই।