মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও চোখের জলে জন্মস্থান রাউজান গহিরার মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বিএনপি’র ভাইস–চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় পারিবারিক কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয় বর্ষীয়ান এ রাজনীতিবিদকে। এর আগে বাদে আসর গহিরা আবদুর জব্বার ইয়াংমেন সোসাইটি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ এবং বাদে জুমা নগরের জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় তার। উভয় জানাজায় বিশেষ করে জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ মাঠে অনুষ্ঠিত জানাজায় ঢল নামে হাজার হাজার মানুষের। মসজিদ মাঠ ছাপিয়ে পাশের সড়কও পরিপূর্ণ ছিল মানুষে। বিএনপি নেতাকর্মীরা ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার ও নানা বয়সী মানুষ অংশ নেন জানাজায়। প্রিয় নেতাকে শেষ বিদায় জানান তারা। এসময় অনেককে আবেগ আক্রান্ত হতে দেখা গেছে।
এর আগে সকালে নাসিমন ভবন দলীয় কার্যালয়ে আনা হয় নোমানের মরদেহ। সেখানেও হাজারো মানুষ শ্রদ্ধা জানান গণমানুষের এ নেতাকে। ফুলে ফুলে ঢাকা পড়ে নোমানের মরদেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি। তার আগে নগরের খুলশীতে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি এবং বাকলিয়া শহীদ এন এম এম জে কলেজ প্রাঙ্গণে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারী–কর্মকর্তাদের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়েছিল নোমানের মরদেহ।
জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ মাঠে অনুষ্ঠিত জানাজায় অংশ নেন বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার ও এস এম ফজলুল হক, সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, সহসাংগঠনিক সম্পাদক মীর মো. হেলাল উদ্দিন, আবদুল্লাহ আল নোমানের ছেলে সাঈদ আল নোমান, নগর বিএনপি’র আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ, সাবেক সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর, দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র আহবায়ক ইদ্রিস মিয়া ও সদস্য সচিব লায়ন হেলাল উদ্দিন, জাতীয় পার্টির সোলায়মান আলম শেঠ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা আলহাজ্ব মো. আবু তাহের, আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় সভাপতি শাহ আলম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর চট্টগ্রাম অঞ্চল টিম সদস্য অধ্যাপক আহছানউল্লাহ, চট্টগ্রাম মহানগর আলহাজ্ব শাহজাহান চৌধুরী, দৈনিক কর্ণফুলী সম্পাদক আফসার উদ্দিন চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর চট্টগ্রাম মহানগরী নায়েবে আমীর ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ ও মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম, নগর জামায়াতের এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মুহাম্মদ উল্লাহ, ফয়সাল মুহাম্মদ ইউনুস, সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ শামসুজ্জামান হেলালী, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন চট্টগ্রাম মহানগরী সভাপতি এস এম লুৎফর রহমান, নগর জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য হামেদ হাসান এলাহী।
জানাজার আগে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী স্মৃতিচারণ করে বলেন, নোমান ভাই পরিচ্ছন্ন একজন রাজনীতিবিদ। তিনি ছাত্র রাজনীতি করেছেন, শ্রমিক রাজনীতি করেছেন, তিনি সামাজিক আন্দোলন করেছেন। তারপর মূল দলে এসেছেন। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ও ভদ্র একজন মানুষ। উনার সাথে রাজপথে কাজ করেছি। দলে যখন যে দায়িত্ব উনার ছিল– তা নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন। কর্মীদের সাথে তিনি কতটা সম্পৃক্ত ছিলেন, আজ তা প্রমাণ হয়েছে। তিনি গণমানুষের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন।
এর আগে নাসিমন ভবন নগর বিএনপি কার্যালয়ের সামনে আমীর খসরু বলেন, নোমান ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা চট্টগ্রাম মহানগরের রাজনীতি করেছি। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে, আন্দোলন–সংগ্রামে রাজপথে আমরা একসাথে কাজ করেছি। এই নাসিমন ভবনে পুলিশের আক্রমণ, টিয়ার গ্যাসের শিকার হয়ে আমরা আশ্রয় নিয়েছি। সরকারের ভেতরে, সরকারের বাইরে, রাস্তায় শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলন, ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলন, তার আগে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে উনার উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে গেছেন। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আমরা উনার অবদানের জন্য ঋণী। নোমান ভাই হয়তো সুস্থ থাকলে, আরও কিছুদিন বাঁচলে আমাদের আগামী রাজনীতিতে বিশেষ করে আজকের যে প্রেক্ষাপট আরেকটি ক্রান্তিলগ্নে আমরা এসে পড়েছি। এসময় তার অবদান আমাদের প্রয়োজন ছিল।
জানাজার পূর্বে সিটি মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেন, আবদুল্লাহ আল নোমান গণমানুষের নেতা ছিলেন। চট্টলার জন্য তিনি অনেক কিছু গড়ে গেছেন। গণমানুষের নেতা নোমান ভাই দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে চলে গেছেন। চট্টগ্রামের স্বার্থে উনি অনেক কিছু করেছেন। তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু, শিক্ষা বোর্ড, এই জমিয়তুল ফালাহর উন্নয়নসহ অনেক কাজ তিনি করে গেছেন।
গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, ৬৯ এ একসাথে আন্দোলন করেছি। সেই থেকে তিনি আমার নেতা। ব্যক্তি হিসেবে সমাজে সাধারণ মানৃষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এক নেতা তিনি। মাহবুবের রহমান শামীম বলেন, উনার সাথে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছি, উনার দিক নির্দেশনায়। আজ এমন একজন নেতাকে হারিয়ে পুরো বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নগর জামায়াত ইসলামের আমীর শাহজাহান চৌধুরী বলেন, আমরা একসঙ্গে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছিলাম। তিনি সাধারণ মানুষের রাজনীতি করেছেন।
নাসিমন ভবনে নগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর বলেন, নোমান ভাই শুধু বিএনপির নেতা ছিলেন না, তিনি সাধারণ গণমানুষের নেতা ছিলেন। তিনি হাজার হাজার নেতাকর্মী সৃষ্টি করেছেন।
এদিকে রাউজান প্রতিনিধি জানান, বাদে আসর গহিরা আবদুর জব্বার ইয়াংমেন সোসাইটি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে আবদুল্লাহ আল নোমানের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে রাউজান উপজেলা নির্বাহী অফিসার জিসান বিন মাজেদ এর নেতৃত্বে পুলিশের চৌকস একটি দল গার্ড অব অনার প্রদান করেন। জানাজার পূর্বে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস–চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহবায়ক গোলাম আকবর খন্দকার, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সাবেক সংসদ সদস্য লায়ন আসলাম চৌধুরী, সগ–সাংগঠনিক সম্পাদক মীর মো. হেলাল উদ্দিন ও সাঈদ আল নোমান। এ সময় গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, বিএনপি প্রতিষ্ঠার থেকে দলের জন্য আবদুল্লাহ আল নেমানের একনিষ্ঠ আনুগত্য ছিল।
উল্লেখ্য, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার ভোর ৬টায় রাজধানীর ধানমণ্ডি বাসায় ইন্তেকাল করেন সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মে জন্ম নেয়া নোমানের ৮০ বছরের জীবনের ৬৬ বছর কেটেছে রাজনীতি করে, যার শুরু মাত্র ১৪ বছর বয়সে। ২৫ ফেব্রুয়ারি আজ বাদে জোহর ধানমন্ডি ঈদগাহ মসজিদে ১ম, দুপুর আড়াইটায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ২য় এবং নয়াপল্টন বিএনপি কার্যালয়ের সামনে বাদে আসর নোমানের ৩য় জানাযা অনুষ্টিত হয়। ঢাকা থেকে বৃহষ্পতিবার বিকেল সাড়ে ৪টায় হেলিপ্টারে করে তার মরদেহ আনা হয় চট্টগ্রাম।