শেরে মিল্লাত মুফতি ওবাইদুল হক নঈমী (রহ.)

সুন্নীয়তের বাতিঘর

মাওলানা মুহাম্মদ আজিজুর রহমান | রবিবার , ২৭ জুন, ২০২১ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

পার্থিব জীবন অবসানের পরও যে সকল মনীষী স্বীয় কর্ম ও সাধনাগুণে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে মানুষের হৃদয়পটে স্থান করে অমরত্ব লাভ করেছেন, তাদের মধ্যে শেরে মিল্লাত আল্লামা মুফতি ওবাইদুল হক (নঈমী রহ.) অন্যতম। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার এক বিস্ময়কর অনুপম দৃষ্টান্ত। তিনি একদিকে ছিলেন ইসলামী স্কলার, বরেণ্য আলেমেদ্বীন, যুগশ্রেষ্ঠ মুফতিয়ে জামান, শায়খুল হাদিস, সুবক্তা ও মুনাজির (তর্কযোদ্ধা), অপরদিকে ছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতাদর্শ মাঠ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠায় আমরণ সংগ্রামের মূর্তপ্রতীক, অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ও পাঞ্জেরী। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা সাধারণ মানুষের হৃদয়ে পাকাপোক্ত করতে তাঁর সাড়া জাগানো মাহফিল, মুনাজিরা (তর্কযুদ্ধ) মিল্লাত মাযহাবের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে। সুন্নীয়াত প্রচারে হুজুরের অগ্রণী ভূমিকা সত্যিই অনস্বীকার্য। শেরে মিল্লাত তাঁর উপাধি। বাতিলপন্থীদের বাতিল আকিদার প্রতিত্তরে তিনি মাহফিলে সমূচিত জবাব দিতেন। তিনি যে মুনাজিরা-মুবাহাসা করেছেন তা সর্বজনবিদিত। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা লক্ষ্য করে বাতিলরা মুনাজিরা করা দূরের কথা, সামনেও আসতে সাহস পেত না। মাহফিলে তিনি নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রেমের হৃদয়গ্রাহী যে ঝড় তুলতেন, তা খুবই বিরল। প্রবাদ আছে, খবমবহফ হবাবৎ ফরব অর্থাৎ, কিংবদন্তি কখনও মরে না। শেরে মিল্লাত আল্লামা মুফতি ওবাইদুল হক নঈমী (রহ.) ছিলেন সুন্নীজনতার কিংবদন্তি। কিংবদন্তিগণ অমর। যুগযুগ ধরে মানুষের হৃদয়ে, স্মৃতিতে অম্লান থাকেন। হুজুর আল্লামা নঈমী (রহ.) কীর্তিমান পুরুষ। তাঁর হাজারো কীর্তি আজ সমুজ্জ্বল। মিলাদ কিয়াম ও দরুদ সালামের বৈধতার উপর তাঁর লিখিত গ্রন্থ “দালায়েলুল কিয়াম লি-মিলাদে খায়রুল আনাম”এক অনবদ্য সৃষ্টি। তাঁর অপর একটি কিতাব হল “কাশিফুল মুহাম্মদ শরহে ইমাম মুহাম্মদ”। এটি ইমাম মুহাম্মদ আশ শাইবানী (রহ.) রচিত ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্থের উর্দু ভাষার ব্যাখ্যা গ্রন্থ। এটিও অতিসত্বর গ্রন্থাগারে প্রকাশিত হবে ইনশাআল্লাহ। তিনি শিক্ষক হিসেবেও দক্ষ ও প্রজ্ঞাবান ছিলেন। এ মহান জাতির নির্মাতা, মানুষ গড়ার কারিগরের অজস্র ছাত্র আজ দেশ বিদেশের বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় পদে অধিষ্ঠিত। তাঁর রেখে যাওয়া ছাত্র, ভক্ত-অনুরক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা “মসলকে আ’লা হযরত” তথা সুন্নীমতাদর্শ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ মহান মিশনের কাজ ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারীতে দেশে বর্তমান সময়ে সাড়া জাগানো লাশ দাফন-কাফনে সহায়তাকাবী মানবতার সংগঠন ‘গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ’ গঠন ও প্রচার প্রসারে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। প্রবাদে আছে, কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। কীর্তিমান পুরুষ হিসেবে তিনিও যুগযুগ ধরে মানব হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন। আল্লামা নঈমী হুজুর (রহ.) ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ.) এর ওফাতের দিন বলেছিলেন, “হুজুর হাশেমী (রহ.) আজ সবকিছু থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে যাচ্ছেন। আমরাও একদিন চলে যাবো।” হুজুরের এ অমীয় বাণীতেই কি ঈশারা ছিলেন? তিনিও সবকিছু থেকে ইস্তফা দিয়ে শিগগিরই চলে যাচ্ছেন! মাসের ব্যবধানে উস্তাদ-শাগরিদ দুই মহান মনীষী সুন্নীজনতাকে শোক সাগরে ভাসিয়ে পরপারে পাড়ি দিলেন। হে আল্লাহ! এ মহান মনীষীদ্বয়ের দারাজাতকে বুলন্দ করুন। আমীন, বিহুরমাতি সাইয়্যিদিল মুরসালীন (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। আল্লামা নঈমী হুজুর (রহ.) একটি হাদীস প্রায় বলতেন, ”কাব্বারানি মাউতুল কুবরাহ” অর্থাৎ,”আমাকে বড় করেছে, বড়রা (প্রবীণরা) মৃত্যুবরণ করার কারণে”। আজ আমি সম্মানিত, নেতৃত্বের আসনে সমাসীন যেহেতু প্রবীণরা বেঁচে নেই। আজকের শিশু আগামী দিনের কর্ণধার। জাতির যোগ্য কর্ণধার হতে হুজুরের পদাঙ্ক অনুসরণের বিকল্প নেই। শেরে মিল্লাত নঈমী হুজুর (রহ.) সর্বক্ষেত্রে আপোষহীন ছিলেন। সবসময় বাঘের মত বীরোচিত কথা বলতেন। সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে কোনরূপ সংকোচ করতেন না। কে কী মনে করবে বা কী বলবে তার কোন পরোয়া করতেন না। এককথায় সর্বত্র সবখানেই তিনি দ্ব্যর্থহীনকন্ঠে কথা বলতেন। হুজুর আল্লামা নঈমী (রহ.) সম্পর্কে তাঁর স্বীয় উস্তাদ আল্লামা হাশেমী (রহ.) বলেছিলেন, “আল্লাহ যদি কিয়ামতের ময়দানে আমাকে প্রশ্ন করে তুমি কী নিয়ে এসেছো ? তখন আমি বলবো আমি আমার ছাত্র আল্লামা ওবাইদুল হক নঈমীকে নিয়ে এসেছি”। দেখুন, তাঁর ব্যাপারে স্বীয় উস্তাদের এ কেমন উক্তি! নিশ্চয়ই উস্তাদ তাঁর ছাত্রের উপর সন্তুষ্ট ও গৌরবান্বিত। তাইতো হুজুরের স্বীয় মুর্শিদ হুজুর কেবলা আওলাদে রাসুল সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহও (ম.জি.আ.) ইন্তেকালের দিন বলেছিলেন, “মুফতি নঈমী সাব পর হযরাতেকেরাম খৌশ হে”। যেখানে উস্তাদ-পীর সবাই তাঁর উপর সন্তুষ্ট নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ জান্নাতে তাঁর শান, মকাম অনেক সুউচ্চ করবেন। হাদিসের অমীয় বাণী, “মাউতুল আলেমে কামাউতুল আ’লম” অর্থাৎ, একজন আলেমের ইন্তেকাল যেন একটি জাহানের ইন্তেকাল। হুজুরের ইন্তেকালে উক্ত হাদিসের যথার্থতা পরিলক্ষিত হয়। করোনাকালীন প্রতিকূল পরিবেশে মানুষের সমাগম এড়ানোর জন্য প্রশাসনের অনুরোধে আকস্মিক ঘোষণার পরও রাত্রিকালীন জানাজায় লক্ষ জনতার ঢলই প্রমাণ করে তাঁর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার। আল্লাহভীতি, দেশপ্রেম, দানশীলতা, সরলতা, অনাড়ম্বর জীবন যাপন ও যাবতীয় ত্যাগ-তিতিক্ষাসহ অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার মত দুর্লভ গুণাবলীতে তিনি গুণান্বিত ছিলেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন অকুতোভয় রাহবার, মহান দিকপাল। তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার প্রতিষ্ঠাতা পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাইতো তিনি হাল ধরে ছিলেন সুন্নীজনতার। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পতাকা তলে সবাইকে শামিল করার লক্ষ্যে শেষজীবনে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হয়ে মহান দায়িত্ব পালন করেছিলেন ইন্তেকাল অবধি। তিনি একজন আন্তর্জাতিক ইসলামিক স্কলার ছিলেন বিধায় লন্ডন ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড ইসলামিক মিশনের সদস্য ছিলেন। সকল প্রকার বাতিল ফিরকা ও ভণ্ডদের বিরুদ্ধে বজ্রকন্ঠে কথা বলতে তিনি দ্বিধাবোধ করতেন না।”মসলকে আ’লা হযরত” তথা সুন্নীয়াত প্রতিষ্ঠায় বাতিলের বিরুদ্ধ আমরণ সংগ্রাম করে গেছেন। “মসলকে আ’লা হযরত” তথা সুন্নীয়াতের আকিদা প্রচার প্রসারে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বাতিল ফিরকাদের বদ আকিদার দাঁতভাঙ্গা জবাবদানে মাহফিল-মুনাজিরা, সভা-সেমিনারে বাঘের মত তাঁর চ্যালেঞ্জিং হুংকার জাতির কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। অকুতোভয় সিংহপুরুষ আল্লামা নঈমী হুজুর (রহ.) প্রিয় নবীজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শানে বেয়াদবী তথা গোস্তাখে রাসুলদের প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কখনো ছাড় দিতেন না। শেরে মিল্লাত আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ ওবাইদুল হক নঈমী (রহ.) একটি চেতনা ও প্রেরণার নাম। তিনি ছিলেন সুন্নীয়াতের এক কিংবদন্তি বাতিঘর ও পাথেয় মাইলস্টোন। শরীয়ত ও তরীকতের শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অবদান অপরিসীম। স্মৃতিতে অম্লান ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব মরহুম আল্লামা মুফতি ওবাইদুল হক হুজুরের ইন্তেকালে দেশ ও জাতি ইসলামের এক মহান ব্যক্তিত্ব ও ইলমের জাহাজকে হারিয়ে ফেলল। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এক সমুজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক আল্লামা নঈমীর (রহ.) চিরবিদায় তবে তাঁর অবদান চির অম্লান, চির ভাস্বর।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ক্রয় বিভাগ,
এপিক প্রপার্টিজ লিমিটেড।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধচাকরিতে সন্তুষ্টির জন্য প্রয়োজন সঠিক লক্ষ্য ও পরিকল্পনা