শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ভয়ংকর ২১ আগস্ট

আবদুচ ছালাম

| সোমবার , ২১ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

২১ আগস্ট ২০০৪, শনিবার। বাঙালি জাতীয় জীবনে এক বিভীষিকাময় অধ্যায়। দেশের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করে পুনরায় ৭১এর পরাজিত পাকিস্তান সরকারের তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করার হীন মানসে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ১৯৭৫এর ১৫ আগস্ট দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান স্থপতি, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসতম হত্যা করে। সেদিন সৌভাগ্যক্রমে প্রবাসে থাকা বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বর্তমান সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু, পঁচাত্তরে যে ষড়যন্ত্রের অশুভ তৎপরতা স্বাধীনতা বিরোধী চক্র শুরু করেছিল তারই ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব শূন্য করতে ৩রা নভেম্বর কারাভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যাসহ দেশপ্রেমিক অগণিত মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের বিনাবিচারে হত্যা করে সারাদেশকে হত্যাপুরীতে পরিণত করে। ১৯৭৫ এর ৩১ ডিসেম্বর জেনারেল জিয়া সামরিক অধ্যাদেশ জারী করে দালাল আইন বাতিল করে ১৯৭৬ এর ১৮ জানুয়ারি নাগরিকত্ব ফিরে পাবার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে আবেদন করতে বলা হয় সবচেয়ে আলোচিত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে। দেশের মানুষের বাক স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত করে এবং ৭২এর পবিত্র সংবিধানের বুকে ছুরি চালিয়ে ১৯৭৭ সালের প্রোক্লেমেশন অর্ডার নম্বর ১এর মাধ্যমে সংবিধানের ধর্মীয় ১২ সম্পূর্ণভাবে ও ৩৮ অনুচ্ছেদের অংশবিশেষ বিলুপ্ত ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর সাংবিধানিক বিধি নিষেধ ততুলে দিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যায় সাংগঠনিকভাবে অংশগ্রহণ নেয়া দল জামায়াত ইসলামীকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করে, পক্ষান্তরে স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ও তার নেতাকর্মীদের উপর নানা অত্যাচার, জেল, জুলুম ও হত্যার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকাটাই দুর্বিসহ করে তুলে এবং আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে বিচ্ছিন্ন, দুর্বল ও ভঙ্গুর করে ততুলে। প্রবাসে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সনে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে দেশে ফিরে আসলে আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষদের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার হতে থাকে। দেশের জনগণকে তাদের ভোট ও ভাতের অধিকার ফিরিয়ে দিতে দীর্ঘ ত্যাগ, শ্রম, সংগ্রামে জয় বাংলাজয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগানে অদম্য পথ পাড়ি দিয়ে স্বৈরাচারী সেনা সরকারদের বিরুদ্ধে দেশের মানুষকে সংগঠিত করে বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশের মানুষের প্রাণ প্রিয় নেত্রী হয়ে ওঠেন। ৭৫ এর বেনিফিসিয়ারি গোষ্ঠী ও স্বৈরাচারী সরকার কর্তৃক স্বাধীনতার মূল্যবোধকে ধুলিস্যাৎ করে দেশকে পাকিস্তানী ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়ার পথে বাঁধা হয়ে ওঠায় বাংলার আপামর জনতার প্রাণের প্রিয় নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর শেষ নিশানাটুকুও মুছে দিতে উদ্যত হয় তারা।

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানের খুব কাছে আটদলীয় জোটের মিছিলে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ ও বিডিআর গুলি ছোড়ে। পরের বছর ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট শেখ হাসিনা বাড়িতে থাকা অবস্থায় বুলেটগ্রেনেড ছোড়া হয় ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উপনির্বাচনে ভোট দেয়ার পর কেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে গাড়ি থেকে নামার পরপরই তার ওপর গুলি চালিয়ে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ১৯৯৪ সালে দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে রাজনৈতিক সফরে গেলে ২৩ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরদী ও নাটোর রেলস্টেশনে তার ওপর আবারও হামলা হয়। গুলি ছোড়া হয় তার সমাবেশে। ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর রাজধানীর রাসেল স্কয়ারে এবং ১৯৯৬ একই কায়দায় তার ওপর হামলা চালানো হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে। নিজ নির্বাচনী এলাকা গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়াতেও ভয়াবহ হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। পরম করুণাময় আল্লাহত তায়ালার অশেষ রহমতে গণমানুষের প্রিয়নেত্রী বারবারই কোন মতে বেঁচে যান। এবং গণমানুষের রায় নিয়ে ১৯৯৬সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পান। রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে স্বাধীনতার মূল্যবোধ সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসী হন। খুনি চক্রের ইনমেনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে আইনি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচারের পথ খুলে দেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে থাকেনি। ২০০০ সালে শেখ হাসিনার এক জনসভাস্থল ও হ্যালিপ্যাডে শক্তিশালী বোমা পুঁতে রেখে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল।

২০০১সালের নির্বাচনে ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে বিএনপি জামায়াত জোট, মন্ত্রীসভায় স্থান করে নেয় যুদ্ধাপরাধী নিজামী গং। তারপর থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ট পোষকতায় বঙ্গবন্ধু কন্যাকে হত্যার প্রচেষ্টা আরো জোড়ালো হয়। ২০০২ সালের ৪ মার্চ নওগাঁয় তাঁর গাড়িবহরে হামলা হয়। সাতক্ষ্মীরা থেকে যশোর ফেরার পথে বিএনপি অফিসের সামনে বাস রেখে ব্যারিকেড দিয়ে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে আবারো হামলা হয়। ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালের গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে আবারো গুলিবর্ষণ করে ঘাতকচক্র। চেষ্টা করা হয়েছে প্রশিক্ষিত নারী জঙ্গি দিয়ে মানববোমায় তাকে হত্যার। সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাচেষ্টা হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। ওই দিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে শান্তি সমাবেশস্থলে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়, ছোড়া হয় উপর্যুপরি ১৭টি শক্তিশালী আর্জেস গ্রেনেড। অল্পের জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও মহিলানেত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মীর প্রাণ ঝরে যায়। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ছত্রছায়ায় সংঘটিত নৃশংসতা, বিভৎসতা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ন্যাক্কারজনক অধ্যায় হয়েই থেকে যাবে। হত্যাকারীদের আড়াল করতে সেদিনের বিএনপি ও রাজাকার জোট সরকার জজ মিয়া নাটক সাজায়। কিন্তু, প্রকৃত ঘটনা বেশীদিন আড়াল করে রাখা যায়নি। সঠিক তদন্তে তৎকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফজ্জামান বাবর, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান, বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নান এদের এ বিভীষিকাময় গ্রেনেড হামলার ছক এঁকেছিল। বিএনপি ২১আগস্টে গ্রেনেড হামলা ও হত্যাকান্ডের দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি তারেক জিয়াকে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের পদে বসিয়ে পুরো দলটাকেই একটি সন্ত্রাসী দলে পরিণত করেছে। তারই ফলশ্রুতিতে এদেশের মানুষকে আগুন সন্ত্রাস, পেট্রোল বোমা ও জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারার মত নারকীয় তাণ্ডবের মুখোমুখি হতে হয়েছে। দেখতে হয়েছে হলি আর্টিসানের নির্মমতা। তারা এখনো থেমে থাকেনি নানামুখী ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে বারবার। এখনো তারা নানা অকার্যকর ইস্যুতে বাসে আগুন দেয়, প্রশাসনের উপর হামলা করে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট করে, জনগণের যানমালের ক্ষতি সাধন করে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণকে সাথে নিয়ে তাঁদের ষড়যন্ত্রকে বারবার রুখে দিয়েছে। ভবিষ্যতেও রাষ্ট্রবিরোধী, স্বাধীনতার মূল্যবোধ বিরোধী, শেখ হাসিনা বিরোধী যেকোন ষড়যন্ত্র রুখে দিতে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। খুনি, সন্ত্রাসী, জঙ্গীগোষ্ঠী ও তাদের মদদদাতারা যাতে আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে না পারে সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বেঁচে ছিলেন বলেই আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে পারছি। বঙ্গবন্ধুকন্যা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আছেন বলেই বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে আজ মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছে। যতদিন বঙ্গবন্ধু কন্যার হাতে দেশ, পথ হারাবেনা বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাই পারেন স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাতে ও বাস্তবায়ন করতে। বঙ্গবন্ধু কন্যার হাত ধরেই ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের অন্যতম উন্নত রাষ্ট্র। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয়তু শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখক: কোষাধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ ও সাবেক চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের দেশ নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন : কাদের
পরবর্তী নিবন্ধযারা ১৫ ও ২১ আগস্ট ঘটায়, মানুষ পোড়ায়, তাদের বর্জন করুন : তথ্যমন্ত্রী