প্রিয় সেহ্ঝিল,
শুভ জন্মদিন বাবা
২৪ এপ্রিল তোমার তৃতীয় জন্মদিন
আমার বেহেশতের পাখি আমার বাবা
শুভ জন্মদিন বাবাই
প্রিয় বাবা,
ঘুরেফিরে আবারো সেই ঢাকা। তুমি চলে যাবার পর ঢাকা শহরে না আসার ইচ্ছা ছিল। পুরো শহর জুড়ে তোমার স্মৃতি।
ঢাকা শহরে ২৩ দিন হয়ে গেল। এখন যেখানে আছি। স্কয়ার হাসপাতালের পাশে। আমাদের তিন জনের দিন কাটত এই সড়কে এই হাসপাতাল ঐ হাসপাতাল করে। মাঝে মাঝে আমি রাস্তার এ–মাথা থেকে ও–মাথা পর্যন্ত হাঁটি আর তোমাকে খুঁজি। পথ চলতি পথচারীরা দেখেন একটা মানুষ কেঁদে কেঁদে পথ চলছে। তাদের জিজ্ঞাস্যকে অগ্রাহ্য করে হাঁটি। মাঝে মাঝে তাদের জিজ্ঞেস করি, ‘আমার সেহ্ঝিলকে দেখেছেন?’ তাদের নির্বাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে ঢাকা শহরে তোমাকে খুঁজি। ভাবছ আমি পাগল হয়ে গেছি। হবে হয়ত। লোকে কি বলে এসব নিয়ে আর ভাবি না এখন।
আচ্ছা গ্রীন রোড … এখান থেকে শেখ হাসিনা বার্ন হাসপাতাল কতটুকু? কিংবা ইব্রাহিম কার্ডিয়াক? বারডেম হাসপাতাল?
ইদানিং এক দৌড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে শেখ হাসিনা বার্ন হাসপাতালে। তৃতীয় তলায় অপেক্ষমান শিশুদের মধ্যে হয়ত তোমার দেখা মিলতে পারে। যেদিন তোমার অপারেশন ছিল। সেদিন কি উৎকন্ঠাতে সেকেন্ডের পর সেকেন্ড পার করেছি। চোখের জলে চারদিক একাকার করে সময় পার করেছি। অপারেশন শেষে এইচডিউতে অন্যান্য বাচ্চাদের মত তুমি ঘুমিয়ে ছিলে না। ছোট ছোট চোখ দিয়ে চারদিক দেখছিলে আর আমাদের কাছে পাবার জন্য বার বার ডাকছিলে। এইচডিউর নার্সরা সেদিন খুব আশ্চর্য হয়েছিল। বারবার একটা কথা বলছিল ‘ব্রেভ বয়’(হ্যাঁ আমার সাহসী ছেলেটা আমাদের পেছনে ফেলে একা একা চলে গেছে অন্তিম পথে)। কিংবা বারো তলার সেই কেবিনে। যেখানে আমরা তিনজন টানা অনেকটা সময় কাটিয়েছি রাত দিন একাকার করে। ঘুম থেকে ডিভাইনে ডিম খাওয়া নিয়ে লুকোচুরি। আহা বাবা আমার।
কেমো ক্যানোলা ইঞ্জেকশন স্যালাইনের সুঁচে কখনো তোমার মুখ ম্লান হয়নি। দিব্যি হাসিখুশি থাকতে তুমি। হাজারো ব্যথার মাঝে তোমার হাসিখুশি মুখ। বিছানা ধরে ধরে হেঁটে হামাগুড়ি দিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে নীচের লনে বাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে তাল মেলাতে। হাসপাতালে বেডে বিকেলগুলোতে মায়ের সাথে খেলনা নিয়ে দিন কাটতো। ডাইনোসর খেলনাটা তোমার খুব প্রিয় ছিল। সারাক্ষণ ছোট ছোট দাঁত দিয়ে কামড়াতে। সকালবেলা অধীর আগ্রহে থাকতে কখন বাবার কোলে ঘুরে বেড়াবে। ঘুরতে ঘুরতে বিড়াল পাখি দেখলেই ছোট ছোট হাত দিয়ে তাদের কাছে ডাকতে। চোখে মুখে থাকত উজ্জ্বলতা।
ঢাকা আসলে আমি লুকিয়ে–লুকিয়ে চলি। স্মৃতিগুলো মনে পড়লে ইচ্ছা করে বহুতল ভবনের ছাদ থেকে এক লাফে অন্তিম পথে চলে যাই।
প্রিয় বাবাই, ঘোর করোনা কালে যখন আমরা সড়ক পথে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা গিয়ে সরাসরি ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হাসপাতালে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তুমি হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে পড়ো। চিৎকার কান্নাকাটি করে চারপাশের মানুষজন ভুলে গিয়েছিলাম। তোমাকে কোলে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে নিচে ইমার্জেন্সিতে যাবার কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হয়ে আসো। চোখ খুলে মায়ের কোলে বিশ্রাম নিয়ে আবার বাবার কাঁধে। সেখানকার নার্স ডাক্তার আর সিকিউরিটি গার্ডদের ভালোবাসা ছিল তোমার জন্য অপরিসীম। প্রতিদিন ড্রেসিং করার সময় সহ্য করতে পারতাম না বলে তোমার মাকে তোমার সাথে দিয়ে দরজার বাইরে চোখের জলে চারপাশ ভাসাতাম। ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে বাবার কোলে মাথা রেখে তোমার ফুঁপিয়ে কান্নার সাথে আমিও অশ্রু জলে কাপড় ভেজাতাম।
প্রিয় শেহরাজ. শেহরাজ নামটি তোমার মায়ের খুব পছন্দের ছিল। আমি ডাকতাম সেহ্িঝল ঝিলমিল। আমাদের চারপাশে ঝিলমিল করা তুমি চলে গিয়ে চারদিক অন্ধকারাছন্ন করে গেছ। অসুস্থ থাকাকালীন সময়ে এক দু দিন কিংবা পাঁচ–ছয় ঘন্টা পরপর তোমার ক্যানোলা নষ্ট হতো। ঢাকায় থাকাকালীন সময়ে আমরা থাকতাম পুরান পল্টনের মেট্রোপলিটন হোটেলে। আহা সেই দিনগুলো। উৎকন্ঠা আর ভালোবাসা একসাথে ছিল। ঘোর করোনাকালে পুরো দেশ লকডাউন হবার রাতে রওনা দিয়ে ভোরে পৌঁছেছিলাম ঢাকায়। তোমার প্লাটিলেট ভীষণরকম কমে যায়। বাসেই যোগাযোগ করি সুনীলদার সাথে। ঢাকা পৌঁছাবার আগেই তিনি ডোনারের ব্যবস্থা করে দেন। তখনও হাতে পায়ে কেনোলা তোমার। সেগুন বাগিচার বারডেম মা ও শিশু হাসপাতালে আমাদের ছিল নিত্য যাতায়াত। ভেইন ছোট হয়ে যাবার কারণে ওখানকার আইসিইউ নার্স ছাড়া তোমার কেনোলা কেউ করতে পারত না। হাসিখুশি ছেলেটা আমার বাইরে যাওয়ার সময় কত আনন্দে থাকত। মনে করত বেড়াতে যেত। কিন্তু প্রায় বারই হয় ডাক্তার হাসপাতাল নতুবা কেনোলা।
আমার ইদানিং বারডেম হাসপাতালে যেখানে তোমাকে নিয়ে যেতাম, সেখানে খুব যেতে ইচ্ছা করে। তোমাকে যখন নার্সরা ভেতরে নিয়ে যেতেন তখন তোমার ব্যাথাভরা চিৎকারে বাবা–মা দুজনেই চোখের জলে সিক্ত করতাম চারদিক। কেনোলা শেষে তুমি ভীষণ ভয়ে আমাদের জড়িয়ে ধরতে। আর আমাদের চোখের অশ্রু তোমার ছোট–ছোট কাপড়ে হারিয়ে যেত। এখনো তিন বছর পরেও আমাদের চোখের জলে তোমার ছোট ছোট কাপড় ভেজে। শুধু তুমি নেই।
প্রিয় ঝিলমিল,
আহা আমার বাবাই আমার বাপ। এসব কথা মনে হলেই হাউমাউ করে চিৎকার করে কেঁদে উঠি। এক টানা হাজার বছর কাঁদলেও এই কষ্ট শেষ হবে না। প্রতিদিন হাসপাতাল ফেরত এই ভাগ্যহত বাবা জায়নামাজে তোমার সুস্থতার জন্য খোদার কাছে আর্জি রাখত। পিতার মৃত্যুর বিনিময়ে পুত্রের সুস্থতার আর্জি থাকত। খোদা তার মিরাকল দেখাতে পারেননি। সরে গেছি নিত্য প্রার্থনা থেকে। শুধু বুকে রয়ে গেছে তোমাকে হারানোর হাহাকার।
বাপ আমার,
আজ আমি নিঃস্ব। আমার জীবনের সব সুখ আনন্দ চাওয়া আমি রেখে এসেছি আমার সেহ্িঝলের ছোট্ট ঘরে। এই জীবনে কিছুই চাওয়ার নেই। এখন শুধু তোমার কাছে যাবার অপেক্ষা।
তুমি খেজুর খেতে খুব ভালোবাসতে। ছোট ছোট দাঁত দিয়ে খেজুর খেতে। তোমার সেই কি আনন্দ হাসি আহ্লাদ। রমজান মাস আসলেই এই কথাটা খুব মনে পড়ে।
এখনো ইফতারে বরাবরের মত খেজুর থাকে। কিন্তু খাওয়া হয় না। নুডলস তোমার খুব প্রিয় ছিল। প্রিয় চিপস্ ছিল মিষ্টার টুইষ্ট। আমাদের কত প্ল্যান ছিল বাপ বেটা মিলে মন ভরে একদিন চিপস্ খাবো। তোমাকে হারানোর সাথে প্রিয় সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি।
প্রিয় সেহ্িঝল,
‘আমিই শুধু রইনু বাকি
যা ছিল তা গেল চলে, রইল যা তা কেবল ফাঁকি’
গ্রামের বাড়িতে আমার দাদির পাশে ছোট্ট ঘরে আজ তুমি অনন্ত পথে। তোমার ছোট্ট ঘরের কাছে গেলে.. ইচ্ছে করে মাটি ভেদ করে তোমার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ি। দু’হাতে জড়িয়ে ধরি। এ–বন্ধন এত দৃঢ় যে কেউ ছিন্ন করতে পারবে না।
সময়ে অসময়ে আমার চোখ আর মন চলে তোমার শিয়রে। কিভাবে শুয়ে আছো তুমি। হাত পা ছড়িয়ে তুমি খুব আরাম করে ঘুমোতে। আর আমি তোমার পাশে শুয়ে তোমার বুকের হাতের পায়ের গন্ধ শুকতাম। ছোট কোল বালিশে তুমি আরাম করে ঘুমোতে।
প্রিয় বাবাই,
চোখের জলে ঝাপসা হয় চারদিক সে দিন কিংবা রাত..
তবুও…
‘আমারে যে জাগতে হবে,
কী জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে’
কারণ সন্তান হারানো ক্রুশবিদ্ধ পিতা আমি। এই দুঃখময় ক্রুশ আমাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে কাফন পড়ানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত।
ভালো থেকো
খুব তাড়াতাড়ি তোমার সাথে দেখা হবে
অনেক ভালোবাসা
‘বাবা’