রক্তস্নাত একুশে ফেব্রুয়ারির গৌরবময়তা দেশ ছাড়িয়ে আজ বিশ্ব পরিমণ্ডলে স্থান করে নিয়েছে। চেতনা ও মর্যাদার দিক দিয়ে আমাদের ভাষা আন্দোলন ছিলো বহুমাত্রিক মর্যাদার অধিকারী। আজ দেশে দেশে সমাদৃত আমাদের একুশে ফেবু্রয়ারি। এর পেছনে কারণ ছিলো আমাদের জাতিসত্তা, সংস্কৃতি, মুক্তবুদ্ধিচর্চা আর হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যগত বিষয়ভিত্তিক জাতিগত প্রেরণা।
সত্তর বছর পেরিয়ে রক্তে রাঙানো একুশে ফেবু্রয়ারি আবারো আমাদের জীবনে এসেছে। আমরা জানি, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক আনন্দ বেদনার এক হৃদয়গ্রাহী ছবি উপহার দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার ইতিহাসের সূচনা হয়েছে। বাঙালি জাতি একটা গর্বিত জাতি হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
ভাষার জন্য নিজেরা লড়েছে। জান দিয়েছে। দেশের জন্য প্রাণপণে লড়াই করে নয়মাসে পরাজিত করেছে পাকসেনাদের। এরকম ইতিহাস কম জাতিরই আছে। মূলত ভাষা আন্দোলনকে ঘিরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক চেতনা, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের নানা ভাবনা চিন্তা প্রসার লাভ করেছে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য নেতৃত্বে বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়ে এদেশের দামাল ছেলেরা বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো।
তাদের সে অবদানের কোনো তুলনা নেই। ভাষা আন্দোলনে সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত এর আত্মদানের কথা বাংলার জনগণ চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। ফলে এদেশের জনগণের কাছে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অসীম।
একে কেবল ভাষা আন্দোলন বলা ভুল বলা হবে। এতে করে নিহত শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বীজ বপিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। অমর একুশে ফেব্রুয়ারির এই রক্তক্ষয়ী দিনটির পেছনে লেখা হয়ে যায় নানা ইতিহাস। নানা সংগ্রাম ও প্রেক্ষিত। যা আমাদের পথ দেখায় নূতন উদ্দীপনায়। নুতন চেতনায় আমরা পথ চলতে থাকি। আমরা এখন আমাদের ভাষায় কথা বলি। লিখি পড়ি এই ভাষাতেই।
আমাদের অগ্রজরা আমাদের দিয়ে গেছে রক্তের ঋণ। ভাষার স্বাধিকার আমরা পেয়েছি একুশে ফেব্রুয়ারির প্রবল আন্দোলনের মুখেই।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন মূলত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে আন্তর্জাতিক পরিচিতি পাওয়ায় দিনটি ঐতিহাসিক ভাবেই ২১ ফেব্রুয়ারি হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে। কারণ, আন্দোলনের সময় কোথাও ৮ ফাল্গুন লিখা না থাকায় এ পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। যা একুশে ফেবু্রয়ারির ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
২০০০ সালেই ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বাংলাদেশের মর্যাদা আরো বেড়ে যায় বিশ্ব পরিমণ্ডলে। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ইতোপূর্বে বিশ্বের অপরাপর ৪ হাজার ভাষাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
একুশে ফেবু্রয়ারির এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকে নূতন করে জানতে শুরু করে। ২০০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে সূচিত দিবসটির মাধ্যমে বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বিশ্বের দরবাওে আরো সমাদৃত হয়। সেই সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একই সময়ে দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। এইজন্যই বলা যায়,রক্তস্নাত একুশে ফেব্রুয়ারির গৌরবময়তা দেশ ছাড়িয়ে আজ বিশ্ব পরিমন্ডলে স্থান করে নিয়েছে। কারণ, ভাষার জন্য জীবন বাজি রেখে রক্ত দিয়েছে এমন ঘটনা পৃথিবীতে সত্যিই বিরল।
বিশ্বে একমাত্র বাঙালি জাতিই বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের ঐতিহ্যকে টেনে নিয়ে গেছে বহুদূর। একুশে ফেবু্রয়ারিকে ঘিরে আমাদের বাংলা সাহিত্য হয়েছে অনেক সমৃদ্ধ। কারণ, আমাদের মুখের ভাষা বাংলা। লিখার ভাষা বাংলা। আমাদের সাহিত্য চর্চাও হয় এই এই বাংলা ভাষায়। বাংলা আমাদের অনুপ্রেরণা।
যুগে যুগে সময়ে সময়ে আমাদের কবি সাহিত্যিকেরা রচনা করেছে অনেক কালজয়ী সাহিত্য। একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই তেমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য রচিত হয়েছিলো। মাহাবুবুল আলম চৌধুরী রচিত ১২০ লাইনের দীর্ঘ কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ প্রথম কবিতাটি ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে বহুকাল ধরে।
এ সময় হাসান হাফিজুর রহমান লিখেন ‘অমর একুশে’ কবিতাটি। পরবর্তীতে শামসুর রাহমান বর্ণমালা,আমার দুঃরিখনী বর্ণমালা, আর যেন না দেখি, আল মাহমুদের ‘নিদ্রিতা মায়ের নাম’ ফেবু্রয়ারির একুশ তারিখ,কবি আবু জাফর ওবায়দল্লাহ কোন এক মাকে, সৈয়দ শামসুল হকের ’আরো একজন’,আহসান হাবীবের একুশে ফেবু্রয়ারি, শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘শহীদ মাকে’,আনিুসজ্জামানের ‘তারা’, ফজল শাহাবুদ্দীনের ‘আত্মা থেকে একটি দিন’ শহীদ কাদরীর ‘একুশের স্বীকারোক্তি’ রফিক আজাদের ‘পঞ্চানন কর্মকার’, হুমায়ুণ আজাদের ‘বাংলা ভাষা’ নির্মলেন্দু গুণের ‘আমাকে কি মাল্য দেবে দাও’ ‘তোমরা কি জানো’ গ্রন্থগুলো একুশের গ্রন্থ হিসেবে যথেষ্ট আলোড়িত, আলোচিত সমাদৃত হয়েছে।
এই অসাধারণ গ্রন্থগুলোর কথা আমাদের সবাইকে জানতে হবে। ধারণ করে রাখতে হবে হৃদয়ের অভ্যন্তরে। তাই বাংলা ভাষায় রচিত বই আমরা যতো বেশি পড়বো একুশের মর্যাদাকে ততো বেশি আমরা সম্মান জানাতে পারবো।
আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ও শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি জগৎ শ্রেষ্ঠ গান হিসেবে কালজয়ী গান। একুশে ফেবু্রয়ারির ওপর প্রথম উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’ লিখেছিলেন জহির রায়হান।
আলোড়িত এই উপন্যাসটি পঞ্চাশের দশকে ছাপা হয়ে বই আকারে প্রকাশ পায় ১৯৬৯ সালে। জেলখানার ভেতরে থেকেই ১৯৫৩ সালের ১৭ জানুয়ারি শহীদ মুনীর চৌধুরী জেলখানায় বন্দী অবস্থায় লিখে ফেলেন একুশকে নিয়ে লেখা প্রথম নাটক ‘কবর’। শওকত ওসমানের আর্তনাদ, সেলিনা হোসেনের ‘নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি’ ও যাপিত জীবন এবং আহমদ ছফার ওঙ্কার ছিলো একুশের চেতনাকে ধারণ করে রচিত একেবারে জীবন্ত কিংবন্তীসম উপন্যাস। একুশের ইতিহাসের কাছাকাছি যেতে হলে অনেক বেশি বই পাঠে মনোনিবেশ করতে হবে লেখক পাঠক সবাইকে। বাড়াতে হবে শুব্ধ করে বাংলা লিখা ও পড়া চর্চা ।
একুশকে ঘিরেই মাস ব্যাপী বইমেলা আজ অপার মহিমায় ভাস্বর হয়ে ধরা দেয় আমাদের সবার জীবনে। তবে ইতিহাসের পাদপীঠে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রজন্মকে অনেক বেশি বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় ধাবিত হতে হবে।
বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের সম্মান জানানোর প্রসঙ্গটি আমাদের আজকের নবাগত শিশুদের মাঝে তুলে ধরতে হবে। তাহলেই আমরা মাতৃভাষা ও জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে একুশের মর্যাদার জায়গাটাকে পরিপূর্ণ করে অনেক বেশি সমুন্নত রাখতে সক্ষম হবো। এই উদ্দীপ্ত চেতনাকে আমাদের সঠিক ভাবে লালনের মাধ্যমে বাংলা বর্ণমালা ও ভাষার শুদ্ধতা বজায় রাখতে হবে। আসুন সবাই শুদ্ধ বাংলা চর্চা করি। একুশের মর্যাদাকে অক্ষুণ্ন রাখি।
লেখক : কবি, শিশুসাহিত্যিক, কলাম লেখক