শুটকি উৎপাদন বাড়াতে মাছি বন্ধ্যাকরণ প্রযুক্তি

কলাতলীতে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয়েছে গবেষণাগার

কক্সবাজার প্রতিনিধি | মঙ্গলবার , ২৩ মার্চ, ২০২১ at ৭:৩১ পূর্বাহ্ণ

এবার গবেষণাগারে উৎপাদিত বন্ধ্যা মাছি দিয়েই দমন করা হবে শুটকির জন্য ক্ষতিকারক বন্য মাছি। আর এ বন্ধ্যাকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করেই মাছি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কক্সবাজারে শুটকির উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তারই লক্ষ্যে ইতোমধ্যে শহরের কলাতলীস্থ সৈকত খনিজ বালি আহরণ কেন্দ্রে প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয়েছে একটি গবেষণাগার ও প্রযুক্তি কেন্দ্র। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের উদ্ভাবিত এই পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিবছর শুটকির উৎপাদন প্রায় এক তৃতীয়াংশ বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১২ লাখ মেট্রিক টন (১.২মিলিয়ন টন) সামুদ্রিক ও স্বাদু পানির মাছ উৎপাদিত হয়। যার মধ্যে প্রায় ১৫% মাছকে সূর্যের তাপে শুকিয়ে শুটকিতে রূপান্তর করা হয়। তবে মাছ রোদে শুকানোর সময় লিওসিনিয়া কাপ্রিয়া (ষঁপরষরধ পঁঢ়ৎরহধ) নামের এক প্রজাতির ক্ষতিকারক মাছির আক্রমণে প্রায় ৩০% শুটকিই নষ্ট হয়ে যায়। এরমধ্যে দেশের বৃহত্তম শুটকি মহাল নাজিরারটেকেই নষ্ট হয়ে যায় বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার শুটকি। আর এই মাছির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য শুটকি উৎপাদকরা মাছে বিষ প্রয়োগ করছে অথবা অতিরিক্ত লবণ প্রয়োগ করছে। যার ফলে ভোক্তা ও উৎপাদক উভয়েরই স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। আবার শুটকির গুণগত মানও কমে যাচ্ছে এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যার দরুন বাজার মূল্য কমে যাচ্ছে এবং বিদেশে রপ্তানি করা যাচ্ছে না। এসব বিবেচনা করে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ঝঃবৎরষব রহংবপঃ ঃবপযহরয়ঁব (ঝওঞ) বা মাছি বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে শুটকি মাছের ক্ষতিকর পোকা দমনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে বলে জানান পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান খাদ্য ও বিকিরণ জীববিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের বিকিরণ কীটতত্ত্ব ও মাকড়তত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. এটিএম ফয়েজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, বন্ধ্যাকরণ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষতিরকারক মাছির বংশ কমিয়ে শুটকির উৎপাদন ও গুণগত মান বৃদ্ধি করা সম্ভব। এই পদ্ধতিটি পরিবেশ বান্ধব, টেকসই, সহজ ও সাশ্রয়ী। এই পদ্ধতির মাধ্যমে উৎপাদন করলে বিষমুক্ত ও নিরাপদ শুটকি উৎপাদন সম্ভব হবে। এতে দেশীয় বাজারে শুটকির চাহিদা যেমন বেড়ে যাবে তেমনি এই বিষমুক্ত ও নিরাপদ শুটকি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব।
ড. ফয়েজুল বলেন, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তি হলো এক ধরনের জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে কোনো এলাকায় বন্য মাছির কয়েকগুণ বন্ধ্যা মাছি ছাড়া হয়। এরপর বন্ধ্যা মাছির সাথে ক্ষতিকর মাছির মেলামেশায় যে ডিম জন্ম হয়, তা থেকে আর বাচ্চা ফোটে না। এভাবে ধীরে ধীরে সেই মাছির বংশ কমে যায়। তবে ক্ষতিকর মাছির নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি দুই মাস অন্তর একবার করে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে।
তিনি জানান, এ পদ্ধতিটি সম্প্রসারণের জন্য ইতোমধ্যে দেশের বৃহত্তম শুটকি মহাল নাজিরারটেকের শুটকি ব্যবসায়ীদের উদ্বুদ্বকরণ শুরু হয়েছে। এরই আওতায় শনিবার শহরের কলাতলীস্থ সৈকত খনিজ বালি আহরণ কেন্দ্র ক্যাম্পাসে অবস্থিত ‘পোকা বন্ধ্যাকরণ ইউনিটে’ এই প্রযুক্তি সম্পর্কে এক অবহিতকরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মৎস্য বিজ্ঞানী, শুটকি ব্যবসায়ী, সমাজকর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ দমনের জন্য প্রায় ৭ দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র উদ্ভাবিত এমনই এক বন্ধ্যাকরণ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর আগে ১৯৯৮ সালে সোনাদিয়া দ্বীপে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শুটকি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাফল্য পাওয়া যায় বলে জানান বিকিরণ কীটতত্ত্ববিদ ড. এটিএম ফয়েজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, আগে কঙবাজারে এই ইউনিট ছিল না। তাই ঢাকা থেকে কঙবাজারে মাছি এনে তা সোনাদিয়ায় নিয়ে যাওয়া ছিল অনেক কষ্টসাধ্য বিষয়। এখন সরকার কঙবাজারবাসীর জন্য প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি কেন্দ্র করে দিয়েছে। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে কঙবাজারের শুটকি ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেই সরকারের প্রচেষ্টা সার্থক হবে।
কঙবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান বলেন, বিষমুক্ত অর্গানিক শুটকি উৎপাদনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বিএফআরআই’র বিজ্ঞানীরাও একটি মেকানিক্যাল টেকনিক উদ্ভাবন করেছে। যে টেকনিক ব্যবহার করে কয়েকটি ফ্যাক্টরি শুটকি উৎপাদন করে সাফল্য পেলেও এটি ব্যয়সাধ্য হওয়ায় এখনো শতভাগ খামারে ব্যবহৃত হচ্ছে না। তবে পরমাণু শক্তি কমিশন উদ্ভাবিত এই জৈব প্রযুক্তি দিয়ে সহজে মাছি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলে কঙবাজারে শুটকি উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি মাইল ফলক হয়ে থাকবে।
বিজ্ঞানীরা জানান, নাজিরারটেক শুটকি মহালে চার প্রজাতির মাছি দেখা যায়। এরমধ্যে মাত্র লিওসিনিয়া কাপ্রিনা প্রজাতির মাছিই শুটকিতে ডিম পেড়ে শুটকি নষ্ট করে দেয়। আর এই প্রজাতির মাছিটিকে বন্য পরিবেশ থেকে ধরে এনে গবেষণাগারে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে গণ উৎপাদন করা হয়। ডিম থেকে শুককীট, এরপর পিপাসহ চারটি পর্যায় অতিক্রম করে মাছি পূর্ণ বয়স্কতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু পুরুষ মাছিগুলোকে তৃতীয় পর্যায়ে বা পিপা পর্যায়ে থাকা অবস্থায় গবেষণাগারে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ গামা ও এঙ-রে রশ্মির বিকিরণ প্রয়োগ করা হলে তারা বন্ধ্যা হয়ে যায়। কোনো এলাকাকে ক্ষতিকর মাছি মুক্ত করার জন্য এই মাছির দ্বিগুণ বা তারও বেশি সংখ্যায় বন্ধ্যা মাছি ছেড়ে দেয়া হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসিরিজ বাঁচানোর কঠিন মিশন আজ টাইগারদের
পরবর্তী নিবন্ধকরোনার কাছে হার মানলেন কবি ও শিল্পী খালিদ আহসান