চট্টগ্রাম জেলার প্রায় গ্রামাঞ্চলেই এক সময় সারি সারি খেজুর গাছ ছিল। এখন সে রকম আর নজরে পড়ে না। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে বহুবিধ উপকারি এই গাছ এবং সে গাছের রসের নানান উপকরণ। অবশিষ্ট কিছু এলাকায় এখনো যে কিছু সংখ্যক গাছ আছে তাও অবহেলিত নানাভাবে।
চট্টগ্রামের গ্রামীণ জনপদের মধ্যে অন্যতম প্রধান জনপদ মীরসরাই উপজেলার কিছু এলাকায় এখনো কিছু খেজুর গাছ রয়েছে কিন্তু তাও দিনে দিনে বিলুপ্তির পথে। পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, এভাবে চলতে থাকলে আগামী দুয়েক দশকের মধ্যেই শীত এলে আর কোথাও খেজুরের রস পাওয়া যাবে না। কারণ গ্রাম বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও গ্রামীণ ঐতিহ্যের বাহক এবং উপাদেয় সুস্বাধু খেজুরের রস প্রাপ্তির এই মাধ্যম এখন বিলুপ্তির পথে। আর বনবিভাগ বা কৃষিবিভাগ কেউ এই গাছটির বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিগত দিনে। অথচ আমাদের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চল, উপকূলসহ পাহাড়ের ঢালু ও পতিত জমিতে অনায়াসেই এই খেজুর গাছ রোপণের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বৃক্ষ রোপণের মৌসুম এলেই এটি বেমালুম সকলেই ভুলে যান। তবে শীত মৌসুম এলেই খেজুর গাছের কদর আর প্রয়োজনে সবার মনে পড়ে যায় এই উপকারী বৃক্ষের কথা।
চট্টগ্রাম জেলা উপ–সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসানের কাছে জানতে চাইলে বলেন, ২০২২–২৩ অর্থবছরে চট্টগ্রামে নতুন করে ১৯৫ হেক্টর জমিতে খেজুর গাছ আবাদ হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কতটি খেজুর গাছ বর্তমানে রয়েছে এবং ১০ বছর পূর্বে কতটি ছিল তার কোনো হিসেব কৃষি বিভাগের কাছে নেই বলে জানান তিনি। বিভিন্ন উপজেলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কৃষি সুপারভাইজার স্বীকার করেন, খেজুর গাছ বিতরণ কার্যক্রম কেবল কাগজপত্রে সীমাবদ্ধ, বাস্তবে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
মীরসরাই উপজেলার কৃষি সুপারভাইজার কাজী নুরুল আলম বলেন, বর্তমানে মীরসরাই উপজেলায় প্রায় ৫ হাজার খেজুর গাছ রয়েছে। দশ বছর পূর্বে অন্তত ১০ হাজার খেজুর গাছ ছিল। তবে এখানে অর্থনৈতিক জোনের কারণে সহস্রাধিক খেজুর গাছ বিলুপ্ত হয়েছে। আবার চারা লাগানো হয়েছে কিনা এর উত্তরে তিনি বলেন, কিছু খেজুর গাছ বিতরণ করা হয়েছিল। কিছু আমাদের অফিসে এখনো রয়েছে।
হাটহাজারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আল মামুন সিকদার বলেন, হাটহাজারীতে আগের তুলনায় খেজুরগাছ অনেক কমে গেছে। বিষয়টি মাথায় রেখে আমার অধিদপ্তর থেকে ইতিমধ্যে ৬–৭শ খেজুর গাছ উপজেলার বিভিন্ন সড়ক ও পুকুর পাড়ের পরিত্যক্ত জায়গায় রোপণ করেছি। ঠিক এভাবে মীরসরাই, সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, সন্দ্বীপসহ চট্টগ্রামের সকল উপজেলায় খেজুর গাছ রোপণে এগিয়ে আসা উচিৎ।
গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম জেলায় বর্তমানে ৫০ হাজার খেজুর গাছ অবশিষ্ট আছে। দশ বছর পূর্বে এর সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত, কেবল এই চট্টগ্রামেই অন্তত ২০ লক্ষাধিক খেজুর রসের ভোক্তা রয়েছে। বাড়ছে চাহিদা। কিন্তু যোগান বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তাকে কাজে লাগাচ্ছে না কেউ।
গত মঙ্গলবার মীরসরাই উপজেলার উপকূলীয় ১৬ নম্বর সাহেরখালী নিকটবর্তী বগাচতর গ্রামে গিয়ে দেখা মিলে বেশ কয়েকজন গাছির। মাহবুব আলম (৫২) ও আমজাদ হোসেন (৪৫) জানান, আমরা কয়েকজন মিলে এই বেড়িবাঁধের প্রায় ১০০টি খেজুর গাছে হাঁড়ি বসাই প্রতি বছর। ২৪ হাজার টাকা খাজনা দিয়ে বেড়িবাঁধের উপর এই খেজুর গাছগুলো শীতের শুরুতে তৈরি করি। গাছের মাথায় গাছের ছাল আর ঢালপালা ছেটে এখন থালি তৈরি করার সময় জানায় আরো সপ্তাহ খানেক পর রস নামতে শুরু হবে। তবে ভাল রস পেতে দুই সপ্তাহ লাগতে পারে। গাছি আমজাদ বলেন, গড়ে দুইশ লিটার রস পাই এইসব গাছ থেকে। কখনো ৩০০ লিটার পর্যন্ত। অনেকে এখানে এসেই রস নিয়ে যায়। কখনো আমরা চট্টগ্রাম শহরে ও চালান করে থাকি। প্রতি লিটার রস ৬০ থেকে ৭০ টাকা করে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার রস বিক্রি হয়। খরচ গিয়ে অর্ধেকের মতোই লাভ থাকে। এতে প্রতি মৌসুমে লক্ষ টাকা করে বাড়তি আয় হয় আমাদের।
বছরের অন্যান্য সময় কি কাজ করেন জানতে চাইলে অপর গাছি মাহবুব আলম (৫২) বলেন, আমরা সাধারণত প্রান্তিক কৃষক। নিজের জমি আর বর্গা জমি চাষ করে থাকি। পাশাপাশি মৌসুমী সবজি, ধান ইত্যাদি চাষাবাদ করি। খেজুর গাছে আমাদের বছরের মৌসুমী বাড়তি রোজগার। তারা জানান, এই একটি এলাকাতেই একসময় দুই শতাধিক খেঁজুর গাছ ছিল। গত বছরও আরো ২০টি গাছ বেশি ছিল। নতুন গাছ আর না উঠায় বজ্রপাতে বা প্রাকৃতিকভাবে মরে যাওয়া গাছ আর নতুন করে লাগানো হচ্ছে না বলে কমে যাচ্ছে দিন দিন।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, খেজুর রস প্রচুর খনিজ ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। এতে ১৮–২০ শতাংশ দ্রবীভূত শর্করা থাকে। এই রস দিয়ে গুড় উৎপাদিত হয়। এই গুড় সুমিষ্ট, পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু। খেজুর গুড়ে প্রোটিন, ফ্যাট ও মিনারেল থাকে। খেজুর রসের স্বাস্থ্যগুণ থাকলেও সেই রস চট্টগ্রামের সব ভোক্তা পান না সরবরাহের অভাবে। গ্রামাঞ্চলে এখন আর আগের মতো খেজুর গাছ নেই। সীতাকুণ্ড ও মীরসরাই উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় কিছু গাছ থাকলেও সেই গাছ থেকে সংগৃহীত রস দিয়ে চট্টগ্রামের ভোক্তাদের চাহিদা মেটে না। আবার বিলুপ্ত গাছ হিসেবে খেজুর রসের স্বাদই পায়নি অনেক উপজেলার শিশুরা। তাদের কাছে খেজুরগাছ এবং রসের স্বাদ এমন শুধুই গল্প। খেজুর গাছ প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে এমন উপজেলার একটি বোয়ালখালী। উপজেলার বাসিন্দার মোহাম্মদ আলী বলেন, ছোটবেলায় আমাদের খেজুরগাছ ছিল ১০টি। এখন একটিও নেই। পুরো পাড়ায় কারও নেই। তাই সর্বশেষ খেজুর রস দিয়ে ভাপা পিঠা কবে খেয়েছি মনে করতে পারছি না।
খেজুর গাছ কমে যাওয়ার বিষয়ে বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, খেজুরগাছ বনের গাছ নয়। গ্রামীণ জনপদের বাসিন্দারা রাস্তার ধারে কিংবা নিজস্ব উঁচু জমিতে পরিচর্যার মাধ্যমে খেজুরগাছ লালন করেন। এখন সময়ের বিবর্তনে খেজুর গাছ কমে গেছে এটা ঠিক। কিন্তু উপকারী এই গাছটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য বন বিভাগের পাশাপাশি সামাজিক উদ্যোগও প্রয়োজন রয়েছে।