করোনার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের বিপন্নতার সম্পর্ক এখন সর্বজনস্বীকৃত। ল্যানসেটের সম্পাদক ড. রির্চাড হর্টন তাঁর ‘কোভিড-১৯ ইজ নট অ্যা প্যানডেমিক’ শীর্ষক বিশেষ নিবন্ধে বলেছেন, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক অতিমারি বা প্যানডেমিক নয়, বরং এটি সিনডেমিক। কমপক্ষে দুই ধরনের রোগ বা সমস্যা যদি মহামারি (এপিডেমিক) হিসেবে আবির্ভূত হয়ে কোনো বিপুল সংখ্যক মানুষের স্বাস্থ্যের (স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্য) ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তবে তাকে সিনডেমিক বলা যায়। মহামারির কারণে আর্থ-সামাজিক বড় ধরনের পরিবর্তনও সিনডেমিক হতে পারে।
এদিক দিয়ে শিশুদের মানসিক অবস্থা দুঃসহ। করোনাকালীন দীর্ঘসময় শিশু-কিশোররা টানা ঘরবন্দি। ফলে বন্ধুবান্ধব ছাড়া নিঃসঙ্গ হয়ে দিন অতিবাহিত করছে তারা। এতে তারা বাবা-মা বা পরিবারের অন্যদের বেশি কাছে পেতে চায় কিন্তু কর্মজীবী বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন বলে মনে হয় না। এতে তাদের ভেতরে অসহায়ত্ব আরও বেড়ে যাচ্ছে। বলা যায়, ঘরে বসে থেকে শিশু একাকীত্বে ভুগছে। শিশুর বুদ্ধির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘদিনের আবদ্ধ অবস্থা শিশুর সকল ধরনের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। একটা শিশু যখন হাঁটতে শেখে, কথা বলতে, দৌড়াতে শেখে, ছবি আঁকে, নাচে এইসব জিনিস শিশুর বিকাশের একটা অংশ। শিশুর সকল ধরনের বিকাশ, বুদ্ধির বিকাশ এই পরিস্থিতিতে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া শিশুর সময় কাটানোর জন্য আরেকটা শিশুর দরকার হয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, শিশুর পুষ্টির অভাব হলে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকবে। আর অন্যদিকে আরেকটি শিশুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ শিশুরা সবচেয়ে বেশি পায় স্কুলে, প্রতিবেশী এবং আত্মীয়দের পরিবারে। সেই সুযোগ তার একেবারেই কমে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দীর্ঘসময় ধরে শিশুর স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিশু একদিকে শিক্ষাগত দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যদিকে তার সকালের সময় অর্থবহভাবে কাটাতে না পারায় তারা শারীরিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দীর্ঘসময় ধরে টিভি, মোবাইল ব্যবহারে শিশুর শারীরিক ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে যা ওবেসিটিতে (স্থূলকায় শিশু) রূপ নিচ্ছে। শিশুর ওবেসিটির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে অনেক জটিল রোগ হয়ে থাকে যা এখন পরিলক্ষিত না হলেও পরবর্তীতে তার প্রভাব পড়তে পারে। সেদিকে বাবা-মাকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
তাঁরা বলেন, সচ্ছল পরিবারে শিক্ষামূলক বিনোদনের নানা রকম সুবিধা থাকলেও অসচ্ছল পরিবারে তা থাকে না। এ পরিস্থিতিতে অসচ্ছল পরিবারের বাবা-মা ও অভিভাবকের চিন্তা তুলনামূলক বেশি। চলমান পরিস্থিতিতে শিশুদের মনোজগতে নানা ধরনের মানসিক চাপ ও হতাশা তৈরি হতে পারে। রুটিনে না থাকলে নিয়মানুবর্তিতার সংকটে পড়তে পারে। এসব সমস্যা থেকে ব্যক্তিত্বের সমস্যাও হতে পারে। সেটা থেকে কারও কারও হতাশা চরম আকার ধারণ করে কিনা সংশ্লিষ্টদের এদিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। বর্তমান সংকট মোকবিলায় শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিভাবকদের বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে। শিশুদের হতাশা দূর করতে ঘরের ভেতরে খেলাধুলার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ছাড়া অনলাইনে ও টেলিভিশনে শিশুতোষ নানা কর্মসূচি থাকে। তারা সেসবে অংশ নিতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু তাঁর এক লেখায় বলেছেন, করোনার সংক্রমণের মধ্যে অনেক অভিভাবক তাদের প্রয়োজনে বাইরে বের হলে ঝুঁকির কথা ভেবে তাদের সন্তানদের ঘরেই রাখছেন। বেশিরভাগ সময় শিশু বিকালে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছে না এবং খেলাধুলা করতে পারছে না। নিঃসঙ্গতার কারণে এ সময় অনেক শিশু-কিশোরদের মধ্যে আচার-আচরণে পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। অনেক সময়ই তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। তারা বাবা-মায়ের কথার অবাধ্য হচ্ছে। শিশুর মানসিক বিকাশে বাধা পড়ছে। বিশেষ শিশুদের হাইপার অ্যাকটিভিটি (অতি চঞ্চলতা) আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই এ সময়ে শিশুর মানসিক দিকটি বিশেষ গুরুত্বসহ বিবেচনা করতে হবে। ভয়ংকর এ ব্যাধির কারণে আমাদের চারপাশে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে বা হচ্ছে তার জন্য কেউ আগেভাগে প্রস্তুত ছিল না। আর্থিক, সামাজিক ও পারিবারিক সব ক্ষেত্রেই নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এসব সমস্যার কারণে সন্তানের ওপরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যাতে নেতিবাচক কোনো প্রভাব না পড়ে, সে বিষয়ে অভিভাবকদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এসব সংকটের কারণে সৃষ্ট নেতিবাচক ঘটনা শিশু-কিশোরকে দীর্ঘমেয়াদে কোনো কুফল বয়ে আনতে পারে।