শিশু কীভাবে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়–
একধরনের অতি ক্ষুদ্র গ্রাম পজেটিভ ব্যাকটেরিয়া-‘মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলেসিস’ বা ‘মাইকোব্যাকটেরিয়াম বোভিস’ নামক জীবাণু দ্ধারা যক্ষ্মারোগের উৎপত্তি। পরিবারে কিংবা প্রতিবেশি বড়দের কেউ যক্ষ্মায় ভুগলে, তার সাথে যে শিশুর মেলামেশা হয় সাধারণত সে শিশুটির যক্ষ্মারোগ হবার ঝুঁকি থাকে। যক্ষ্মাক্রান্ত লোকের হাঁচি–কাশির মাধ্যমে যক্ষ্মার জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। শিশু তার সংস্পর্শে এলে, তা তার ফুসফুসের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। গর্ভাবস্থায় মা যক্ষ্মারোগে ভুগলে, নবজাত শিশুও এই রোগ সাথে নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে।
১. ফুসফুসের যক্ষ্মা–
যদিও শিশুদের যক্ষ্মার অধিকাংশই (প্রায় তিন–চতুর্থাংশ) ফুসফুসে হয়ে থাকে, কিন্তু প্রথমদিকে তা নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন। এতে শিশুর খিদে লোপ, ওজন কমতে থাকা, স্বল্প মাত্রার দীর্ঘমেয়াদি জ্বর, দীর্ঘমেয়াদি কাশি, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি সাধারণ কিছু লক্ষণাদি দেখা যায়, কখনো কখনো তাও থাকে না।
যক্ষ্মার জীবাণু ফুসফুসে প্রবেশ করার পর তৈরি হয় ‘প্রাইমারি কমপ্লেক্স বা ঘ্যন্ কমপ্লেক্স’। প্রায় ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে এই কমপ্লেক্স শুকিয়ে সেরে যায়। কিন্তু শিশুর শরীরে রোগ–প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে, যেমন– অপুষ্ট শিশু, হাম বা হুপিংকাশিতে আক্রান্ত শিশু, এই কমপ্লেক্স না শুকিয়ে নানা জটিলতাসহ উপসর্গের সৃষ্টি করে। অথবা পূর্বের শুকানো স্পট নতুন করে আত্মপ্রকাশ করে, যার কারণে নিউমোনিয়া, ‘প্ল্লুরেল ইফিউশান’(বুকে পানি জমা), হতে পারে। এই অবস্থায় শিশুর শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
বুকের এক্স–রে করার সাথে সাথে, টিউবারকুলিন টেস্ট ও বুকের পানি নিয়ে পরীক্ষা করে টিবি-‘প্লুরেল ইফিউশান’ নির্নয় করা হয়।
২. মস্তিষ্কের যক্ষ্মা– শিশুদের যক্ষ্মার প্রায় ২০ শতাংশ মস্তিষ্কের টি.বি–রূপে হয়ে থাকে। এটা সবচেয়ে মারাত্মক রকমের যক্ষ্মারোগ। অবশ্য, প্রথম পর্যায়ে রোগ–নিরূপণ করে চিকিৎসা করা গেলে প্রায় ১০০ ভাগ ক্ষেত্রেই রোগী আরোগ্যলাভ করার সম্ভাবনা। টি.বি মেনিনজাইটিস–এর লক্ষণসমূহ তিন পর্যায়ে প্রকাশ পেয়ে থাকে।
প্রথম পর্যায়: ৩–৪ সপ্তাহ স্থায়ী হয়। রোগলক্ষণ এতটা সাধারণ ধরনের যে, খুব সতর্ক না হলে রোগ–নির্ণয় এড়িয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। এটাকে ‘প্রোড্রোমাল ফেস’ বলা হয়। এই অবস্থায় শিশুর ওজন পড়ে যায়, খিদে থাকে না, স্কুলে মনোসংযোগ হারিয়ে ফেলে, মেজাজ হয় খিটখিটে। এ ছাড়া অকারণে কান্নাকাটি, কষা পায়খানা ও বড় শিশুতে মাথাব্যথা, ইত্যাদি উপসর্গসমূহ দেখা যায়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে (স্টেইজ অব এসেপটিক মেনিনজাইটিস) : এই পর্যায় ৩– ৪ সপ্তাহ স্থায়ী থাকে। এই সময় রোগ ধরা পড়লে ৮০ ভাগ রোগী সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যেতে পারে, বাকি ২০ ভাগ মস্তিষ্কের বিবিধ জটিলতায় আক্রান্ত হয়। এই পর্যায়ের রোগলক্ষণের মধ্যে রয়েছে– মাথাব্যথা, বমি, চোখে ঝাপসা দেখা, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, চোখ ট্যারা, মুখ বাঁকা হয়ে থাকা ইত্যাদি। অপথালমোস্কপির সাহায্যে চোখ পরীক্ষা করে যদি ‘খোর্যইড টিউবারকেল’ দেখতে পাওয়া যায়, তা শিশুর টি.বি মেনিনজাইটিস হওয়া নিশ্চিত করে।
তৃতীয় পর্যায় বা স্টেইজ অব কোমা: এই পর্যায়ে এসে শিশু অজ্ঞান হয়ে যায়, হাত–পা বাঁকা হয়ে খিঁচে থাকে। শিশু জ্বর, রক্তে গ্লুকোজ কমে যাওয়া, ও এসপিরেশন নিউমোনিয়ায় ভোগে। এই সময় চিকিৎসা শুরু করা হলেও শতকরা ৫০ ভাগ এর বেশি রোগী মারা যায়। এবং বাকি যারা বেঁচে থাকে তাদের অধিকাংশই পরবর্তীতে বিভিন্ন জটিলতা, যেমন– কথা বলতে না পারা, বধির হয়ে যাওয়া, বিভিন্ন পক্ষাঘাতসহ অন্যান্য অনেক জটিলতা ভোগার ঝুঁকিতে থাকে।
৩. অন্যান্য ধরনের যক্ষ্মা–গ্ল্যান্ড (গলার পাশে ও শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থির ফোলা), বিভিন্ন জয়েন্ট, কিডনি–তন্ত্র ইত্যাদির যক্ষারোগ।
শিশুর যক্ষ্মারোগ নির্ণয়–শিশু–বয়সে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় বড়দের যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের তুলনায় বেশ কঠিন।
সাধারণ লক্ষণসমূহ : অনেকদিন ধরে জ্বর, কাশি, খিদে কম, খিটখিটে মেজাজ, ওজন কমে যাওয়া, বা ওজনে না বাড়া ইত্যাদি।
শিশু বিসিজি ভ্যাকসিন নেয়নি, বা নিয়ে থাকলেও টিকার দাগ না হওয়া।
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু– টি.বি রোগে আক্রান্ত বয়স্ক কারও সংস্পর্শে ছিল, এরকম ইতিহাস।
যক্ষ্মায় শরীরের যেসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে– সে অনুযায়ী বিশেষ বিশেষ লক্ষণসমূহ।
ল্যাব পরীক্ষা–নিরীক্ষা–
রক্তে– ডিসি, ইএসআর। টিউবারকুলিন/ বিসিজি টেস্ট। বুকের এক্স–রে। ক্ষুদ্রান্তের টিবি সন্দেহ হলে– পেটের এক্স–রে (ক্যালসিফিকেশন শ্যাডো)। মস্তিষ্কের টি.বি নির্ণয়ে– মাথার এক্স–রে, মেরুদন্ড থেকে ‘সিএসএফ’ নিয়ে পরীক্ষা। গ্ল্ল্যান্ডের টিবি অনুমানে– বায়পসি।
টিবি ব্যাকটেরিয়া সুনির্দিষ্ট করার জন্য ‘এএফবি স্টেইনিং ও কালচার’। যেহেতু শিশুরা কফ গিলে ফেলে, তাই পরপর ৩ দিন পাকস্থলি থেকে ‘গ্যাসট্রিক জুইস’ নিয়ে এই পরীক্ষা করতে হয়।
এবং অধুনা পিসিআর, ইগরাস্–ইনটারফেরন–গামা রিলিস অ্যাসে টেস্ট।
যক্ষ্মারোগের ওষুধ–
ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষা (এমডিআর–টিবি) বাদে বেশিরভাগ যক্ষ্মা ৬ মাস নিয়মিত (ডটস–ডাইরেক্টলি অব্জারভ্ড থেরাপি ্বা ভোটস্– ভিডিও অব্জারভ্ড থেরাপি) চিকিৎসায় সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। তদুপরি চিকিৎসা শুরুর ২ সপ্তাহের মধ্যে রোগীর অন্যকে রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা লোপ পায়।
বর্তমানে যেসব ঔষধ সচরাচর ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– পাইরাজিমাইড, আইএনএইচ, রিফামপিসিন, ইথামবিউটাল প্রভৃতি।
যক্ষাক্রান্ত শিশুরোগী যক্ষাক্রান্ত বড়দের মতো রোগ ছড়ায় না। কিন্তু শিশু কার সংস্পর্শ থেকে যক্ষাক্রান্ত হয়েছে তার হদিশ নেওয়া উচিত। পরে সেই ব্যক্তিকে দ্রুত চিকিৎসা–ব্যস্থাপনার আওতায় আনা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যও শিশুদের স্ক্রিনিং করে রোগে আক্রান্ত কিনা জেনে নেওয়া–আশু কর্তব্য।
সুপ্ত যক্ষ্মা (টিবি)-
এক্ষেত্রে ৩ মাসের জন্য রিফামপিসিন ও আইএনএইচ সহযোগে, কিংবা ৬ মাসের জন্য এককভাবে আইএনএইচ দ্ধারা চিকিৎসা করানো হলে সুপ্ত যক্ষ্মা পরবর্তীতে অ্যাকটিভ ‘সক্রিয় টিবি’) হওয়ার ঝুঁকি কমে।
যক্ষ্মাক্রান্ত মায়ের সন্তান–
মা যক্ষ্মাতে আক্রান্ত– এ অবস্থায় গর্ভস্থ সন্তানের অসুখে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি। এরকম সন্তানের প্রায় ৫০ শতাংশ প্রথম বছর বয়সের মধ্যে রোগে ভুগতে দেখা যায়। এসব নবজাতক শিশুকে জন্মের পরপর পরীক্ষাপূর্বক সে কি জন্ম–যক্ষ্মারোগের রোগী কিনা যাচাই করা দরকার। এবং নবজাতকের বুকের দুধপান অব্যাহত রেখে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে যক্ষাক্রান্ত মা ও নবজাতকের সুষ্ঠু চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।
শিশুদের বিসিজি টিকা–
শিশু–বয়সে যক্ষ্মারোগ হতে সুরক্ষা প্রদানের উপায় হিসাবে পৃথিবীব্যাপী, প্রায় একশ দেশে এক বছরের কম–বয়সী ও ছোট শিশুদের এই বিসিজি টিকা প্রদান করা হয়।
হ বিসিজি টিকাদান শিশুর শরীরে যক্ষ্মারোগ হওয়া থেকে রক্ষা করে না। কিন্তু শিশুর সারাদেহে ছড়িয়ে পড়া যক্ষ্মা (মিলিয়ারি টিউবারকুলোসিস), ও মস্তিষ্কের যক্ষ্মার মতো– দুই মারাত্মক ধরনের যক্ষ্মা অসুখ প্রতিরোধে (প্রায় ৬০– ৮০% ক্ষেত্রে) ও ফুসফুসের যক্ষ্মার ক্ষেত্রে প্রায় ৫০% ক্ষেত্রে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে।
হ টিকাদান সূচী– জন্মের পর পর বিসিজি টিকাদান , বিশেষত দুই সপ্তাহ বয়সের মধ্যে প্রদান করা ।
হ তবে যে শিশুকে কোনো কারণে সময়মতো বিসিজি প্রদান করা হয়নি, তাকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত এই টিকা দেওয়া যায়।
হ সকল বয়সের জন্য এই টিকার ডোজ ০.১ মিলি। এটা বাম বাহুর উপরের অংশে চামড়ার মধ্যে দেওয়া হয়। বিসিজি টিকা দানের স্থানে ৮ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে প্রথমে ফোঁড়া ও পরে ঘা দেখা দেয়। বিসিজি টিকা দানের ১২ সপ্তাহ পরেও যদি কারোর এই স্থানীয় প্রতিক্রিয়া দেখা না যায়, তবে সাথে সাথে দ্বিতীয়বার বিসিজি টিকা প্রদান করা উচিত।
হ প্রতিক্রিয়া– বিসিজি টিকাদান থেকে প্রতিক্রিয়া খুবই কম। কখনো–বা স্থানীয়ভাবে কিছু গ্ল্যান্ড ফোলে। যা আপনা–আপনি কমে যায় এবং সাধারণভাবে চিকিৎসার প্রয়োজন লাগে না। বিসিজি ভ্যাকসিন ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে রাখা হয়। তবে তৈরি করার ৪ ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।