শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠ যখন মেলার দখলে

ড. উজ্জ্বল কুমার দেব | রবিবার , ৬ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:০৭ পূর্বাহ্ণ


খেলাধুলা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ তথা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। জিপিএ ফাইভের অনেক ভারী সিলেবাসের এই যুগে, অভিভাবকরা ছেলেদের খেলার মাঠে যেতেই দেন না। তাছাড়া মোবাইল গেমের আগ্রাসনে মাঠের গেমের গুরুত্ব আজকাল হারিয়ে যেতে বসেছে। গ্রামের ছেলেরা মাঠে খেললেও, শহরের অনেক ছেলে বড় হচ্ছে মাঠ না দেখেই। একটা সময় ছিল যখন মাঠের অভাব ছিল না। পাড়ার ক্লাব, স্কুলের মাঠ, বাড়ির আঙিনা এসব জায়গায় কিছু না কিছু খেলার জায়গা ছিল। আজকাল শহরে আমরা দেখি পাড়ার ক্লাবের মাঠ নেই। স্কুলের মাঠ নেই, বিল্ডিংয়ে স্কুল। বাড়ির সামনে খালি আঙিনা পাওয়া বড়ই মুশকিল যেখানে দুবিল্ডিংয়ের দূরত্ব এক হাতেরও কম।

একটি সঠিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শিশু কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে থাকে। এ ধরনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শহর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যতদূর জানা যায়, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এরকম একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। সেটি হল শিশু-কিশোরদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশকে মাথায় রেখে পুরো নগরের ১০ শতাংশ জায়গা উন্মুক্ত রাখা। বর্তমানে ২৫ বছর পরে এসে আমরা কি দেখতে পাই? এরকম উন্মুক্ত জায়গা কি খুঁজে পাওয়া যাবে? বরং উন্মুক্ত জায়গা গুলোকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে সেগুলোও নষ্ট করার পায়তারা চলেছে। সিআরবি তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু পরিবেশ সচেতন জনগণের বাঁধাই সেটি সম্ভব হয়নি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে খেলার মাঠের সংখ্যা হাতেগোণা। এখন কোনো ধরনের প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট বা খেলার আসর আয়োজনও হয় না মাঠের অভাবে।

চট্টগ্রাম শহরে ৯০ এর দশকে যতগুলো মাঠ ছিল, এখন তার এক চতুর্থাংশ ও নেই। আমার স্পষ্ট মনে আছে, এমএ আজিজ স্টেডিয়াম এর আশেপাশে ৫-৬ টি খোলা জায়গা বা খেলার মাঠ ছিল। বর্তমানে সে খালি জায়গাগুলো দখল করেছে পাঁচতারকা হোটেল, সার্কিট হাউসসহ অন্যান্য স্থাপনা। আউটার স্টেডিয়াম এর একটা অংশে সুইমিং পুল তৈরি হয়, যা শিশু-কিশোরদের সাঁতার শিখতে কাজে লাগছে বটে, অপরাংশ খেলার মাঠের জন্য উন্মুক্ত থাকলেও, বছরের অনেকটা সময় এটি থাকে ট্রাকের স্ট্যান্ড ও মেলার দখলে। যেমন এখন চলছে মাসব্যাপী শিল্প ও বাণিজ্য মেলা। মনে হয় না এবছর আর এটিতে শিশু কিশোররা খেলতে পারবে।
প্রতিদিন সকালবেলা একঝাঁক তরুণকে দেখি জমিয়াতুল ফালাহ মাঠে খেলতে। একটা মাঠকে দশটা গ্রুপ যখন দশ ভাগ করে নিয়ে ক্রিকেট, ফুটবল খেলে তখন জানি না তারা কতটুকু মজা পায়। তারপরও তারা খেলে। এভাবে খেলে এই মাঠ থেকে নান্নু, আকরাম, তামিমদের মতো প্লেয়ার বের হতে পারবে কিনা সন্দেহ। একসময় জাতীয় দলে চট্টগ্রামের ফুটবলারদের দাপট ছিল। মূল সাপ্লাইটা হতো চট্টগ্রাম থেকে। অন্যদিকে ক্রিকেটে তো চট্টগ্রামের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। বলতে গেলে শুরুর দিকে জাতীয় দলে অর্ধেকের বেশি ছিল চট্টগ্রাম থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়েরা। আউটার স্টেডিয়ামের মাঠে বেড়ে ওঠা তামিম ইকবালই হয়তো এর শেষ রশ্মি। জানি না এরপর কেউ উঠে এসে চট্টগ্রামকে সারা বিশ্বে চিনতে সাহায্য করবে কিনা?

চট্টগ্রামের আরেকটি বিখ্যাত মাঠ হচ্ছে রেলওয়ে পলোগ্রাউন্ড মাঠ। এক সময় এখানে নিয়মিত খেলাধুলা হতো। চট্টগ্রামের খেলাধুলার বিকাশে এ মাঠের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। আমরা দেখেছি এক সময় এই মাঠে চট্টগ্রামের ফুটবল অঙ্গনের অনেকগুলো টিম একসাথে প্র্যাকটিস করতো। একদলের অনুশীলন শেষে আরেকদল নামতো অনুশীলন করতে। এক পর্যায়ে সেখানে চলতে লাগলো নিয়মিত বিভিন্ন চেম্বারের শিল্প ও বাণিজ্য মেলার আয়োজন। এক মাস ব্যাপী মেলা এবং আরো একমাস ব্যাপী ইট বিছানো, প্যাভিলিয়ন তৈরীর আয়োজন খেলাধুলাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করত। ঐতিহাসিক লালদিঘির মাঠটিও ঐ এলাকার ছেলেমেয়েদের খেলার একটা উন্মুক্ত স্থান ছিল। কোনো এক অজানা কারণে সেটিও সংস্কারের পর দীর্ঘদিন বন্ধ। প্রশাসনের কাছে প্রত্যাশা থাকবে শীঘ্রই এটি খেলাধুলার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক। চট্টগ্রাম এবং মহসিন কলেজের মাঠে খেলাধুলা চললেও তা পূর্বের তুলনায় অনেক সংকুচিত অবস্থায় আছে। কারণ নিরাপত্তার অজুহাতে কলেজ কর্তৃপক্ষ দেয়াল তুলে দিয়েছে। পতেঙ্গার কর্ণফুলীর তীরে জেগে ওঠা চরের জায়গায় আগে শিশু-কিশোররা খেলাধুলা করতো। কিন্তু এখন সেখানে কন্টেইনার ডিপো করা হয়েছে। পতেঙ্গা ১১ নম্বর এলাকায় রাস্তার সামনে বিশাল একটি মাঠ ছিল। সেটি এখন চিটাগাং বোট ক্লাবের। এছাড়া হাউজিং কলোনির মাঠে র‌্যাব-৭ এর সদরদপ্তর গড়ে ওঠার পর থেকে সেখানেও খেলাধুলা বন্ধ। আগ্রাবাদের জাম্বুরি ফিল্ডে খেলাধুলা পুরোপুরি বন্ধ, এটি এখন জাম্বুরি পার্ক। আগ্রাবাদের ডেবারপার এলাকায় আরেকটি মাঠ ছিল। যেখানে আগ্রাবাদ নওজোয়ান ক্লাব অনুশীলন করতো একসময়। এখন এ জায়গায় স্থান হয়েছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের। আমরা চট্টগ্রামের মানুষ শুধু ব্যবসা বুঝতে গিয়ে একটা এমন প্রজন্ম নিজের অজান্তে বড় করছি যারা শারীরিক ও মানসিক ভাবে অকর্মণ্য ও অযোগ্য। তাহলে ব্যবসা ও ব্যবসায়িক এ প্রতিষ্ঠান কাদের জন্য?

এক সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুলগুলোতে বড় বড় খেলার মাঠ ছিল। একপর্যায়ে স্কুলের জায়গার পরিমাণ না বাড়লেও শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নতুন ভবন নির্মাণ অপরিহার্য হয়ে ওঠে। আবার স্কুল কমিটিগুলো নতুন ছাত্র ভর্তিকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে থাকে। নতুন ভবন নির্মাণের জন্য তখন স্কুলের মাঠটিকে বেছে নেওয়া হয়। এভাবেও শহরের স্কুলগুলোতে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ। শিশু কিশোররা বঞ্চিত হচ্ছে খেলাধুলা থেকে। একটা সময় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা বার্ষিক পরীক্ষা শেষে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার জন্য মাঠে যেতো। এখন মাঠ নেই, ওরা খেলবে কোথায়? বর্তমান প্রজন্ম খেলাধুলার চেয়েও মোবাইলে আসক্তি বাড়ছে। এভাবে স্কুলের বাচ্চাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। খেলাধুলোয় যে শক্তি ক্ষয় হতো সেটা এখন ক্ষয় করছে অপরাধ চর্চার মাধ্যমে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে জীবনযাত্রায়ও। অনেকে অল্প বয়সে মাদক সেবন করছে, আবার অনেকে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে।

পত্রিকার খবরে জানলাম, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পরিচালিত বিদ্যালয়ের মধ্যে ৬৫ শতাংশ বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। বাকি ৩৫ শতাংশ বিদ্যালয়ে মাঠ থাকলেও শিক্ষার্থীরা সেসবকে মাঠ হিসেবে মানতে নারাজ। এ ব্যাপারে মেয়র মহোদয় ও কাউন্সিলরদের নজর দেওয়া জরুরি। আমরা যদি লক্ষ্য করি দেখবো শহরের বিভিন্ন জায়গায় সিডিএ ও সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন জায়গা বেদখল হয়ে আছে। এগুলো পুনরুদ্ধার করে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ছোট ছোট মাঠ করা যেতে পারে শিশু-কিশোরদের খেলার জন্য। সাথে কিছু ওয়াকওয়ে করে দিলে সকাল-সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য সচেতনদেরও স্বাস্থ্য চর্চায় কাজে আসবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে বর্তমানে চট্টগ্রামে ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ শিশু-কিশোর টেলিভিশন দেখে অবসর কাটায়। করোনাকালীন শিশু কিশোররা যে ঘরবন্দী জীবনযাপনে ও ইনডোর গেমে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তা প্রতিরোধ করে তাদের পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে খেলার জন্য মাঠের বিকল্প নেই। আর সে ব্যবস্থা আমাদেরকেই করে দিতে হবে। না হয় কোনো এক সময় এ প্রজন্মের কাছে রাষ্ট্রকে জবাবদিহি করতে হবে। শারীরিক ও মানসিক ভাবে শক্ত ও সুস্থ প্রজন্মই আমাদের দেশকে সঠিক পথে নিয়ে যাবে। তা যদি করতে না পারি কিশোর গ্যাং থেকে বড় হয়ে, দেশ বিক্রি করে খাওয়া ও অর্থ পাচার করে বিদেশী স্থায়ী হওয়া একটা প্রজন্মের কাছে দেশকে ছেড়ে দিতে হবে। আমাদের গন্তব্য কি সেদিকে?

লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরিবার ও সম্প্রীতির বন্ধন
পরবর্তী নিবন্ধসীতাকুণ্ড ডায়াবেটিক সমিতির সভা