শিল্পোদ্যোগ থেকেই কর্মসংস্থান

বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর আশা।। কালো টাকায় সুযোগ থাকতেও পারে বলে ইঙ্গিত।। আমরা ঋণ নেবো না, দেবো

আজাদী ডেস্ক | শনিবার , ৫ জুন, ২০২১ at ৬:০০ পূর্বাহ্ণ

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার পক্ষে বা বিপক্ষে উভয় ধরনের মতামত থাকার কথা জানিয়ে এমন সুযোগ আবারও রাখার ইঙ্গিত দিয়েছেন বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে। গতকাল শুক্রবার তিনি বলেছেন, অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া যদি লাভজনক হয়, তাহলে অব্যাহত রাখার জন্য আলোচনা করা হবে। মহামারী পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানে নতুন বাজেটে ‘স্পষ্ট কিছু নেই’ বলে সমালোচনা হলেও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সরকারের একার পক্ষে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব না। সেই দায়িত্ব নিতে হবে বেসরকারি খাতকে। তারা যেন সেটা করতে পারে, সেজন্য প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, ‘প্রাইভেট সেক্টরকে ড্রাইভিং সিটে বসাতে হবে, তারা এগিয়ে নিয়ে যাবে। তারা যেন সেটা করতে পারে, সেজন্য সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে।’ প্রস্তাবিত বাজেটে করের হার কমানোর ফলে রাজস্ব আদায় বাড়বে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। বলেছেন, যদি আমরা রেভিনিউ হার আস্তে আস্তে কমাই, তাহলে আমাদের কালেকশন বাড়বে। আমরা যে কর কমালাম, আমরা বিশ্বাস করি ‘উই উইল বি উইনার’। করের হার কমানো হয়েছে, আশা করি আমাদের রেভিনিউ কালেকশন আরও বাড়বে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হার ৭ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হয়েছে। করোনাকালে জিডিপির এই প্রবৃদ্ধি অর্জন কঠিন হলেও সম্ভব বলে জানান অর্থমন্ত্রী । বলেন, আগামীতে আমরা ঋণ নেবো না, দেবো। তার ভাষায়, ‘অতীতে আমরা যা বলেছি তা অর্জন করেছি। এটা অর্জন করতে যে সমস্ত নেটওয়ার্ক দরকার সেগুলো খুব শক্তিশালী। সামষ্টিক অর্থনীতির গতিমুখীতা অত্যন্ত অগ্রসরমুখী। দেশ স্বাভাবিক হলে আবারও বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। আমরা প্রবৃদ্ধি অর্জন করে দেখাবো।’
মহামারীর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ কোটি টাকার এই বাজেট প্রস্তাব বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। তিনি একে ‘জীবন-জীবিকা রক্ষার’ বাজেট বললেও বাজেটের পরিকল্পনায় তার ‘প্রতিফলন আসেনি’ বলে সমালোচনা হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বিরাট ছাড় এসেছে করপোরেট করের ক্ষেত্রে, এছাড়া ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড তৈরির লক্ষ্যে ভারী শিল্পে কর অবকাশ সুবিধা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। স্থানীয় শীল্পে উৎসাহ দিতে শুল্ক ও করে নীতি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। বাজেটের এসব উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা। কিন্তু মহামারীর মধ্যে নতুন করে যারা দরিদ্রের কাতারে নাম লিখিয়েছেন, বা কাজ হারিয়ে যারা দুর্দশায় পড়েছেন, তাদের জন্য বাজেটে ‘স্পষ্ট কিছু’ নেই বলেও সমালোচনা হচ্ছে।
রেওয়াজ অনুযায়ী অর্থমন্ত্রী গতকাল শুক্রবার বাজেট পরবর্তী ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে হাজির হলে কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা নিয়েও সাংবাদিকরা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বাজেট ইজ কোয়াইট ওপেন। পুরোটাই ব্যবসা বান্ধব। আমি মনে করি ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেবে। সুযোগ নেওয়া মানে হচ্ছে উৎপাদনে যাওয়া। উৎপাদনে গেলে তা হবে কর্মসংস্থান। কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করলে উৎপাদন কীভাবে হবে? এজন্য আমি মনে করি ব্যবসায়ীরা কর্মসংস্থান সৃষ্টির কাজটি করবে। আমরা মেইড ইন বাংলাদেশের ট্যাগলাইনটা ব্যবহার করতে শুরু করেছি। এটা সময়োপযোগী পদক্ষেপ।’
ভবিষ্যতে ভ্যাট, ট্যাঙ কমিয়ে দেশীয় শিল্পকে আরও বেশি সুরক্ষা দেওয়া হবে বলেও ইঙ্গিত দেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাদরে দেশীয় পণ্য যেগুলো আছে। যেখানেই সম্ভাবনা আছে, সক্ষমতা আছে, আমরা সেটাকে কাজে লাগাব। আমরা কিছুটা ফ্লেঙিবল থাকব। ভ্যাট ট্যাঙ কখনও বাড়াবো না। এটা পরিবর্তন হতে থাকবে। পরিবর্তন হওয়া মানে কমে যাওয়া। এর উদ্দেশ্য থাকবে রেভিনিউ বাড়ানো।’
গত বছর মহামারীর শুরুর দিকে বেকারত্ব নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখানো হয়, কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে গত এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশে বেকারত্বের হার ২২ শতাংশের উপরে চলে গেলেও সেপ্টেম্বরে তা ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে বেকারেত্বের হার এখনও ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে বলে একাধিক গবেষণার বরাত দিয়ে দাবি করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিং বা সানেম। সানেমের গবেষণায় বলা হচ্ছে, মহামারীকালে দুই কোটির মত মানুষ ছদ্ম বেকারত্বের মধ্যে পড়েছে নতুন করে।
অর্থমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, উত্তরণের অনেক কিছুই নির্ভর করছে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসার ওপর। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে মানুষের কাজ পেতে বেশি সময় লাগবে না বলেই তার বিশ্বাস।
এদিকে গত বাজেটে শুধু চলতি অর্থবছরের জন্য কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্ন ছাড়াই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এবারে বাজেটে নতুন করে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। চলতি অর্থবছরে যেসব খাতে এমন সুযোগ আছে, তা আগামী ৩০ জুন শেষ হয়ে যাবে। গত ১৯ মে এক বৈঠকে শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ওটা কালো টাকা নয়, অপ্রদর্শিত টাকা। যতদিন প্রদর্শিত না হবে, ততদিন কন্টিনিউ করবে। আমাদের সিস্টেমের কারণে অনেক সময় অপ্রদর্শিত টাকা সিস্টেমে চলে আসে।গতকাল একজন সাংবাদিক জানতে চাইলেন, কোথাও কোনো ঘোষণা বা প্রস্তাব বা কিছু উল্লেখ না থাকায় আগামী অর্থবছরে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার বিদ্যমান অবাধ সুযোগ থাকছে কিনা? জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দুই সপ্তাহ আগে যখন আমরা এমন বলেছিলাম, তখন আমাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য ছিল না। আমাদের প্রফিটেবলিটি যাচাই করতে হবে। যদি এটি প্রফিটেবল হয়, তাহলে এটি অব্যাহত রাখার জন্য আমরা আলোচনা করবো। এখন এই মুহূর্তে এইটা নিয়ে মিশ্র ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দুইটাই আছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘কেউ বলে এটা রাখতে, কেউ আবার না রাখতে বলেন। অনেকে বলছেন এক্ষেত্রে সমাজের ইকুইটির জাস্টিস এনশিউর করা যাবে না যদি এটি অব্যাহত থাকে। তাই বিষয়টি বিবেচনা করে আমরা আরো একমাস এটা দেখবো। তারপর আলোচনা হবে। এর ভালো খারাপ দুইটি দিকই আছে। ভালো দিক হচ্ছে এই টাকাটা এই টাকাটা কোনো সিস্টেমে নাই, আমরা ব্যবহার করতে পারি না। যদি এটি প্রদর্শিত আয় হয়ে ঘুরে আসে তাহলে অর্থনীতিতে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে।”
অপর এক প্রশ্নে মুস্তফা কামাল বলেন, ‘কালো টাকা নিয়ে আমি কখনও কথা বলি নাই। আমাদের বাজেটে আমরা যে অ্যাপ্রুভেশনে গেছিলাম সেটা হল অপ্রদর্শিত আয়। কালো টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। আর অপ্রদর্শিত আয়ের টাকাটা সিস্টেম লসের কারণে সৃষ্টি হয়। আমরা এখন ট্যাঙ রেট করে রাখলাম ৫০%, ৫৫%, ৬০%। এটা অনেক অন্যায় করা হয়েছে এদেশের মানুষের সাথে, বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের সাথে।’
বাজেটে অনেক সমস্যা সমাধান করা হয়েছে দাবি করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে কোনো এক সময় ছিল ‘স্কয়ার ইনকাম ট্যাঙ’। যারা বেশি ইনকাম করবে, তাদেরকে আরও বেশি ট্যাঙ দিতে হবে। অথচ উল্টাটা হওয়ার কথা ছিল। সীমিত সম্পদকে এঙপ্লয়েট করে ম্যাঙ্মিাম আয় যারা করবে, তাদেরকে আরও বেশি সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু সেটা না করে যারা বেশি আয় করে, তাদের বেশি করে ট্যাঙ দেওয়া হল। এটা করা উচিত না।’
মাথাপিছু আয় নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ১০ মাসের অর্জনের ভিত্তিতে একটি প্রাথমিক ধারণা দিয়েছে যে, আমাদের মাথাপিছু আয় ২২২৭ ডলার। আমাদের কিন্তু এখনও দুই মাস বাকি আছে। দুই মাস পড়ে এটা বলা যাবে মোট কত এলো।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির।
বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ যাই থাক, প্রয়োজনে অর্থের যোগান দিতে কোনো ‘সমস্যা হবে না’ বলে আশ্বাস এসেছে এ সংবাদ সম্মেলনে। অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, এক বছরে সরকার যত মানুষকে টিকা দিতে পারবে, সেই টাকার বরাদ্দ বাজেটে আছে। আর কৃষি মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, প্রয়োজনে অন্য খাত থেকেও টাকা নিয়ে স্বাস্থ্য খাতে দেওয়া যাবে, এ নিয়ে কোনো ‘সমস্যা নেই’। তিনি বলেন, ‘আজকে আমি সকল মিডিয়াতে দেখেছি যে, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কম, স্বাস্থ্য খাতকে সেইভাবে অ্যাড্রেস করা হয়নি। আমি সকল পত্রিকা পড়েছি।’ মহামারীর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের কাছে স্বাস্থ্যই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘সারা পৃথিবীতে এটা যেভাবে মোকাবেলা করছে, আমি মনে করি সরকার সেইভাবেই এটা মোকাবেলা করবে। অর্থ কোনো সমস্যা এখানে হবে না।” এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি ‘মজবুত’ এবং প্রয়োজনীয় মুহূর্তে সরকার অর্থের ব্যবস্থা করতে ‘সক্ষম’।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাজেটের প্রভাব নেই বাজারে
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশকে আপাতত টিকা নয়, জানিয়ে দিল ভারত