রাজধানীর একটি হোটেলে শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বেসরকারি খাতের পূর্বাভাস: প্রত্যাশা ও অগ্রাধিকার’ শীর্ষক বাণিজ্য সম্মেলনে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, তাঁরা উদ্বিগ্ন। সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, তিন–চার মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সফল হয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। গত শুক্রবারও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে একজন ব্যবসায়ীকে পেটানো হয়েছে। চলছে মামলা–বাণিজ্য। ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকলেই বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে হত্যা মামলার আসামি। ঋণের সুদের হার বাড়ছে। এসব নতুন সমস্যার সঙ্গে গ্যাস–সংকট, প্রায় সব ক্ষেত্রে ঘুষ–দুর্নীতি, বিচারে দীর্ঘসূত্রতার সমস্যাগুলো রয়েই গেছে। বাণিজ্য সম্মেলনে নির্ধারিত আলোচক ছিলেন সাতজন। আর দর্শকসারিতে ছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পুরোপুরি উন্নতি হয়নি এখনো। জ্বালানি সমস্যায় শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসা চালিয়ে নেওয়াই কঠিন। সম্মেলনে আশরাফ আহমেদের মতো অনেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ তাঁদের উদ্দেশে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করছি। আপনারা হতাশ হবেন না। ১৫ বছর ধরে যা হয়েছে তা অকল্পনীয়।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আইএমএফে (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) কাজ করেছেন। আমাকে বলেছেন, সবার টাকা নিয়ে ব্যাংক থেকে চলে যাওয়া–বিশ্বের কোথাও এমন দেখেননি তিনি, যা হয়েছে বাংলাদেশে।’ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভাপতি আবদুল হাই সরকার বলেন, ‘গ্যাস–বিদ্যুতের সমস্যার পাশাপাশি বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে আমরা আশা করতে পারি না যে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ দেশে আসবেন।’
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি সেলিম আর এফ হোসেনও আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রথম প্রত্যাশা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। বর্তমান সরকার যে এ উন্নয়ন ঘটাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, এটা তাদের মানতে হবে। বিভিন্ন জায়গায় মাস্তানি ও চাঁদাবাজি চলছে।’ ১৫ বছরে রাজনৈতিকভাবে স্বজনপ্রীতি হলেও সামপ্রতিক পরিবর্তনে আশাবাদ তৈরি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন সেলিম আর এফ হোসেন। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। সব জায়গায় চাঁদাবাজি। তিনি বলেন, ‘১৫ বছরে অনেক চুরি হয়েছে। এ জন্য আমরা ভর্তুকি দেব? আমরা তো আইনকানুন মানা আসল ব্যবসায়ী।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতির চালিকা শক্তি ব্যবসা–বাণিজ্যকে পেছনে রেখে যে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়া যাবে না, এ কথা অমোঘ সত্য। কঠিন বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের ব্যবসা–বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বহুমুখী সমস্যা আছে। যতই দিন যাচ্ছে, ব্যবসা–বাণিজ্যের সমস্যা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে বারবার আশ্বাস পাওয়া গেলেও বাস্তবে সহায়তা মিলেছে সামান্যই। তাঁরা বলেন, কিন্তু ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ তো কেবল ব্যাংকিং খাত নয়। গ্যাস–বিদ্যুতের ঘাটতি থেকে শুরু করে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। জুলাই–আগস্টের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নেওয়ার পরও সরকারি প্রশাসনে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে বলা যাবে না। এখনো ব্যবসায়ীদের সরকারি সেবা নিতে ঘুষ দিতে হয়। অর্থাৎ প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বদল হলেও চরিত্র বদল হয়নি।
আসলে দেশের শিল্প খাতসহ ব্যাবসা–বাণিজ্য নানা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। গত সরকারের আমল থেকেই এই পরিস্থিতি শুরু হয়েছে। মূলত শিল্পখাতে দুর্নীতি ও জ্বালানির অপর্যাপ্ততাসহ অন্য সমস্যাগুলো বহুল আলোচিত এ দেশে। শিল্প–কারখানায় প্রয়োজন অনুযায়ী জ্বালানি মিলছে না বলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা হ্রাসে বহুমাত্রিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। কাজেই শিল্প–কারখানায় গ্যাস–বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু বাণিজ্য খাত দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি, সেহেতু এ খাতে কোনো ধরনের স্থবিরতা কাম্য হতে পারে না।