বছর কয়েক আগেও ১৫০টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে দেশের স্ক্র্যাপ চাহিদার একটি বড় অংশের যোগান দেয়া হতো। এখন তা নেমে এসেছে হাতে গোনা কয়েকটিতে। দেশের স্টিল সেক্টরে এই শিল্পের যোগান দেয়া স্ক্র্যাপের পরিমাণও ঠেকেছে একেবারে তলানিতে। ভারত এবং পাকিস্তানে শিপ ব্রেকিং শিল্প তরতরিয়ে এগিয়ে গেলেও চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা এই শিল্পটি তিলে তিলে ধূকছে। বছর দুয়েক আগে করা একটি চুক্তির ফলে গ্রিন শিপ ইয়ার্ড করতে গিয়ে ইয়ার্ড মালিকেরা দিশেহারা হওয়ার উপক্রম হয়েছেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মাত্র ১৪টি ইয়ার্ডকে গ্রিন ইয়ার্ডে উন্নীত করা সম্ভব হলেও বাকিগুলোতে জাহাজ আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। শিপ ব্রেকিং সেক্টরের বেহাল এই দশার মাঝেও ডাকাতি এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। যা মরার উপর খাঁড়ার ঘা কিংবা কফিনে শেষ পেরেক ঠুকার মতো অবস্থা তৈরি করছে বলেও ইয়ার্ড মালিকেরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সরকারের বিশেষ উদ্যোগ ছাড়া দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স এসোসিয়েশন (বিএসবিআরএ) সূত্র জানিয়েছে, ঝড়ের কবলে পড়ে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট সাগর উপকূলে আটকে যাওয়া এমভি কুইন আল–পাইন নামের একটি জাহাজকে কেটে বিক্রি করে দেয়ার মাধ্যমে শিপ ব্রেকিং ব্যবসার সূচনা বলা হয়। ৬০ এর দশকের ওই ঘটনার পর সীতাকুণ্ডের দক্ষিণাঞ্চলে তৈরি হয় বিশাল এক সম্ভাবনা। ৮০ এর দশকে শিপ ব্রেকিং একটি লাভজনক শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটের দক্ষিণাংশ থেকে কুমিরা পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকায় বিস্তার ঘটে শিপ ব্রেকিং শিল্পের। পরিত্যক্ত জায়গাগুলো সোনার চেয়ে দামি হয়ে ওঠে। ওই এলাকায় সর্বমোট ১৫০টি শিপব্রেকিং ইয়ার্ড গড়ে ওঠে। কিন্তু পরবর্তীতে শিপ ব্রেকিং সেক্টর থেকে শত শত কোটি টাকা পাচার, দেশে ডলার সংকট, করোনা মহামারী, ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ, দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ নানা সংকটে সেক্টরটি মুখ থুবড়ে পড়ে। স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি তলানিতে ঠেকায় একের পর এক বন্ধ হয় শিপব্রেকিং ইয়ার্ড। হাজার হাজার শ্রমিক যেসব ইয়ার্ডে কাজ করতেন সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দলে দলে শ্রমিক কর্মচারীরা বেকার হতে থাকেন।
সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে গ্রিন ইয়ার্ড রূপান্তর নিয়ে। শিপ ইয়ার্ডগুলোতে সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ না থাকা, শ্রমিক মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় দেশে কোনো শিপইয়ার্ড চালু রাখতে হলে সেগুলোকে অবশ্যই হংকং কনভেনশন অনুসরণ করে গ্রিন ইয়ার্ডে রূপান্তর করতে হবে। আন্তর্জাতিক এই আইনে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কোনো শিপ ইয়ার্ডই গ্রিন ইয়ার্ডের সার্টিফিকেট অর্জন না করলে কোনো পুরোনো জাহাজ আমদানি করতে পারবে না। গত ২৬ জুন হংকং কনভেনশনের চুক্তি বাস্তবায়ন করে গ্রিন ইয়ার্ডে রূপান্তর করার নির্ধারিত সময় শেষ হয়েছে। অর্থাৎ এরপর গ্রিন ইয়ার্ড ছাড়া অন্যান্য ইয়ার্ডগুলো আর কোনো পুরোনো জাহাজ আমদানি করতে পারছে না।
সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত মাত্র ১৪টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড গ্রিন ইয়ার্ডে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে কেবলমাত্র এই ১৪টি শিপ ইয়ার্ডই পুরোনো জাহাজ আমদানি করতে পারছে। বাকি আরো যে ৩০টির মতো ইয়ার্ডের জাহাজ আমদানির সক্ষমতা রয়েছে সেগুলো আর জাহাজ আনতে পারছে না। ফলে দেশের শিপ ব্রেকিং সেক্টরে কার্যতঃ অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ইয়ার্ড মালিকেরা বলেছেন, গ্রিন ইয়ার্ড করতে পুরো ইয়ার্ডকে আমুল পাল্টে ফেলতে হচ্ছে। একটি ছোট ইয়ার্ডকেও গ্রিন ইয়ার্ডের শর্তগুলো পূরণ করে তৈরি করতে ৩৫ থেকে ৫০ কোটি টাকা লাগছে। বড় ইয়ার্ডকে করতে লাগছে ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা। এতো বিশাল বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্রিন ইয়ার্ড করার সাধ্য বহু মালিকেরই নেই। তারা হাত পা গুটিয়ে বসে রয়েছেন। শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোকে গ্রিন ইয়ার্ডে পরিণত করার জন্য কোনো ধরনের সরকারি বেসরকারি সহায়তা দেশের ইয়ার্ড মালিকেরা পাচ্ছেন না বলেও জানিয়েছেন একাধিক শিপ ব্রেকিং ব্যবসায়ী। আগে শত শত কোটি টাকার ঋণ খেলাপী হয়ে যাওয়ায় শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে কোনো ব্যাংকই নতুন করে ঋণ দিতে চাচ্ছে না। আবার ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে গ্রিন ইয়ার্ড করাও উচিত হবে না। স্বল্পসুদের দীর্ঘমেয়াদী কোনো ঋণ বা বিশেষ শর্তে কোনো প্রণোদনা দেয়া হলেই কেবলমাত্র সেক্টরটিকে রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে তারা উল্লেখ করেন।
একজন শিপ ব্রেকিং ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের ভাগ্যই খারাপ। ভারতে ২০ থেকে ২৫ কোটি রুপিতে একটি ইয়ার্ডকে গ্রিন ইয়ার্ডে রূপান্তর করা যাচ্ছে, পাকিস্তানে ৫ থেকে ৬ কোটি রুপিতে সম্ভব হচ্ছে। টেকনিক্যাল কিছু কারণসহ অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধায় ভারত এবং পাকিস্তান এই বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে। সেখানে পরিবেশসম্মত শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড গড়ে তোলার জন্য জাইকা সহজ শর্তে অর্থায়ন করছে। আবার সরকার থেকেও তাদের বেশ কিছু ছাড় দেয়া হয়েছে। জাহাজ আমদানিতে কিছু শর্ত শিথিল করেছে। ফলে ভারত ও পাকিস্তান বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বলে মন্তব্য করে ওই ব্যবসায়ী বলেন, আল্টিমেটলি ব্যবসাটি ভারত এবং পাকিস্তানেই চলে যাবে।
তিনি বলেন, কোনো ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই বছর দুয়েক আগে গ্রিন ইয়ার্ডে রূপান্তরের বিষয়টি চূড়ান্ত করে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বিগত সরকারকে পুরো বিষয়টির জন্য দোষারোপ করেন।
অপর একজন শিপ ব্রেকিং ব্যবসায়ী বলেছেন, আমাদের বন্ধ ইয়ার্ডগুলোতে কিছু লোহা এবং যন্ত্রপাতি রয়েছে। সেগুলো ডাকাতি এবং লুটপাট হচ্ছে। কুমিরা সাগর উপকূলে অবস্থিত কে আর শিপ রিসাইক্লিং ইয়ার্ডের নিরাপত্তাকর্মীদের হাত পা বেঁধে কয়েক লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে। ২০–২৫ জনের একটি ডাকাতদল দুইটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে এসে ইয়ার্ডের সামনে সন্দ্বীপ চ্যানলে থাকা একটি বার্জের নিরাপত্তা কর্মীদের প্রথমে অস্ত্রের মুখে হাত–পা বেঁধে ফেলে। এরপর প্রায় ৬ লক্ষ টাকা মূল্যের মালামাল ও কারখানার যন্ত্রপাতি লুট করে নিয়ে যায়। কে আর শিপ রিসাইক্লিং ইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ তসলিম উদ্দিন ডাকাতির কথা স্বীকার করেছেন। ডাকাতির এই ঘটনা পুলিশকে জানানো হয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।