চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) মেডিকেল সেন্টার নিয়ে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধা, সময় মতো অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়া, জরুরি অনেক ঔষধের ঘাটতিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এই মেডিকেল সেন্টার। এছাড়া ভালো করে যাচাই–বাছাই না করে ঔষধ লেখার অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। এজন্য রাত–বিরাতে অনেক সময় শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ছুটতে হয় শহরের মেডিকেলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ হাজার শিক্ষার্থী, ১ হাজার ২০০ শিক্ষক ও ২ হাজার কর্মচারীর চিকিৎসার একমাত্র অবলম্বন এই মেডিকেল সেন্টার। প্রতিনিয়ত প্রাথমিক চিকিৎসাসেবায় কাজ করছে মেডিকেল সেন্টারে নিয়োজিত কর্মকর্তাবৃন্দ। তবে এটি শিক্ষার্থীদের কাছে ‘নাপা সেন্টার’ নামে পরিচিত। শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসক রয়েছেন মোট ১৫ জন। পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে সেবা দিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ছেন চিকিৎসকরা। ব্যাহত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাসেবা। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য খাতে ৬টি অ্যাম্বুলেন্স দেখানো হলেও প্রায় ৩২ হাজার মানুষের সার্ভিসের জন্য রয়েছে মাত্র দুটি অ্যাম্বুলেন্স। ক্ষেত্র বিশেষে দেখা অপ্রয়োজনীয় কাজেও অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের বিপদে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, চবি মেডিকেল সেন্টারের নানা সমস্যা দীর্ঘদিনের। মেডিকেলে গেলে কথা ভালো করে শোনার আগেই ডাক্তাররা ঔষধ লেখা শুরু করেন। যেকোনো অসুখের জন্য দেন প্যারাসিটামল আর প্রাজল। এছাড়া বিশেষ রোগে চিকিৎসা দিতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই। বেশিরভাগ সময় শিক্ষার্থীরা জটিল সমস্যা কিংবা বড় কোনো রোগ নিয়ে এলে তাদের হতাশ হয়ে ফিরতে হয়। এছাড়া গাইনী বিশেষজ্ঞ, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের সংকটের কারণে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা।
২০২২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসাসেবার নিম্নমানসহ নানা অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের প্রধান ফটকে তালা ও কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত করে দিয়েছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। নয় দফা অভিযোগপত্রে শিক্ষার্থীরা বলেন, চবি মেডিকেলের চিকিৎসার সার্বিক মান অস্বাভাবিকভাবে নিচে নামছে। সম্প্রতি ২০২০–২১ শিক্ষাবর্ষের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মামুনকে ভুল ওষুধ প্রয়োগ করায় সে মুমূর্ষু অবস্থায় চমেকে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছে। এর আগে শ্রুতি চৌধুরী নামে সংস্কৃতি বিভাগের একজন ছাত্রী জ্বর নিয়ে এলে জ্বর মাপার ডিজিটাল থার্মোমিটারটি নষ্ট থাকায় তাকে ভুল ওষুধ দেওয়া হয়।
অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়, চবি মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসার মান খারাপ। ডাক্তাররা সময়মতো আসেন না এবং সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব নেই। নাপা ও প্রাজল হচ্ছে সকল রোগের ওষুধ। বেসিক চিকিৎসা সরঞ্জাম ও টেস্ট ইকুইপমেন্ট নেই। থাকলেও তা কাজ করে না। প্যাথলজি বিভাগের কোনো কাজ নেই। ৬টি অ্যাম্বুলেন্স থাকার পরও মাত্র চলে দুটি। আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়লেও কোনো মনোচিকিৎসক নেই। ব্লাড টেস্ট, ইসিজি, এঙরে পরীক্ষা করার কোনো সরঞ্জাম নেই। ডাক্তার–কর্মচারীরা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন না। অভিযোগগুলো সমাধান করতে প্রশাসনকে দ্রুত এগিয়ে আসার দাবি জানালেও পূরণ হয়নি সেগুলো।
গত ৩১ মে লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০২১–২২ সেশনের শিক্ষার্থী আহমেদ আবদুল্লাহর চোখের নিচে কিছুটা ক্ষত হয়ে ফুলে যায়। চিকিৎসার জন্য তিনি মেডিকেল সেন্টারে যান। ডাক্তারকে সমস্যার কথা বললে তিনি ভালোভাবে না দেখে এলার্জির মলম আর একটা ট্যাবলেট দেন। রাতে ওই মলম লাগানোর পর সকালে উঠে দেখেন ক্ষত দ্বিগুণ জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সাথে ব্যথা। পানিও জমে গিয়েছিল। ভালোভাবে চোখে দেখতে না পেরে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। চমেকের ডাক্তার বলেছেন, পূর্বের মলম লাগানোর কারণেই আরো সমস্যা হয়েছে। চবি মেডিকেলের ডাক্তারকে সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করলে উনি কিছুই বলতে পারেননি। এর আগেও কয়েকবার এ রকম করেছেন।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, জ্বর এবং ঠান্ডাজনিত রোগের বাইরে চিকিৎসার জন্য সবাইকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠানো হয়। প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মতো সক্ষমতা নেই চবি মেডিকেল সেন্টারের। বিশাল জনবহুল ক্যাম্পাসে চিকিৎসাসেবার যাতায়াতের বাহন হিসেবে রয়েছে মাত্র ২টা অ্যাম্বুলেন্স। কখনো কখনো অ্যাম্বুলেন্স আমরা সময় মতো পাই না।
অর্থনীতি বিভাগের ২০১৮–১৯ সেকশনের শিক্ষার্থী অর্ণব বলেন, চবি মেডিকেলে যেকোনো অসুস্থতার ট্রিটমেন্ট নাপা ও ওমিপ্রাজল। অ্যান্টিবায়োটিক থাকার পরেও তারা শিক্ষার্থীদের বাইরে থেকে কিনতে বলেন। মেডিকেল সেন্টারে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি থাকলেও সেগুলো ব্যবহার করা হয় না। গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পরও অনেক সময় ডাক্তারদের পাওয়া যায় না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের সহকারী রেজিস্ট্রার জুলহাস উদ্দিন মিয়া বলেন, প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রে যেটুকু সেবা প্রদান করা যায় তা আমরা করে থাকি। একজন শিক্ষার্থীর যে রোগ সে অনুয়ায়ী ডাক্তার ঔষধ প্রদান করে থাকেন। এতে যদি নাপা ও ওমিপ্রাজলের প্রয়োজন হয় ডাক্তার তো সে ঔষধে দেবেন।
চিফ মেডিকেল অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মোহাম্মদ আবু তৈয়ব বলেন, চবির মেডিকেল ‘নাপা সেন্টার’, এটা শিক্ষার্থীদের কাছে ট্রেন্ড হয়ে উঠেছে। প্রাথমিক চিকিৎসার বাইরে যেগুলো হাই অ্যান্টিবায়োটিক সেগুলোর জন্য আমরা শিক্ষার্থীদের বাইরে কিনতে সাজেশন দিয়ে থাকি। এখানে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সকল অ্যান্টিবায়োটিক প্রদান করা হয়। আমাদের অ্যাম্বুলেন্স বৃদ্ধির পাশাপাশি ড্রাইভার বৃদ্ধি করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. আবু তাহের বলেন, আগের যে নাপা সেন্টার সেটি এখন আর নেই। আমি আসার পর তা পরিবর্তন হয়েছে। আমরা অ্যাম্বুলেন্স বাড়ানোর চেষ্টা করব এবং এই সেন্টার মেডিকেল ফান্ডিংয়ে করা যায় কিনা সেই বিষয়ে ভাবব। সেবার মান বাড়াতে কাজ করছি। মেডিকেলে একটা সফটওয়্যার চালুর পরিকল্পনা করছি, যাতে একজন শিক্ষার্থী দিনে একাধিকবার ঔষধ নিতে না পারে।