শিক্ষার্থী ও শিক্ষা ভাবনা

রানা বড়ুয়া | বৃহস্পতিবার , ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১ at ১:২১ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষা কি আনন্দের বিষয়? হ্যাঁ, স্কুলের পাঠ্যক্রমভিত্তিক শিক্ষার কথাই বলছি। আমার মনে হয় খুব কম শিক্ষার্থীই বলবে যে শিক্ষা আনন্দময়। আমি মূলত গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়টাকে এখানে আপেক্ষিকতার মাপকাঠি হিসাবে নিয়ে আলোচনা করব।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রণীত পাঠ্যক্রমে গণিত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক যে সব পুস্তক অন্তর্ভুক্ত আছে সেগুলোতে কি আনন্দের উপাদান আছে? শিক্ষক, যারা এসব পাঠদান করছেন তারাও কি জানেন এর মাঝে কী কী আনন্দের উপাদান বিদ্যমান আছে? যদি আনন্দের ব্যাপারটা নির্দিষ্ট করতে না পারি তাহলে শিক্ষাকে আনন্দময় করা যাবে না।

গত এক বছরে নবম ও দশম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়ে এতটুকু বুঝেছি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড থেকে যে সব গণিত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক বই নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলোতে আনন্দ ও শিক্ষার বেশ ভালো উপকরণই বিদ্যমান আছে। পাঠ্যপুস্তকের সাথে বাজারে যেসব গাইড বই প্রচলিত আছে সেসবের কিছু যা দেখা হয়েছে, তাদের বিন্যাস ও উপাদানও বেশ ভালোই।

সমস্যা হলো পাঠ্যপুস্তকের ভিতরে শেখার যে আনন্দের বিষয়টি আছে তা শিক্ষার্থীদের সামনে দৃশ্যমান করার মতো যোগ্য লোকবল কি যথেষ্ট আছে? বইতে এমন অনেক অধ্যায় আছে যেসব শিক্ষা দিতে হলে ঐ বিষয়ে বিশেষভাবে বিশেষায়িত না হলে পাঠদান সত্যিই দুরূহ হবে। উদাহরণস্বরূপ পদার্থবিদ্যার বিদ্যুৎ, ইলেকট্রনিক্স ও জীবন বাঁচাতে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ক অধ্যায়ের কথা বলা যায়।

নবম ও দশম শ্রেণির তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বইটির কথা যদি ধরি, এর সব অধ্যায়ে যে পরিমাণ জানার বিষয় আছে যদি তা সুন্দর করে বোঝানো না যায় তাহলে শিক্ষার্থী এতে উপকৃত না হয়ে বরং বিষয়টাকে কঠিন ও দুরূহ ভেবে এতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। বইটির অনেক কিছু শেখাতে অনলাইন কানেকশন ও ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ থাকতে হবে এ বিষয়ে পাঠদানের সময়।

গণিত, পদার্থ, রসায়ন, জীববিদ্যা, উচ্চতর গণিত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান (কমার্স ও আর্টস) পাঠ্যপুস্তকের বেশিরভাগ অংশই শিক্ষার্থীদের বোধগম্য করতে বিষয়ভিত্তিক যথেষ্ট দক্ষতা থাকতে হবে। শুধু সমাধান করিয়ে দিলে বা বোর্ডের পরীক্ষায় যে সব প্রশ্ন আসে তাদের উত্তর শিখিয়ে দিলেই প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরি করা যাবে না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, পদার্থ বিজ্ঞান বইয়ে ইলেকট্রনের ভরের মান যেটা দেয়া আছে সেটা দিয়ে আসলে কী বোঝানো হয়? প্রকৃত হিসাবটা কয়জন অনুধাবণ করতে পারে? ভর ও ওজনের পার্থক্য কি সবাই প্রকৃত অর্থে বোঝে? শুধু বইতে দেয়া মান ও সংজ্ঞা মুখস্থ করলেই এর মর্মার্থ বোঝা যাবে না।

জ্যামিতি বক্সে দেয়া স্কেল, চাঁদা, ত্রিকোণী, পেন্সিল কম্পাস ও কাঁটা কম্পাসের প্রতিটির ব্যবহার কতজন শিক্ষার্থী জানে বা বোঝে, কী করে এসবের ব্যবহার করতে হয়? তাদের কি এগুলোর প্রকৃত ব্যবহার শেখানো হয়? এটা তো শিক্ষার্থীর দোষ না। বক্সে দু’টো ত্রিকোণী কেন থাকে কেউ কি জানে? স্কেল, চাঁদা ও পেন্সিল কম্পাসই অধিকাংশ শিক্ষার্থী ব্যবহার করে। অন্যগুলোর যে প্রয়োজনীয়তা আছে তা অধিকাংশ শিক্ষার্থী বলতে গেলে জানেই না।

প্রতিটা বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ের লেখায় গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুলো বাংলা নামের সাথে ইংরেজিতেও দেয়া আছে। কেন? কোনো শিক্ষক কি বলেন যে ইংরেজিটা জানা উচিত? উচ্চতর শ্রেণিতে গেলে ইংরেজি বানান ও নাম জানা কত যে প্রয়োজন তা শিক্ষার্থীকে যদি শিখিয়ে দেয়া না হয় তাহলে শিক্ষার্থীরা কেন শুধু শুধু এসব ইংরেজি শব্দ ও বানান শিখবে? উদাহরণ দিয়ে ইংরেজি শব্দের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে হবে। তা না হলে শিক্ষা পরিপূর্ণ হবে না।

প্রতিটি অধ্যায়ে উদাহরণ ও কাজগুলো যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার সাথে দেয়া হয়েছে কিন্তু এসব কি শিক্ষার্থীদের করানো হয়? শুধু অনুশীলনী ও কয়েক বছরের বোর্ডের প্রশ্ন ও উত্তর বার বার শিখিয়ে-পড়িয়ে মুখস্থ লিখিয়ে ভালো নম্বর পেলেই কি ভালো ছাত্র-ছাত্রী হবে? মুখস্থ করে ভালো নম্বর পেয়ে অনেক শিক্ষার্থী নিজে ভাবে সে তো ভালো ছাত্র বা ছাত্রী কিন্তু উপরের ক্লাসে বা কোনো পেশাভিত্তিক পড়াশোনায় গেলে না বুঝে পড়ার খেসারত দিতে হবে সেই ছাত্র বা ছাত্রীটিকেই। বর্তমানে না বুঝে পাশ করা গেলেও কর্মক্ষেত্রে অনেক সমস্যায় পড়তে হবে বা অন্যকে সামলে নিজের কাজ টিকিয়ে রাখতে হবে। এভাবেই মনে হয় অযোগ্য লোকদের জন্য কর্মক্ষেত্রে দুর্নীতির ডাল-পালা বিস্তার লাভ করে।

প্রবাসে (যুক্তরাষ্ট্র) নিজ সন্তানকে গ্রেড ওয়ান থেকে গ্রেড টুয়েলভ পর্যন্ত পড়িয়ে বুঝেছি আমাদের দেশের শিক্ষা কার্যক্রমের সিলেবাস অনেক গভীর ও মানসম্পন্ন। তবে বিষয়াধিক্য আছে। উন্নত বিশ্বে এত বেশি বিষয় ক্লাসে থাকে না। এটাও দেশে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাতে অনেক প্রভাব ফেলে।

বিগত এক বছর যাবৎ গ্রামের কিছু শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে অনলাইনে পড়িয়ে এ উপলব্ধি হয়েছে যে দেশে মেধাবী শিক্ষার্থী অনেক কিন্তু তাদেরকে সঠিক পাঠদানের উপযুক্ত জনবল নেই। মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা পেশায় সম্পৃক্ত করা বেশি জরুরি। শিক্ষা পেশায় দক্ষ লোক তখনই যোগ দেবে যখন শিক্ষা পেশার সম্মানী বৃদ্ধি করা হবে। অন্যথায় যতই পরিবর্তন আনা হোক না কেন, এর দ্বারা ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে না। শিক্ষার্থীকে সঠিকভাবে তাদের মনোজগতের খোরাক দিতে না পারলে, সে কী করে সৃজনশীল হবে? দেশে মেধাবী অনেক কিন্তু তাদেরকে প্রকৃত যত্নআত্তিতে গড়ে তুলতে পারছি না বলেই আমাদের যত দ্রুত এগুনোর কথা তত দ্রুত এগুতে পারছি না।

লেখক: ইনটেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার, নিউইয়র্ক ডিপার্টমেন্ট অভ ট্রান্সপোর্টেশন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
ই-মেইল: engrbarua@yahoo.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধআকাশে ওড়ার স্বপ্ন যাদের
পরবর্তী নিবন্ধবাঘাইছড়িতে আঞ্চলিক দুই গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধ, নিহত ২