দীর্ঘ ৬ মাস করোনাকালীন সময় পার হতে চলেছে। দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনো বন্ধ, খোলার আশাও করা যাচ্ছে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানসহ অপরাপর শিক্ষকরা সরকারি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আশা নিয়ে বুক বেঁধে আছেন, হয়তো এই মাসের শেষে অথবা আগামী মাসের প্রথমার্ধে স্কুল/ কলেজ/ বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে পারে। দিন যতই ঘনিয়ে আসছে সেই আশা যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির একটি আশংকা সেই আশাকে যেন দূরাশায় পরিণত করেছে আকস্মিক। অক্টোবর-নভেম্বরের সময়টাতে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হতে পারে-এ ঘোষণায় যেন ত্রস্ত ও তটস্থ হয়ে গেছে পুরো দেশ ও জাতি। সংক্রমণের হার কমলেও মৃত্যুর হার পরিবর্তনশীল। এরপরেও জনসাধারণের উন্মুক্ত আবহাওয়ায় চলাফেরা যেন করোনাহীন বাংলাদেশকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে। দীর্ঘ ৬ মাসের বন্দি জীবনে শিশুরা যেন হাঁসফাঁস করছে। কোন কোন শিশু বাসায় বসে থেকে মুটিয়ে যাচ্ছে কারণ বাইরে যাওয়ার ভয়, পিতা-মাতার কঠোর শাসন যদি বা সংক্রমণটা শিশুর দেহে ছড়িয়ে পড়ে-খেলাধুলার মাঠে নেই কোন সমাগম, সব যেন ফাঁকা। ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে কোমলমতি শিশুদের বসবাস। বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস চালু হওয়াতে অভিভাবকমন্ডলী বেজায় খুশি-অন্তত শিশুদের নড়াচড়া দেখে। এরপরেও প্রাতিষ্ঠানিক সরাসরি শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। এতেই মানস চর্চার উন্মেষ ঘটে, ঘটে মানসিক পরিবর্ধন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিনিয়ত সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা না খোলার বিষয়ে। এমনিতর অবস্থায় সুস্থ বিবেকের কাছে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেলাম। কোমলমতি শিশুদের কাছে আমাদের অপরাধবোধ আরো একধাপ এগিয়ে গেল। করোনার প্রভাবে সারাবিশ্ব এখন অনেকটাই কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। বিশ্বের কিছু কিছু দেশ স্বাস্থ্য বিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে শুরু করেছে আবার কেউ কেউ মাঝ পথে বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। ভার্চুয়াল ক্লাস চলমান থাকাটা যতটা না জরুরি তার চেয়ে সরাসরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা আরো বেশী জরুরি। তবে সংক্রমণের আশংকায় ভীতসন্ত্রস্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ নিজেদের বাঁচার অধিকারটাকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছে। অকপটে সবাইকে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, বাঁচলেই তো শিক্ষা নচেৎ বাঁচার অধিকারহীন শিক্ষার কোন গুরুত্ব নেই। দেশ থেকে করোনা সংক্রমণ যে জিরো লেভেলে নেমে আসবে তা মনে করার কোন কারণ নেই। নিদেনপক্ষে করোনা টিকাপ্রাপ্তি হতে পারে আমাদের অন্যতম অবলম্বন। রাশিয়াসহ উন্নতশীল দেশগুলোর টিকা আবিষ্কারের প্রচেষ্টা বিশ্ববাসীকে কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে। প্রতিনিয়ত সংবাদ মাধ্যমে খবর আসছে-বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা টিকা আবিষ্কারের নিত্য নতুন কৌশল বানাচ্ছে। শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ংকর মরণঘাতি ভাইরাস করোনার থাবায় প্রাণ হারিয়েছে লাখো মানবতা। সংক্রমিত হয়েছে কোটি কোটি মানুষ। যেসব পরিবারে ভাইরাসের মরণ ছোবল পৌঁছেছে অন্তত তাদের অভিজ্ঞতাটা একটু ভিন্ন, যা সংক্রমণহীন বা মৃত্যুহীন পরিবার বা ব্যক্তির ক্ষেত্রে বোঝা দায়। সবচেয়ে আশংকার যে বিষয়টি সামনে আসে তা হল, শিশুদের পরিবেশগত ও চরিত্রগত পরিবর্তন, অভ্যাসগত পরিবর্তন আর মেধা চর্চার ক্রমান্বয়ে পতন। অভিভাবক মন্ডলী বা পিতা মাতার যে নৈতিক দায়িত্বটা এখুনি চর্চা করা দরকার তা হল : শিশুদের স্কুল চলাকালীন অভ্যাসটাকে পুরোদমে চালু করা এবং তা হতে পারে ঘরোয়া পরিবেশে নিয়মতান্ত্রিক ক্লাস চালুকরণের মাধ্যমে। ক্লাস চালু না থাকার কারণে দীর্ঘসময় ঘুমিয়ে থাকা শিশুদের তাড়াতাড়ি পৌঁছার অভ্যাসটাকে পুনঃ পুনঃ জাগ্রত করা। ধর্মীয় নীতিবোধকে একই বৃত্তে এনে তা পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলা। শিশুদের ঘুমিয়ে থাকা সুকুমারভিত্তিকে সচেতন করে তোলা। করোনাকালীন দীর্ঘ সময়ে গৃহবন্দি থাকার কারণে যে মানসিক চাপ শিশুদের উপর তৈরি হয়েছে তা থেকে ফেরানোর জন্যে তথা তাদের প্রতিভা বিকাশের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের অটোপ্রমোশনের ব্যবস্থা করা। পরিস্থিতি উন্নতির উপর ভিত্তি করে স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা এবং অবশ্যই তা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই। প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে হ্যান্ড স্যানিটাইজার এর ব্যবস্থা করা, মাঙ পরা বাধ্যতামূলক করা, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, অযথা ঝগড়া না পাকানোর বিষয়টাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা ইত্যাদি স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। কোমলমতি শিশুদের কাছে আমরা যেন বড্ড অসহায়, ভেতরে যেন অপরাধ বোধের ঢেউ ছলাৎ ছলাৎ করছে। ওরা চায় মুক্ত বিহঙ্গের মতন ভেসে বেড়াতে। আর সেই বেড়ানোর জায়গাটুকুর অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের মতন বড়দের।
লেখক: সভাপতি, রাউজানক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি)