আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পথভ্রষ্ট মানব জাতিকে সুপথে পরিচালিত করার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী–রাসূল এ ধরাধামে প্রেরণ করেছেন। সম্মানিত নবী–রাসূলগণের প্রতিনিধিত্বের ধারাবাহিকতায় তাঁদেরই কর্মসূচি প্রচার–প্রসারের জন্য গাউছ, কুতুব, অলি, আবদাল, আওতাদ, পীর–মাশায়েখ, ওলামায়েকেরাম এ ধরণীতে তশরিফ এনে দ্বীন ও মিল্লাতের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেও এমন অসংখ্য অলি–বুজর্গ আবির্ভূত হয়ে দ্বীন ও মিল্লাতের কার্যাদি সম্পন্ন করছেন। আমরা তাঁদের নিকট চিরঋণী হয়ে আছি। আমরা বড়ই অকৃতজ্ঞ বলে তাঁদেরকে স্মরণ না করে ইতিহাসের চোরাবালিতে হারিয়ে যেতে বসেছি। পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে তাদের স্মৃতিটুকু ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের ওপর বর্তায়। এ দায়বদ্ধতা এড়িয়ে গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মে দ্বীনি খেদমতে নিবেদিত প্রাণ পুরুষদের সংকট নিশ্চিত। কেননা জ্ঞান–বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় স্মরণীয়রা আজ জাতির সম্মুখে বিভিন্নভাবে উপস্থিত হচ্ছে। যেসব ক্ষণজন্মা মহান ব্যক্তিত্ব অসাধারণ মেধা ও দ্বীন মাযহাবের প্রচার সত্য প্রতিষ্ঠায় বহুমুখী অবদান রেখে গেছেন তাঁদের মধ্যে কুতুবে যমান অলিয়ে কামেল, হাযত রাওয়া, মুশকিল কুশা, শাইখুল ইসলাম শাহসুফি আল্লামা সৈয়দ মঈজুদ্দীন ফারুকী (ক.) অন্যতম। তাঁর মধ্যে বহু গুণের সমাবেশ ঘটেছিলো। তাঁর অসাধারণ জ্ঞান ও গুণের কারণে তিনি ছিলেন তাঁর সময়কালে শীর্ষস্থানীয় বরণীয় ও পরবর্তীদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। তাঁর বরকতপূর্ণ সান্নিধ্য ও জ্ঞানালোকে দীপ্ত হয়ে ধন্য হয়েছে অগণিত ভক্ত, অনুরক্ত ও সত্যানুসন্ধানী মানুষ। আল্লামা জালালুদ্দীন রুমী (ক.) কতই না সুন্দর বলেছেন– ‘এক জমানা সুহবতে বা আউলিয়া, বেহতর আজ ছদ ছালে তা’আত বেরিয়া’ অর্থাৎ : ‘কিছুক্ষণ সময় আউলিয়ায়ে কেরামের সংস্পর্শে থাকা শত বছরের বেরিয়া (লৌকিকতা বিহীন) ইবাদত হতে উত্তম।’ এ কারণে আল্লাহর অলিগণের মোহাব্বত এখতিয়ার করা আমাদের বাঞ্ছনীয়। আর শাহ্সুফি আল্লামা সৈয়দ মঈজুদ্দীন ফারুকী (ক.) আল্লাহর অলিগণের এক অসাধারণ নমুনা এবং এক মহান ব্যক্তিত্ব।
হযরতের বেলাদত, শৈশবকাল ও শিক্ষা জীবন : হযরত শাহ্সুফি আল্লামা সৈয়দ মঈজুদ্দীন (ক.) ১২৪৩ হিজরী মোতাবেক ৫ মাঘ ১২৩২ বাংলা এবং ১১ মে ১৮২৫ খ্রি. বৃহস্পতিবার সুবেহ সাদিকের সময় এই পৃথিবীতে শুভাগমন করেন।
আধ্যাত্মিক জগতের দ্বীপ্তিমান নক্ষত্র হযরত শাহছুফি আল্লামা সৈয়দ মঈজুদ্দীন আল–ফারুকী (ক.) ‘বড় মাওলানা’ নামে সমধিক পরিচিত। তিনি একটি জীবন্ত ইতিহাস। তিনি শৈশব হতে তাঁর মার্জিত ব্যবহার, আচার–আচরণ এবং চাল চলনের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ শিশু অদূর ভবিষ্যতে আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ প্রাপ্ত হয়ে মানবতার সেবা ও আল্লাহ ও রাসুলের প্রেমের আদর্শ হবেন। পাঁচ বছর বয়স থেকে তিনি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, প্রতিদিন পবিত্র কুর’আন তেলাওয়াত করতেন, তিনি সাত বছর বয়স থেকে নিয়মিত রোযা রাখতেন। তার শৈশবকালের ঘটনা সমূহ যেমন চমকপদ ও বিস্ময়কর তেমনি আশ্চর্যও অবাক হবার মত বিষয়। আরও বিস্ময়কর বিষয় হল ছোটবেলা থেকে তিনি যেখানে মিলাদ মাহফিল ও জিকির আজকার হতো সেখানের মজলিশে যোগদান করতেন। ধর্মীয় কোনো অনুষ্ঠানের কথা শুনলেই তিনি বাধা বিপত্তি পেরিয়ে মজলিসে অংশগ্রহণ করতেন। তার শৈশব অবস্থার চাল–চলন, আচার–ব্যবহার, মানবসেবা, তাকওয়া অর্জন, সাধনা ও রিয়াজত পালনের মাধ্যমে তাঁর মাদারজাত অলি হওয়ার প্রমাণ বহন করে। সত্যিই তাঁর পবিত্র ও আদর্শ জীবন চরিতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চরিত্র মাধুর্য পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়েছে; হবে না কেন? তিনিই পবিত্র আহলে বায়তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বংশ ধারার অংশ। স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি এলমে শরীয়ত তথা কুর’আন–হাদিস, তাফসির, ফিকাহ, বালাগাত ও মানতিক বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন তাঁর বিভিন্ন বিষয়ের উস্তাদদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উস্তাদ হলেন মাওলভী মুহাম্মদ নুরুদ্দিন, মাওলানা জালালুদ্দীন বুখারী, মৌলভী আমিরুজ্জমান এবং নিজ চাচা শায়খুল মশায়েখ আল্লামা সৈয়দ আব্দুল করিম আলকাদেরী (ক.), মৌলভী আব্দুল ফত্তাহ প্রমুখ। তৎসময়ে চট্টগ্রামে উচ্চ শিক্ষা যা ছিল তা শেষ করে তিনি আরো উচ্চ শিক্ষার জন্য সকলের সহযোগিতায় ১২৫৯ হিজরিতে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তিনি সকল শ্রেণিতে কৃতিত্বের সাথে প্রথম স্থান অর্জন করে ১২৬৭ হিজরি সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে উচ্চ ডিগ্রী (টাইটেল ডিগ্রী) অর্জন করে সমাজ, দেশ ও জাতির খেদমতে ছড়িয়ে পড়েন।
পারিবারিক জীবন : হযরত শাহসুফি আল্লামা সৈয়দ মঈজুদ্দীন ফারুকী (ক.) ফটিকছড়ি থানার অন্তর্গত বক্তপুর গ্রামের মাওলানা মোহছেন আলী শাহ এর কন্যার সাথে বিবাহে আবদ্ধ হন। উক্ত সংসারে তাঁদের কোনো ছেলে– মেয়ে হয়নি পরে তিনি ছিপাতলী গ্রাম থেকে দ্বিতীয় বিবাহ করেন, সে সংসারে তাঁর ছেলেমেয়ে রয়েছে তৎমধ্যে শাহজাদা শাহ্সুফি আল্লামা সৈয়দ ইদ্রিছ (ক.) অন্যতম। তিনি অবিবাহিত অবস্থায় হযরতের জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন। পরে তিনি বংশের প্রদীপ জ্বালানোর নিমিত্তে নিজ কন্যা শাহজাদী সৈয়দা জাবেদা খাতুনকে আপন ভাগিনা হযরত মাওলানা সৈয়দ মকবুল আহমদ ছাহেবের সাথে শাদী দিয়ে নিজ তত্ত্বাবধানে রাখেন।
শেষ কথা: যুগপৎ শরীয়ত তরিকতের ধারক–বাহক আল্লামা মঈজুদ্দীন ফারুকী (ক.) জীবদ্দশায় ইলমে শরীয়তের জ্ঞান–চর্চা, ছাত্রদের মাঝে বিতরণ, অসংখ্য কুরআন, হাদিসের প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা, সমাজ সংস্কারমূলক বিবিধ কার্যক্রম, তরিকতের চর্চা, তরিকতের দীক্ষা পথ হারা মানুষের ঈমান, আমলের হেফাজত, মুর্দা কলবকে জীবন্ত করণ, গোমরাদেরকে সঠিক পথে এনে আল্লাহর সাথে মিলিত করণ, নবি করীম (দ.) এর পবিত্র হাতে নিজের মুরিদ, ভক্ত, অনুরক্ত, খলিফাদের সোপর্দ করা প্রভৃতি কাজ করে তিনি আপন মাজারে শায়িত আছেন। প্রতিদিন হাজার হাজার লোক তাঁর মাজার শরীফ থেকে ফয়েজ বরকত হাসিল করছেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে বাবাজানের ফয়েজ হাসিল করার তাওফিক দান করুন ‘আমিন’ বেহুরমতে সায়্যিদিল মুরসালিন।
লেখক: অধ্যক্ষ, ওয়াছিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা, সৈয়দপাড়া, গুমামর্দ্দন, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।