শান্তি ছাড়া সমৃদ্ধি সম্ভব নয়। তাই বিশ্বব্যাপী শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন লায়ন নেতৃবৃন্দ। একইসঙ্গে এই পৃথিবীর সমৃদ্ধির লক্ষ্যে একযোগে কাজ করে যাচ্ছেন তারা।
গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল জেলা ৩১৫বি–৪ এর উদ্যোগে আয়োজিত ডিজিস কল সেমিনার এবং গোল্ড মেডেল প্রদান অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন লায়ন নেতৃবৃন্দ। নগরের ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে দুই পর্বের অনুষ্ঠানে প্রথম পর্বে ছিল ডিজিস কল মিশন ফর পিস অ্যান্ড প্রসপারিটি বা শান্তি ও সমৃদ্ধির অন্বেষায় এর ওপর সেমিনার। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। উদ্বোধক ছিলেন লায়ন্স ইন্টারন্যাশনালের সদ্য প্রাক্তন আন্তর্জাতিক পরিচালক লায়ন কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ। এ পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন চ্যানেল আই–এর পরিচালক শাইখ সিরাজ। দ্বিতীয় পর্বে মানবসেবায় স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ এবং সাবেক জেলা গভর্নর লায়ন এম আই খানকে গোল্ড মেডেল দেয়া হয়। এ পর্বে লায়ন কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ প্রধান অতিথি ও পিডিজি ফোরাম চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান ও দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক সম্মানিত অতিথি ছিলেন। স্বাগত বক্তব্য দেন, লায়ন্স জেলা ৩১৫–বি৪, বাংলাদেশের গভর্নর লায়ন এমডি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, শান্তি চাইলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়াতে হবে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। দারিদ্র্যকে পরাজিত করতে পারলে পৃথিবীতে শান্তি আসবে। তিনি বলেন, যেখানে ভায়োলেন্স (সহিংসতা) সেখানে খাদ্যসংকট দেখা দেয়। কেনিয়ায় এমনটি হয়েছে। ভায়োলেন্স সে যে কারণেই হোক না কেন। আমাদের দেশে যেন এমনটি না হয় তা খেয়াল রাখতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে আর্থিক খাতে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। কৃষকরা ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করতে পারছেন। পথশিশুরাও অ্যাকাউন্ট করছে ব্যাংকে। দারুণ সব উন্নয়ন সূচকের অধিকারী আমরা। ১৯৯১–১৯৯৫ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমি ১ শতাংশ। কিন্তু ২০১৬–২০২১ সালে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ শতাংশের বেশি। শিল্পখাতে জিডিপি ২২ শতাংশ থেকে ৩৭ শতাংশ হয়েছে, দারিদ্র্যসীমা ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এ অর্জন যেন হেলায় নষ্ট না করি।
তিনি বলেন, উন্নয়নের জন্য শান্তি দরকার। শান্তি উন্নয়নের পূর্বশর্ত। শান্তি ছাড়া বিনিয়োগ হয় না। বাজার, রাষ্ট্র ও সমাজ এই তিনটির জন্য শান্তি দরকার। এসময় বিশ্বব্যাপী নানা সহিংসতা, ইউক্রেন–রশিয়া, গাজা–ইসরায়েল যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, পশ্চিমের সভ্যতার এই নেতিবাচক দিক নিয়ে মৃত্যুর মাত্র তিন মাস আগে ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ভর্ৎসনার সুরে লিখেছিলেন, ‘এই মানবপীড়নের মহামারী পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে আজ মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাস কলুষিত করে দিয়েছে।’ তবে তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এই পরাভব মেনে নেবে না পূর্বের বিশ্ব। কেননা তিনি মনে করতেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের এক নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরও হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি।
লায়ন কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমান অশান্ত পৃথিবীর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা গভর্নর যে ডাক দিয়েছেন, শান্তি ও সমৃদ্ধির অন্বেষায় এটি একটি যুগোপযোগী ডাক। এ মুহূর্তে শান্তি ও সমৃদ্ধের অন্বেষা– এর চেয়ে ভালো প্রতিপাদ্য আর হতে পারে না। এই পৃথিবীর সমৃদ্ধির লক্ষ্যে লায়ন নেতৃবৃন্দ একযোগে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, শান্তির জন্য যুদ্ধ করতে হবে না। মানুষকে ভালোবাসতে হবে।
তিনি বলেন, বিশ্বে মুসলিম দেশগুলো বিভক্ত হয়ে গেছে। তারা কিন্তু শান্তির অন্বেষা করছে না। কিন্তু লায়নিয়জম সবসময় শান্তির অন্বেষা করে। ইউক্রেন–রাশিয়া, গাজা, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর এক হওয়া উচিত। মুসলিম দেশগুলো এক না হলেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বলেছেন তিনি গাজার ধ্বংসযজ্ঞ সমর্থন করেন না। এসময় তিনি শান্তি না থাকলে উন্নয়ন হতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন।
শাইখ সিরাজ বলেন, কোভিড পরিস্থিতির আগে বিশ্ব শান্তির দিকে এগুচ্ছিল। কোভিডকালীন সেখানে আঘাত আসে। তিনি বলেন, বর্তমানে বিশ্বে যে অশান্তি তার জন্য ‘ফোর সি’–কে আমি দায়ী করি, এই ফোর সি বিশ্ব শান্তি নষ্ট করে দিচ্ছে। ফোর সি হচ্ছে– কোভিড (করোনা), কনফ্লিক্ট (দ্বন্দ্ব), কস্ট (মূল্য) এবং ক্লাইমেট (জলবায়ু)। তিনি বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় নিজ ঘর থেকে। পরিবারে শান্তি না আসলে পৃথিবীর কোথাও শান্তি আসবে না।
খাদ্যে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, নগরায়নের কারণে কৃষি জমছে কমছে। এরপরও বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে দেশে। তিনি বলেন, কৃষিতে এমন প্রযুক্তি আসছে বিস্মিত হতে হয়। এ প্রযুক্তি কৃষিকে বাঁচাবে। তবে কৃষি আর কৃষকদের হাতে থাকবে না। কারণ এখানে ইনভেস্টের বিষয় থাকবে। তিনি বলেন, আগামীর খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জটা অনেক বড়। জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের বিপর্যস্ত করবে। ২০৫০ সালের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ শহরে বাস করবে। তখন সেই ৩০ ভাগ মানুষ দেশের শতভাগ মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন করবে এই আশা করা দুরূহ। তাই আমাদের সকলকে যার যার স্থান থেকে কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব এম এ মালেক বলেন, আমরা যদি নিজেদের ঘরে শান্তি বজায় রাখতে পারি তাহলে সেখান থেকে আমাদের প্রতিবেশি, সমাজসহ সকলের কাছে শান্তির বার্তা নিয়ে যেতে পারব। তাই ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। ঘরে যদি প্র্যাক্টিস না করি তাহলে বাইরে প্র্যাক্টিস করতে পারব না। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বকে পরিবর্তন করব, তার আগে নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে। নিজেকে চেঞ্জ না করলে অন্যকে কীভাবে চেঞ্জ করব।
তিনি বলেন, লায়নের একটি মোটো আছে, ‘ওয়্যার দেয়ার’ ইজ এ নিড, দেয়ার ইজ এ লায়ন। হোয়াট ইজ দ্য নিড? নিডটা ছিল মা ও শিশু হাসপাতাল চেয়েছে চট্টগ্রামে একটি ক্যান্সার হাসপাতাল করতে। কারণ চট্টগ্রামে ক্যান্সারের কোনো হাসপাতাল বা চিকিৎসার তেমন সুযোগ–সুবিধা ছিল না। আমি মা ও শিশু হাসপাতালের একজন জীবন সদস্য। তারা এসে বলেছে, আপনি সাথে থাকলে আমরা ক্যান্সারের একটি ইউনিট করতে পারব। গত ৬ নভেম্বর ১০০ শয্যার সে হাসপাতাল উদ্বোধন করা হয়েছে। সেখানে ক্যান্সারের কেমোর জন্য যত ধরনের ইক্যুপমেন্ট দরকার সবকিছু স্থাপন করা হয়েছে। শুধু আমি একটু যুক্ত ছিলাম। আমি এবং আমার পত্রিকার মাধ্যমে সেজন্য ত্রিশ কোটি টাকা ক্যাশ তুলে দিয়েছি। তারা আরো ৪০ কোটি টাকার মেশিন বসিয়েছে। আশা করছি আপনাদের দোয়ায় এবং চট্টগ্রামবাসীর সহায়তায় সেটাও তুলতে পারব।
গোল্ড মেডেল পাওয়া লায়ন ইঞ্জিনিয়ার এম আই খান অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, লায়ন সুযোগ করে দিয়েছে, আমি চেষ্টা করেছি অসহায়দের মুখে হাসি ফোটাতে। তিনি লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশাল জেলা ৩১৫বি–৪ কে ধন্যবাদ জানান।
স্বাগত বক্তব্যে জেলা গর্ভনর লায়ন এমডিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, একতা ছাড়া শান্তি অসম্ভব। শান্তি ছাড়া সমৃদ্ধ অর্থহীন। সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে যে কোনো সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। তাই আমাদের সকলকে একতাবদ্ধ হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমৃদ্ধির পথে কাজ করে যেতে হবে। বর্তমানের এই সংকটকালীন সময়ে শান্তির বড়ই অভাব।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন কাউন্সিল চেয়ারপার্সন লায়ন ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল ওয়াহাব, আইডি পিডিজি এন্ডর্সি লায়ন নাজমুল হক, কাউন্সিল সেক্রেটারি জেলা গভর্নর লায়ন আহমেদুজ্জামান, লায়ন্স জেলা ৩১৫–বি৪ এর ১ম ভাইস জেলা গভর্নর লায়ন কোহিনুর কামাল, ২য় ভাইস জেলা গভর্নর লায়ন মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ অপু।
আরও উপস্থিত ছিলেন লায়ন এ. কাইয়ুম চৌধুরী, লায়ন রুপম কিশোর বড়ূয়া, লায়ন রফিক আহমেদ, লায়ন মোহাম্মদ কবির উদ্দিন ভুঁইয়া, লায়ন এস এম শামসুদ্দিন, লায়ন শাহ আলম বাবুল, লায়ন লায়ন মঞ্জুর আলম মঞ্জু, লায়ন নাসির উদ্দীন চৌধুরী, লায়ন কামরুন মালেক, লায়ন আল সাদাত দোভাষ। আরও উপস্থিত ছিলেন ক্যাবিনেট সেক্রেটারি লায়ন আবু বক্কর সিদ্দিকী ক্যবিনেট ট্রেজারার লায়ন মো. ইমতিয়াজ ইসলাম বিভিন্ন ক্লাব থেকে আগত লায়ন নেতৃবৃন্দ। অনুষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে লায়ন এস এম আশরাফুল আলম আরজু, সেক্রেটারী হিসেবে লায়ন পারভীন মাহমুদ এফসিএ এবং ট্রেজারার হিসেবে লায়ন অঞ্জন শেখর দাস সিআইপি দায়িত্ব পালন করেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন লায়ন জাহাঙ্গীর মিঞা ও লায়ন আয়েশা হক শিমু।