শাকিলের ৯০ দিনের পথ চলার গল্পটা যেমন

সমুদ্র থেকে হেঁটে এভারেস্টের চূড়ায়

| শুক্রবার , ২৩ মে, ২০২৫ at ৬:৫৩ পূর্বাহ্ণ

দুঃসাহসিক এক যাত্রার ছক এঁকে তখন ইনানী সৈকতে শাকিল। নানা সংশয় আর ভয় উঁকি দিলেও অদম্য এ যুবক মনস্থির করেন চূড়ান্ত লক্ষ্যে। ৯০ দিনের যাত্রাপথে হাঁটা শুরু করেন। সব বাঁধা, জটিলতা পেরিয়ে ছয়দিন আগেই স্বপ্নের কাঙ্ক্ষিত চূড়ায় পৌঁছে যান। সমুদ্র থেকে হেঁটে হিমালয়ে পৌঁছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছেন শাকিল। ১৯ মে সকালে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে আনন্দ অশ্রুতে উদযাপন করেছেন। অনিশ্চয়তার দীর্ঘ পথে মৃত্যুর চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে আনা জয়কে ভাগ করে নিয়েছেন নিজ দেশ ও মানুষের সঙ্গে। খবর বিডিনিউজের।

নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে তিনি লিখেছেন, এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আমি কেঁদেছি। কৃতজ্ঞতায়, আনন্দে আর দায়িত্ববোধে। এই আরোহণ শুধু আমার একার নয়। এটি আমার দেশের, আমার মানুষদের, আর সেই সকল তরুণের যারা আজও স্বপ্ন দেখে নিজের সীমা ভেঙে কিছু করে দেখানোর। সপ্তম বাংলাদেশি হিসেবে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার নিজের ফেসবুকে তার সমুদ্র থেকে হেঁটে এভারেস্ট জয়ের গল্প তুলে ধরেছেন গাজীপুরের এ যুবক। শাকিল লেখেন, ১৯ মে ২০২৫। সকাল সাড়ে ৬টা। আমি দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুতে, মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায়। মাথার ওপরে বিশুদ্ধ নীল আকাশ থাকার কথা ছিল, কিন্তু প্রকৃতি সেটা চায়নি। চেয়েছিল চরম পরীক্ষা। পায়ের নিচে ছিল অসীম শূন্যতা। ৮৮৪৮ দশমিক ৮৬ মিটার ওপরে দাঁড়িয়ে আমি শুধু একজন পর্বতারোহী নই, আমি তখন হাজারো আবেগ, ত্যাগ, সংগ্রাম আর স্বপ্নের প্রতিনিধি।

কঠিন পথে মৃত্যুর চোখ রাঙানি জয় করার গল্প তুলে ধরে তিনি লেখেন, এ পথ সহজ ছিল না। হিমালয়ের অতল গভীর বরফের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে আমাদের জীবন বিন্দু। প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল মৃত্যু আর জীবনের মাঝখানে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য। যমুনা নদীর উত্তাল খরস্রোতা ঢেউ, অনিশ্চয়তার দীর্ঘ পথ, খুম্বু আইসফল, লোৎসে ফেস, সাউথ কল, হিলারি স্টেপএকেকটা জায়গা যেন একেকটা মানসিক যুদ্ধক্ষেত্র ও মৃত্যুর চোখ রাঙানি। অক্সিজেনশূন্য উচ্চতায় কৃত্রিম অক্সিজেন মাস্কবদ্ধ মুখে প্রতিবারই মনে হয়েছে আর পেরে উঠব না। কিন্তু হৃদয়ে বাজতে থাকা বাংলাদেশের নাম আর ‘সি টু সামিট’ অভিযানের অঙ্গীকার আমাকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের বাগচালা গ্রামের এ যুবকের পুরো নাম ইকরামুল হাসান শাকিল। ছোটবেলা কেটেছে সেখানেই। কৃষক পরিবারের এ সন্তান পড়াশোনার ফাঁকে জমিতে কৃষি কাজেও বাবার সঙ্গী ছিলেন। কলেজে পড়তে ঢাকায় আসেন। ২০০৯ সালে যোগ দেন পদাতিক নাট্য সংসদ বাংলাদেশে। ঢাকায় এসে পর্বতারোহী এম এ মুহিত ও নিশাত মজুমদারের সাক্ষাৎকার দেখে আগ্রহী হয়ে উঠেন পর্বতারোহণে। ২০১২ সালে তিনি বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবে যোগ দেন। ২০১৩ সালে ১১ দিনে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন পায়ে হেঁটে। এরপর বান্দরবানের পাহাড়ে শুরু করেন ট্রেকিং। তারপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে প্রশিক্ষণ নেন ভারতের নেহেরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিংয়ে। ২০১৫ সালে নেপালে মাউন্ট কেয়াজোরি, ২০১৯ সালে হিমলুং ও ডোলমা খাং পর্বতশৃঙ্গ আরোহণ করেন সফলভাবে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম পবর্তারোহী হিসেবে ১০৯ দিনের এক যাত্রায় নেপালের পূর্ব থেকে পশ্চিমে ১৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘গ্রেট হিমালয় ট্রেইল’ পাড়ি দেন। এ যাত্রায় ২৯টি পর্বতের ‘হাইপাস’ অতিক্রম করতে হয়েছে। বিশ্বে এ ট্রেইল পাড়ি দেওয়া ‘৩৩তম ব্যক্তি’ তিনি।

ফেসবুকে শাকিল লেখেন, আমার এ যাত্রা শুরু হয়েছিল কঙবাজারের ইনানী সমুদ্র সৈকত থেকে, যেখানে প্লাস্টিক বর্জ্যে দমবন্ধ হয়ে আসছে সাগর, সমতল, পাহাড়ের জীবন। আমি সেই দূষণ আর পরিবর্তনের বার্তা নিয়েই পর্বতমুখী হয়েছিলাম, যেন বিশ্বের সর্বোচ্চ শিখরে দাঁড়িয়ে বলতে পারি– ‘আমরা যদি পাহাড় জয় করতে পারি, তবে নিজের ভেতরের অসচেতনতাকেও জয় করতে পারি’। ‘সি টু সামিট’ কেবল একটি অভিযান নয়, এটি একটি বার্তা, একটি বিপ্লব।

শাকিল ইনানী সমুদ্র সৈকত থেকে হাঁটা শুরু করেন চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি। এরপর চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা ও মুন্সীগঞ্জ হয়ে ১২ দিন পর ঢাকায় পৌঁছান। কয়েক দিন বিরতির পর গাজীপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ হয়ে ২৮ মার্চ পৌঁছান পঞ্চগড়ে। পরদিন প্রবেশ করেন ভারতে। জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং হয়ে ৩১ মার্চ পা রাখেন নেপালে। আর এভারেস্টের বেইজ ক্যাম্পে পৌঁছান ২৯ এপ্রিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ২৫ মে থেকে সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণে শুরু হচ্ছে ভূমি মেলা
পরবর্তী নিবন্ধসার্কিট হাউসের মাঠে ‘গ্রিন পার্ক’ করতে চান মেয়র শাহাদাত