শাকিল : চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়

সুলতান আহমদ আশরাফী | মঙ্গলবার , ৩০ জুলাই, ২০২৪ at ১১:১১ পূর্বাহ্ণ

প্রাণঘাতী ক্যান্সারের সাথে তিন বছরের অধিককাল যুদ্ধে হার মানা সুন্দর সুঠাম দেহাবয়বের মাঝবয়সী যুবক ইমতিয়াজ হোসেন শাকিলের জীবন অবসানে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সকলে শোকসাগরে নিমজ্জিত। নিয়মানুবর্তীতা, সচেতনতা, সর্বোপরি সাধ্যমত উন্নত চিকিৎসাকে তোয়াক্কা না করে মৃত্যুদূত তার জীবন কেড়ে নেয়াতে আমরা শোকে মূহ্যমান। পরম করুণাময়ের ইচ্ছায় কারো হাত নেই বলে সময় অসময়ে পার্থিব জগতে মৃত্যু অপরাজেয়। আমাদের দেশে দিনদিন ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই রোগীরা ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের অনুভূতি বিবেচনা করে আজকের লেখার সূচনা।

একান্ত ঘনিষ্ঠজন হেতু বেদনাপ্লুত হৃদয়ে শাকিলের গুণকীর্তন লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশে সংকোচ হলেও এই লেখাটি আদৌ অতিরঞ্জিত নয়। এটা শাকিলের তথা একজন ক্যান্সার রোগীর জীবনের বাস্তব চিত্র। দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে শাকিলের জীবনচরিত রচনা করতে গিয়ে লেখায় কোন অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য পাঠকের কাছে অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

মাত্র ৫০ বছর জীবনকালে শাকিল মাবাবার প্রতি অপরিমেয় শ্রদ্ধা আর ভালবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছে। দুই সন্তানের জনক হলেও শাকিল ছিল মাবাবার কাছে চিরকিশোর। ক্যান্সার আক্রান্ত শাকিলের প্রতি মাবাবার স্নেহমমতা আচারআচরণে তারই পরিচয় মেলে। দিবারাত্রি সন্তানের শিয়রে বসে হতভাগা করুণাময়ী মায়ের অশ্রুবিসর্জন সবাইকে নাড়া দিয়েছে। চোখের জলকে সম্বল করে দর্শনার্থীদের কাছে সন্তানের জন্য দোয়াকামনা শত্রুমিত্র সবাইকে নীরবে অশ্রুসিক্ত করেছে। দীর্ঘদিন হাসপাতালে অবস্থানকালে মায়ের প্রতিটি নিঃশ্বাসে ছেলের আরোগ্য কামনায় আল্লাহর আরশও যেন বারবার কেঁপে উঠেছে। মৃত্যুশয্যায় শায়িত শাকিলের ক্ষীণস্বরে আম্মাআম্মা ডাকে বৃদ্ধা রোগাক্রান্ত মায়ের হৃদয় চুরমার হয়েছে। হাসপাতালের কেবিনে ছেলের পাশে রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়ে আবার দিনভর অমানুষিক কষ্ট করেছেন। ছেলের মৃত্যুতে সব কষ্টের অবসান ঘটলেও মা কেঁদে কেঁদে ২বলছিলেন : “আমার ছেলে কেন আরো কিছুদিন আমার কাছে রইল না।” তাই কবির ভাষায় বলতে হয় : “হেরিলে মায়ের মুখ / দূরে যায় সব দুঃখ। মায়ের কোলেতে শুলে জুড়ায় পরাণ।” আসা যাক বয়সের ভারে আক্রান্ত বেদনা জর্জরিত বাবার কথায়। স্বামীস্ত্রী দুজন জীবনের দুই তৃতীয়াংশ মহান পেশা শিক্ষকতায় নিয়োজিত থেকে বর্তমানে জীবনসায়াহ্নে উপনীত। সন্তানবৎসল পিতা শওকত হোসেনের সাজানো সংসারে শাকিলের মৃত্যু প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে। হাসপাতালের কেবিনে টানা কয়েক রাত অসুস্থ ছেলেকে সঙ্গ দিতে গিয়ে বাবা নিজেই ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। পরম করুণাময়ের অশেষ কৃপায় বেঁচে গেলেও শরীরের সচল চাকা অচল হয়ে গেছে। অথচ এই অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষটিকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হাতপা টেনেহেঁচড়ে ছেলের জানাজায় শরিক হতে হয়েছে এবং ছেলের দাফন প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে।

শাকিলের প্রতি বড়বোন শারমিনের আদরস্নেহের চিত্র তুলে ধরা সম্ভব নয়। পরিবারের দুরবস্থায় শরীক হতে স্বামীসন্তানকে রেখে সুদূর আমেরিকা হতে ছুটে এসেছে বটে। নিজের চোখের সামনে প্রাণপ্রিয় ছোট ভাইয়ের জান কবজ দেখে জগদ্দল পাথরের নিচে চাপা পড়েছে। ভাইয়ের মৃত্যু যেন শারমিনের কাছে স্বীয় অঙ্গহানির সমতুল্য। ভাইয়ের বিয়োগব্যথায় কাহিল শারমিন যাতে অনতিবিলম্বে শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে স্বাভাবিক জীবন নিয়ে প্রবাসে ফিরে যেতে পারে, এটাই স্রষ্টার কাছে কাম্য।

শত প্রতিকূলতার মাঝেও একমাত্র ছোটভাই শামীম যেভাবে অপরিসীম মানসিক দৃঢ়তা নিয়ে সংসারের হাল ধরেছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। অসুস্থ ভাইয়ার চিকিৎসার্থে তিন বছর ধরে ভারতসহ ঢাকাচট্টগ্রাম দৌড়ঝাঁপে জীবনের সুখশান্তি বিসর্জন দিয়েছে। ভাই এবং বাবার অসুস্থতার কারণে সে হয়ে উঠেছে তাদের সংসারের একমাত্র কাণ্ডারি। তার চেষ্টার সফলতা একমাত্র আল্লাহর হাতে। আমরা তার দীর্ঘায়ু কামনার সাথে সাথে সংসার গোছানোয় তার সফলতা কামনা করি।

মাত্র ১৫ বছরের সংসার জীবনের ইতি ঘটিয়ে সহধর্মিণী রুমাকে অকালবিধবা করে দিয়ে শাকিল পরপারে চলে গেছে। স্বামীর অসুস্থতা নিয়ে চাপা টেনশনে সে নিজেও বছরখানেক আগে মাইনর স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। এমনিতেই চুপচাপ স্বভাবের মেয়েটা স্বামীর মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এই মূহুর্তে তার মনের অবস্থা একমাত্র আল্লাহই জানেন। আমরা শুধু তার জন্য দোয়া করতে পারি।

এসএসসি পরীক্ষার্থী মেয়ে রাইসা এবং সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ছেলে রিয়াসাত একসাথে অসুস্থ মা, বাবা এবং দাদার দেখাশোনা করতে গিয়ে এই অল্প বয়সেই অনেকটা পরিপক্ক হয়ে উঠেছে। বাবা শুধু তাদের মাথার ওপর একটা ছায়াই ছিল না, বাবা ছিল তাদের এক অন্তরঙ্গ বন্ধু। বাবার দাফনকালে রিয়াসাতের অঝোর কান্না উপস্থিত সবাইকে সেই কথাই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল। এত অল্প বয়সে বাবা হারানোর ব্যথাটা তারা যেন সামলে উঠতে পারে, সেজন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি।

শাকিলের জন্য তার পরিবারের সদস্যদের বাইরেও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনরা যে যতটুকু পারেন কষ্ট করেছেন। বিশেষত তার খালাত ভাই মারুফ সারাদিন চাকরি করে এসে রাতের বেলা অসুস্থ ভাইকে সেবা করেছে।

শাকিলের জীবনের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ছিল তার বন্ধুবান্ধব। শাকিল এবং তার বন্ধুরা ছিল পরস্পরের জীবনের নানা সুখদুঃখের অকৃত্রিম সাথী। তার বন্ধুরা প্রত্যেকেই চরিত্রবান, সদালাপী, হাস্যোজ্জ্বল, আত্মত্যাগী, প্রচারবিমুখ এবং সমাজহিতৈষী। তাদের মধ্যে নেই কোন ধর্মীয় ভেদাভেদ। নেই কোন দাম্ভিকতা। বন্ধুমহলে এধরণের অসামপ্রদায়িকতা আর ত্যাগী মনোভাব আমার দৃষ্টিতে বিরল। রোমেনের মা নামীয় শাকিলের মাসীর অপত্য স্নেহমমতা ও আন্তরিকতার কথা লিখে তাঁকে খাটো করতে চাই না। শাকিল আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাইকে শোকসাগরে ভাসিয়ে গত ২৬ জুলাই শুক্রবার আর না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছে। মহান রাব্বুল আ’লামীন তাকে জান্নাতবাসী করুন।

লেখক : সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমেধা পাচার : দেশের অগ্রগতিতে অন্তরায়
পরবর্তী নিবন্ধবৃদ্ধাশ্রম কালচার : যার জন্য আমরাই দায়ী