শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী

রোকন উদ্দীন আহমদ | শুক্রবার , ২০ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ

বেগম মুশতারী শফী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং শব্দ সৈনিক। সামপ্রদায়িকতা, মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে দেশের অনতম নেতৃত্ব। চট্টগ্রামে সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে আজীবন সক্রিয় মুখ। তিনি মুক্তিযুদ্ধের শহীদজায়া এবং শহীদ ভগ্নি। একজন খ্যাতিমান লেখক। শৈশবে পিতৃমাতৃহীন হয়েও তাঁর জীবন সমাজের জন্য এক আদর্শ।

১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পৈতিৃক নিবাস ফরিদপুর জেলার গেরদা গ্রামে। পিতা খন্দকার নাজমুল হক আনসারী ছিলেন বৃটিশ আমলের ডেপুটি পুলিশ সুপার। দাদা খন্দকার হেলাল উদ্দিন ছিলেন সাব রেজিস্ট্রার। তাঁর মায়ের নাম আরেফা খাতুন। পিতা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনা সম্পন্ন, সংস্কৃতিমনা প্রগতিশীল ব্যক্তি। ১৯৫৪ সালে দন্ত চিকিৎসক মোহাম্মদ শফীর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। মোহাম্মদ শফী চট্টগ্রাম কারাগারের ডেন্টাল সার্জন ছিলেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলায়। বিয়ের আগে তিনি চট্টগ্রামে থাকতেন চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্মকর্তা ভগ্নিপতির বাসায়। বিয়ে হওয়ার পর থেকে চট্টগ্রামে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। স্বামীর নামের শেষ শব্দ ‘শফী’ নিজের নামের সাথে যুক্ত করে বেগম মুশতারী শফী নামে পরিচিত হন। চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদীপ্ত মানুষের কাছে ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয়।

বেগম মুশতারী শফী বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ চট্টগ্রাম জেলা শাখার প্রথম আহ্বায়ক ছিলেন। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। চট্টগ্রামে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন পরিষদ, ডায়াবেটিক সমিতি ও হাসপাতাল, খেলাঘর আসরসহ অনেক সংগঠনের সাথেও জড়িত ছিলেন। তিনি লেখক, সম্পাদক, বেতার ব্যক্তিত্ব, নারী নেত্রী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও শব্দ সৈনিক। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইতিহাসে বেগম মুশতারী শফীর নাম জড়িত। তাঁর বাড়িতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইতিহাস রচিত হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার গোপন পরিকল্পনা হয় তাঁর বাড়ি মুশতারী লজে। এই বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাতা ১০ জনের মধ্যে পাঁচজনই ৩০ মার্চ পর্যন্ত মুশতারী লজে অবস্থান করেন। এই বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গোলাবারুদ সংরক্ষণ করা হয়। ফলে তাঁর স্বামী ডা. মোহাম্মদ শফী এবং ছোট ভাই এহসান আনসারীকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। এরপর তিনি সন্তানদের নিয়ে ভারতের আগরতলায় চলে যান। সেখান থেকে কলকাতায় যান।

বিগত শতকের ষাট দশকে চট্টগ্রামে ‘বান্ধবী সংঘ’ নামে একটি নারী সংগঠন গড়ে তোলেন। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে নারীদের অগ্রগতি সাধন ছিল তাঁর লক্ষ্য। নারীদের স্বাবলম্বী করতে ১৯৬৮ সালে ‘মেয়েদের প্রেস’ নামে ছাপাখানা স্থাপন করেন। মেয়েদের দিয়ে সেটি পরিচালিত হতো। নারীর মেধা যোগ্যতার মূল্যায়নে তিনি বান্ধবী পুরস্কার প্রবর্তন করেছিলেন। তিন বছর সেই পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। বান্ধবী সংঘের আয়োজনে নাটকের প্রদর্শনী করা হতো। ১৯৭১ সালে বান্ধবী সংঘের পক্ষে তিনটি নারী সম্মেলন করা হয়।

তিনি লেখক হিসেবেও সুনাম অর্জন করেছেন। তাঁর লেখা ২২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনি, স্মৃতিকথা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই। লেখার অন্যতম বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতার আকাশবাণীতে স্বরচিত কথিকা ও মুক্তিযুদ্ধের ছোট গল্প প্রচার করতেন ডালিয়া মোহাম্মদ ছদ্ম নামে। তাঁর লেখা গ্রন্থের মধ্যে গল্পগ্রন্থ– ‘দুটি নারী একটি যুদ্ধ’, ‘শঙ্খচিলের কান্না’, ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’, ‘বিপর্যস্ত জীবন’, উপন্যাস– ‘একদিন এবং অনেকগুলো দিন’, ‘বেলাঅবেলা’, প্রবন্ধগ্রন্থ– ‘আমার প্রতিরোধের আগুন’, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক– ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন গ্রন্থটি তাঁর মুক্তিযুদ্ধ দিনের স্মৃতিচারণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বাড়ি ‘মুশতারী লজ’ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঘেরাও করে তল্লাশী করে বাড়ির দোতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রক্ষিত এক ট্রাকগুলির বাক্স পায়। চৌধুরী হারুন গুলির বাক্সগুলো মজুদ রেখেছিলেন। গুলির বাক্স পাওয়ার পর তাঁর স্বামী ডা. মোহাম্মদ শফী এবং ভাই এহসান আনসারীকে পাকিস্তান সেনা বাহিনী বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। স্বামী এবং ভাইকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময়ের পরিবেশ তিনি ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ গ্রন্থে চিত্রিত করেছেন এভাবে– ‘এহসান, ছোট্ট ভাইটি আমার জিপে উঠবার আগে শেষবারের মতো চেয়ে দেখলো আমাকে। কোনো চঞ্চলতা নেই। তেমনি ধীর, তেমনি শান্ত, প্রশান্ত মুখ, নির্মল নিষ্পাপ বড় বড় একজোড়া চোখ দৃষ্টির আড়াল না হওয়া পর্যন্ত চেয়ে রইলো আমার দিকে। হয়তো তখনো ও ভাবছে, ছোট আপাকে কে দেখবে! তবু হাত নেড়ে জানালো খোদা হাফেজ। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। জিপ স্টার্ট দিয়েছে। ডা. শফী শেষবারের মতো হাত তুলে ইশারা করলো, ঘরে যাও। ওরা চলে গেলো। হারিয়ে গেলো আমার জীবনে সবকিছু’। গ্রন্থটি একটি অনন্য সাহিত্য সৃষ্টি। বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ কর্তৃক বাংলা ১৩৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শ্রেষ্ঠগ্রন্থ হিসেবে এটি পুরস্কৃত হয়েছে।

বেগম মুশতারী শফী জীবনের প্রথম মিছিলে যান ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি। সেসময় তিনি ঢাকার অভয়দাশ লেনের কামরুন্নেসা গার্লস হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। সেদিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে মিছিলে পুলিশ গুলি করে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরো কয়েজনকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সেদিন ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় মিছিল হয়। একটি মিছিল কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলের পাশে আসলে স্কুলের উপরের শ্রেণির ছাত্রীরা তালাবদ্ধ ফটক টপকে স্কুল থেকে বেরিয়ে মিছিলে যোগ দেয়। তাদের সাথে অষ্টম শ্রেণির কয়েকজন ছাত্রী বের হয়ে মিছিলে গিয়েছিলেন। তাদের সাথে বেগম মুশতারী শফীও মিছিলে গিয়েছিলেন। মিছিলে যাওয়ার খবর অভিভাবকরা জেনে গেলে তাঁকে ১৫ দিন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করা হয়েছিল। ভাষার মিছিলে অংশগ্রহণে তাঁর মনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং দেশাত্মবোধের উন্মেষ ঘটে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন– ‘গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলাম। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের গণআন্দোলন, ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ’৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন ও ৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম’।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় গিয়ে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ও নাট্যশিল্পী হিসাবে কাজ করেন উম্মে কুলসুম ছদ্ম নামে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৭ এপ্রিল তাঁর স্বামী দন্ত চিকিৎসক মোহাম্মদ শফী এবং ছোটভাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র এহসানুল হক আনসারীকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রে চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৯৫ সালে চিফ স্ক্রিপ্ট রাইটার পদ থেকে আসর নেন। এরপর একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠা করে পরিচালনা করেন। মুক্িতযুদ্ধের এই শব্দ সৈনিক ২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য ২০১৬ সলে শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফীকে বাংলা একাডেমী ফেলোশিপ দেয়। ২০২০ সালে রাষ্ট্রীয় বেগম রোকেয়া পদক প্রাপ্ত হন। ২০১৪ সালে অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন প্রদত্ত ‘মহান একুশে সম্মাননা পদকও লাভ করেন। ৪০ টির বেশি সম্মাননা পদক ও পুরস্কার পেয়েছেন।

জীবনকে তিনি উঁচু মানে নিয়ে গিয়েছিলেন আদর্শ ধারণ, দেশ জাতির সংকটে সম্মুখে অবস্থান গ্রহণ, আন্দোলনসংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে। হয়ে উঠেছিলেন চট্টগ্রামের মানুষের পরম শ্রদ্ধাভাজন। দেশপ্রেম থেকেই গিয়েছিলেন আন্দোলনসংগ্রামের অগ্রভাগে। আন্দোলন আর লেখালেখিতে হয়ে উঠেন জাতীয় ব্যক্তিত্ব। এই এক বরণীয় জীবন বেগম মুশতারী শফীর। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধআল্লাহভীতি মুমিনের শ্রেষ্ঠ অবলম্বন
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা