মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শেখ জামাল এক অনুকরণীয় তারুণ্য। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় পুত্র। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই তরুণ দেখিয়েছেন অসামান্য বীরত্ব। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গর্বিত অফিসার বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ লেফটেন্যান্ট শেখ জামালের আজ ৭০ তম জন্মদিন। দীপ্ত তারুণ্যের প্রতীক শেখ জামাল ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষা–জীবনের হাতেখড়ি সেগুনবাগিচার ডনস কিন্ডার গার্টেনে। সেখান থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন বিএফ শাহীন স্কুলে ১৯৬১ সালে। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজে ভর্তি হন। ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন শহীদ শেখ জামাল।
শৈশব থেকেই শেখ জামাল ছিলেন অত্যন্ত হাসি–খুশি ও প্রাণবন্ত। প্রচণ্ড বই পড়ুয়া ও ভীষণ আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন তিনি। কিশোর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া শেখ জামালের জীবন–কাল ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত সময়ে পড়ালেখা ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে দুর্দান্ত সাফল্য দেখান। শেখ জামাল ছিলেন ফুটবল ও ক্রিকেট খেলোয়াড়। তিনি প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে আবাহনী ক্রীড়া চক্র ও আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে খেলেছেন। ফুটবলে তিনি রক্ষণভাগে খেলতেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে শেখ জামালও ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর রোডের বাড়িতে গৃহবন্দি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য কিশোর শেখ জামাল ১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট ধানমণ্ডির তারকাঁটার বেড়া দেওয়া পাকিস্তানি বাহিনীর বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে ভারতের আগরতলা চলে যান। আগরতলা থেকে কলকাতা পৌঁছে শেখ জামাল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সহযোগিতায় ভারতের উত্তর প্রদেশের কালশীতে পৌঁছান। সকালে তাঁর মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব দেখতে পান ছেলে ঘরে নেই। সারা বিশ্বে আলোড়ন – বিদেশী পত্র পত্রিকায় ছাপা হলো পাকিস্তানি সরকার শেখ মুজিবের ছেলেকে গায়েব করেছে। শেখ জামাল মুজিব বাহিনীর (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেস, বিএলএফ) ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে ২১ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে রণাঙ্গনের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ৯ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। রণাঙ্গনে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল হয়ে উঠেছিলেন সব মুক্তিযোদ্ধার অনুপ্রেরণার উৎস। লক্ষ্য ছিল মাতৃভূমির স্বাধীনতা এবং পিতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। অসীম সাহসী শেখ জামাল রণাঙ্গনের সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ থেকেছেন সব সময়। যুদ্ধকালীন তাঁর রণকৌশল প্রশংসিত হয়েছিল সেনাবাহিনীর চৌকষ অফিসারদের কাছে। ১৯৭১ এর ২ ডিসেম্বর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ছবিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল বাংলাদেশ–ভারত সীমান্তের ১০ কিলোমিটার ভিতরে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে সেমি–অটোম্যাটিক ভারি মেশিনগানে গুলি ভরছিলেন। বিশ্ববাসী জেনে গিয়েছিল এক অদম্য সাহসী ও আত্মপ্রত্যয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধার লক্ষ্যভেদী নিশানা। ছবিটি ধানমণ্ডি জাতির পিতা স্মৃতি জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। শেখ জামালের সেই ছবিটি এখনো স্মরণ করিয়ে দেয় মহান মুক্তিযুদ্ধকে।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বন্দিদশা থেকে মুক্তি পায়নি বঙ্গবন্ধু পরিবার। অবশেষে ১৭ ডিসেম্বর তারা ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় মুক্তি পান এবং পাহারারত পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। শেখ জামাল যুদ্ধের পোশাকেই ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ফিরে আসেন। ১৯৭১ এর ২২ ডিসেম্বর যখন জাতীয় চার নেতা দেশে ফিরে আসেন, সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মঞ্চ তদারকির দায়িত্ব ছিল শেখ জামালের। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে পিতার কাছে সামরিক পোশাকেই অন্য দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ রাসেলসহ উপস্থিত ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পূর্ণাঙ্গরূপে গঠিত হলে শেখ জামাল সেনাবাহিনীর লংকোর্সের পথম ব্যাচের কমিশন্ড অফিসার হন।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের ২৯ জানুয়ারি ঢাকায় রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছেন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল জোসেফ টিটো। শেখ জামালের মধ্যে সেনাবাহিনীতে যোগদানের প্রবল আগ্রহ দেখে মার্শাল টিটো তাঁকে যুগোস্লাভিয়া মিলিটারি একাডেমিতে সামরিক প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। ১৯৭৪ সালের বসন্তে শেখ জামাল যুগোস্লাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু একেবারে ভিন্ন পরিবেশ, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং ভাষাগত অসুবিধার কারণে সেখানকার প্রশিক্ষণের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো শেখ জামালের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। এই পরিস্থিতিতে মার্শাল টিটো শেখ জামালকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সামরিক একাডেমির মধ্যে অন্যতম ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্টে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পরামর্শ দেন যেখানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসারদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়।
১৯৭৪ সালের শরতে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামরিক একাডেমি স্যান্ডহার্স্টে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের লক্ষ্যে শেখ জামাল লন্ডনে গিয়ে পৌঁছান। তবে স্যান্ডহার্স্টের পূর্বশর্ত হিসেবে তাঁকে ব্রিটেনের আর্মি স্কুল অব ল্যাংগুয়েজ এবং বেকনসফিল্ড থেকে প্রয়োজনীয় পূর্ব–প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। লন্ডনে যাওয়ার পর তিনি ‘সেলফ্রিজ’ নামের একটি দোকানে সেলসম্যানের চাকরি নেন। সেই উপার্জন দিয়ে তিনি নিজের হাত খরচ চালান এবং স্যান্ডহার্স্টে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
১৯৭৫ সালের ৩ জানুয়ারি স্যান্ডহার্স্টের স্ট্যান্ডার্ড মিলিটারি কোর্স–৮ শুরু হয়। কোর্সের মেয়াদ ছিল প্রায় ছয় মাস। ৩ জানুয়ারি থেকে ২৭ জুন ১৯৭৫। এখানে মোট ৪০০ জন ক্যাডেটের মধ্যে শেখ জামাল সহ বাংলাদেশ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে আসেন ৩ জন ক্যাডেট। ১৯৭৫ সালের মে মাসের শেষের দিকে স্যান্ডহার্স্ট থেকে ক্যাডেটরা রণকৌশলগত চূড়ান্ত অনুশীলনে (এক্সারসাইজ ডাইনামিক ভিক্টোরি) অংশগ্রহণ করতে পশ্চিম জার্মানিতে (ব্রিটিশ আর্মি অন রাইন) যান।
এই অনুশীলনকে রীতিমতো যুদ্ধই বলা যায়। গায়ে কমব্যাট ইউনিফর্ম, হাতে রাইফেল, পিঠে হ্যাভার স্যাক পরে জামাল পুরোপুরি যোদ্ধা। কখনো পাহাড়ি এলাকা, কখনো অরণ্য, কখনো খোলা প্রান্তরে চলে দুঃসাহসিক অনুশীলন। সারা দিন প্রতিরক্ষায় ট্রেঞ্চে বসে থাকা। ভোর রাতে পরিচালিত হলো গোর্খা ব্যাটালিয়নের আক্রমণ। আকাশে শত্রুর বিমান। ট্রেঞ্চের কিছু দূরে আর্টিলারি শেল পড়ছে। চলছে লাইভ ফায়ারিং। শত্রুদের হটিয়ে এবার এগিয়ে যেতে হবে। পাইন বৃক্ষশোভিত অরণ্যময় এলাকায় হেলিকপ্টার থেকে নামতে হলো কয়েক শ’ ফুট। কখনো শত্রুর প্রতিরক্ষায় বেপরোয়া আক্রমণ।
এভাবে ছয় মাস কঠোর প্রশিক্ষণের পর একই বছর ২৭ জুন অংশগ্রহণকারীদের প্রার্থিত পাসিং আউট প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। ওইদিন প্যারেড রিভিউ করেছেন রাজকুমারী এলিস। বিদেশি ক্যাডেটদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে কমিশন লাভ করেন তিনজন গর্বিত তরুণ–অফিসার ক্যাডেট শেখ জামাল, আলাউদ্দিন মো. আবদুল ওয়াদুদ এবং মাসুদুল হাসান। শেখ জামাল ১৯৭৫ সালের ১ আগস্ট থেকে স্যান্ডহার্স্টেই পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং তাঁর দুই প্রিয় বন্ধু বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছেন জেনে তিনি দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে দেশে কিছুদিন থেকে আবার পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্সে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর।
স্যান্ডহার্স্ট একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে ঢাকা সেনানিবাসস্থ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন। ব্যাটালিয়নের চার্লি কম্পানির কম্পানি কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া বীরপ্রতীক। ক্যাপ্টেন নজরুলের অধীনে শেখ জামালের রেজিমেন্ট জীবনের হাতেখড়ি হলো ‘কম্পানি অফিসার’ হিসেবে। ইউনিটে যোগদানের দিন সেনাবাহিনীর খাকি ইউনিফর্ম পরে বাড়িতে ফেরেন শেখ জামাল। মুগ্ধ চোখে স্মার্ট এক আর্মি অফিসারকে দেখেন পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও মা বেগম ফজিলাতুন নেছা।
দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলে জামালের চাকরিকাল ছিল প্রায় দেড় মাস। কিন্তু এই স্বল্প সময়ে অফিসার ও সৈনিকদের মাঝে তিনি অসাধারণ পেশাগত দক্ষতা ও আন্তরিকতার ছাপ রেখেছিলেন। কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা আর অহংকারহীন জীবনযাপনে সবাইকে আপন করে নিতে তার তুলনা মেলানো ছিলো প্রায় অসম্ভব। আর সেই কারণেই তিনি তার পরিচিতদের কাছে হয়ে আছেন ইতিহাসের উজ্জ্বল অংশ। কয়েক সপ্তাহেই জামাল অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে তাঁদেরই একজন হয়ে যান। সকালে পিটির সময়ে সৈনিকদের আগে থেকে দৌড়ে সবাইকে অবাক করে দেন শেখ জামাল। ট্রেনিং গ্রাউন্ডে, রণকৌশলের ক্লাসে, অবস্টাকল ক্রসিংয়ে অংশ নিয়ে সৈনিকদের মুগ্ধ করেন। ব্যাটালিয়ন বক্সিং টিমের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেন। বিকেলে খেলার মাঠে ইউনিটের সদস্যদের সঙ্গে বাস্কেট বল খেলেন। সন্ধ্যায় কখনো সৈনিক মেসে সৈনিকদের সঙ্গে খাবার খান। এমনকি মায়ের নির্দেশে, গাড়িতে করে নয়, অন্য তরুণ অফিসারদের মতো মোটরসাইকেলে করে ক্যান্টনমেন্টে যাতায়াত করতেন। ইউনিটের অফিসাররা বিস্মিত হন নবাগত কনিষ্ঠতম অফিসারের সাবলীল রেজিমেন্টাল কর্মকাণ্ডে। মনে হতো সেনাবাহিনীই যেন তাঁর নিয়তি। তিনি হতে পারতেন একজন তরুণ রেজিমেন্টাল অফিসারের মূর্ত প্রতীক। পরিবারের মতামতে সেনাবাহিনীর অনুমোদন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন খাদিজা হোসেন ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ হোসেনের মেয়ে পারভীন রোজীর সাথে শেখ জামালের বিবাহ হয় ১৯৭৫ সালের ১৭ জুলাই।
১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট ব্যাটালিয়ন ডিউটি অফিসার হিসেবে ক্যান্টনমেন্টে নিজ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। একজন সুবেদার বলেন, ‘স্যার, অনেক রাত হয়েছে; আজ রাতে ইউনিটেই থেকে যান।’ কিন্তু রাতে আর সেনানিবাসে থাকা হয় না শেখ জামালের। তিনি ফিরে আসেন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল ও বিপথগামী সৈনিক। এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিনষ্ট করে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিদেশি মদদপুষ্ট হয়েই এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। ১৫ আগস্ট ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে তিনি ঘুমাচ্ছিলেন। বাড়ির সহকারী আবদুর রহমান বলেন, তিনি ঘুমন্ত শেখ জামালকে ডেকে ঘুম থেকে উঠান। শেখ জামাল তখন প্যান্ট–শার্ট পরে তাড়াতাড়ি বঙ্গমাতার কক্ষে প্রবেশ করেন। সঙ্গে যান তার স্ত্রী রোজী জামাল। অতপর তাঁরা বাথরুমে আশ্রয় নেন। এতেও তাঁরা বাঁচতে পারেননি। মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন শেখ জামাল এবং তার স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করেন। এই নির্দয় নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে চিরতরে নিভে যায় শেখ জামালসহ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূরো পরিবারের জীবন প্রদীপ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ জামালকে হত্যার বিষয়টি পৃথকভাবে স্থান পায় বিশ্ব মিডিয়ায়। কেননা তার কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো স্যান্ডহার্স্ট একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য যাওয়া প্রশিক্ষণার্থীদের একজন ছিলেন শেখ জামাল। সেনাবাহিনীর সদস্য হয়ে সেনাবাহিনীরই একটি অংশের হাতে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হয়। এই মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারকে সেনাবাহিনীর যে সদস্যরা হত্যা করেছিল, তাদের সেনা আইনে বিচার না করে সে সময়ের অবৈধ সরকার খুনিদের পুরস্কৃত করে। সেই ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার করা যাবে না বলে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে।
শহীদ শেখ জামাল শুয়ে আছেন বনানী কবরস্থানে, তাঁর পাশেই আছেন স্ত্রী রোজী জামাল। ২২ বছর বয়সী শেখ জামালের জীবনের অবসান ঘটে সেদিন; ঘটে একটি স্বপ্নের অবসান। ঘাতকের বুলেট তাদের স্মৃতিকে বিলোপ করতে পারেনি বরং মৃত্যু অমর করেছে শেখ জামালের অবদানকে। ইতিহাসের পাতায় শেখ জামালের নাম লেখা থাকবে সোনার অক্ষরে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যতদিন বেঁচে থাকবে, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামালের স্মৃতি ততদিন অক্ষয় হয়ে থাকবে।
লেখক : উপাচার্য, রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।