শহীদ তরুয়া ও ফরহাদের পরিবারে শোকের ছায়া কাটেনি

ছেলের ছবি দেখলেই কান্না করেন ফরহাদের মা ছেলে হারিয়ে দিশেহারা তরুয়ার বাবা-মা

ইমাম ইমু | শনিবার , ১৯ জুলাই, ২০২৫ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

২০২৪ সালের ৪ আগস্ট মাগুরা শহরের পারনান্দুয়ালী এলাকায় আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফরহাদ হোসেন। মৃত্যুর আগেরদিন সকালেও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আন্দোলন ও নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বলেছিলেন এ শিক্ষার্থী। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে বড় ভাইকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘চলেন ভাই, শহীদ হয়ে আসি।’ সেটিই ছিল শহীদ ফরহাদের পরিবারের সাথে শেষ কথা। ফরহাদ হোসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ফরহাদের বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। আদরের ছোট ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা ফরহাদের বাবামা। ফরহাদের মা এখনো কান্না করেন ফরহাদের জন্য। ফরহাদের ছবি দেখলেই কান্না শুরু করেন। শহীদ ফরহাদের বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া বলেন, আমরা ফরহাদের ছবি লুকিয়ে রাখি। তবু কোনোভাবে আমরা মা সেটা দেখলে কান্না শুরু করেন। প্রায় কান্না করেন তিনি। আমার মায়ের বুকে ব্যথা বেড়ে গেছে আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে। উনাকে কিছু দিন পর পর ডাক্তার দেখাতে হয়। শহীদ ফরহাদের পিতা গোলাম মোস্তফা একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনি জানান, আমার এখনো বিশ্বাস হয় না ফরহাদ নেই। প্রতি ক্ষণে মনে হয়, সে ছাত্রাবাসে না হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। যে কোনো সময় বাড়ি ফিরে আমাকে বাবা বলে ডাক দেবে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি এসব কথা বলেন। ফরহাদের সহপাঠী তৈাফিক বলেন, ফরহাদ ছিল অসাধারণ মেধাবী। সে ছিল একটু শান্ত ও চুপচাপ স্বভাবের। পরীক্ষায় সবসময় ভাল রেজাল্ট করতো। তার বাড়ি মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলায়। তবে ফরহাদের আত্মত্যাগ এবং সাহসিকতার জন্য গর্ববোধ করেন বাবা গোলাম মোস্তফা ও বড় ভাই। পরিবারের একজনকে হারানো অনেক বেশি কষ্টের হলেও ফরহাদের জন্য তারা গর্বিত। ফরহাদের মৃত্যুর জন্য তারা স্বৈরচারী সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা এবং ছাত্রদের লক্ষ্য করে টার্গেট কিলিংকে দায়ী করেন। পাশাপাশি এ হত্যার সঠিক বিচার দাবি করেন। যাতে কেউ আর এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ডের শিকার না হয়।

অপরদিকে ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শহীদ হৃদয় চন্দ্র তরুয়ার বাবামা। ছেলেকে পড়াশোনা করিয়ে ভালো জায়গায় দেখবেন এমন স্বপ্ন বুনতেন তরুয়ার মা। কিন্তু সেটি হলো না। এখন শুধু চোখের পানি ফেলছেন এ শহীদের মা। শহীদ তরুয়ার মা অর্চনা রানী বলেন, ছেলেটার স্বপ্ন ছিল সে পড়ালেখা শেষ করে চাকরি নিয়ে আমাদেরকে তার কাছে রাখবে এবং আমাদের কাজকর্ম কিছু করতে দেবে না। শুধু বলত, মা তোমরা আর তিনটা বছর একটু কষ্ট করো। এর পরই আমি তোমাদের নিয়ে ঢাকায় থাকব। ভগবান যে এভাবে আমার ছেলেটাকে নিয়ে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। প্রতিনিয়ত ছেলের কথা মনে পড়ছে। কোনোভাবেই ছেলের স্মৃতি ভুলতে পারছি না। আমাদের দুর্বিষহ জীবন কাটছে। শহীদ তরুয়ার বাবা রতন চন্দ্র তরুয়া বলেন, আমাদের একমাত্র ভরসা ছিল হৃদয়। ওকে নিয়েই ছিল আমাদের সব স্বপ্ন। কিন্তু সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। আমার সন্তানকে তো কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু সুষ্ঠু বিচার চাই। এটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া।

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাটে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা গুলি চালালে গুরুতর আহত হন হৃদয় তরুয়া। এরপর ২৩ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এ শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মারা যান। হৃদয় তরুয়া নেই। কিন্তু তার কথামালা গেঁথে আছে সহপাঠী ও বন্ধুদের অন্তরে। আন্দোলনের সময় তার প্রতিটি স্লোগান, দেশ বদলের স্বপ্ন এখনও স্মৃতিকাতর করে তুলছে তাদের। এজন্য চবিতে হৃদয় তরুয়ার স্মরণে বিভিন্ন সময় নানা আয়োজন করেছেন তার বন্ধু ও সহপাঠীরা। শহীদ তরুয়ার স্মৃতিচারণ করে তার বন্ধু আনন্দ পাল বলেন, হৃদয় খুব শান্ত ছিল, সবাইকে ক্লাসে যাওয়ার সময় ডেকে তুলত। কারও সঙ্গে কখনও ঝগড়া করত না। দুর্গাপূজায় কিংবা ঈদে আমরা একসঙ্গে থাকতাম। এখনও তার নানা স্মৃতি আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশে আবারও একদলীয় শাসনের নতুন ছক আঁকা হচ্ছে
পরবর্তী নিবন্ধআরো ১৫ ধরনের পণ্য বেসরকারি আইসিডি থেকে খালাস করা যাবে