শতবর্ষে সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থ ও বর্তমান পৃথিবী

শওকত এয়াকুব | শুক্রবার , ১৪ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালির প্রাণের কবি। তাঁর জীবন দর্শন ছিল অসামপ্রদায়িক ও ইনসাফ ভিত্তিক চেতনার চির স্বাতন্ত্রচিহ্ন। নজরুল সাম্যবাদ ও মানবতার কবি । নজরুলের সাহিত্যেও চিন্তা এসেছে তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে। তাই নজরুলের কবিতায়, গানে ও প্রবন্ধে তার সাম্যবাদী চিন্তাচেতনা অত্যন্ত জোরালোভাবে পরিস্ফুট। কাজী নজরুল তাঁর বিভিন্ন লেখায় সাম্যের কথা বলেছেন। তাঁর কাব্য ভাবনায় একটি অন্যতম হলো সাম্যবাদ।

নজরুল এমন সময় এই কাব্যগ্রন্থে কবিতাগুলো লিখেছেন যখন মানুষের মাঝে অসাম্য জেঁকে বসেছিল। তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থ ১৯২৫ সালের বিশ ডিসেম্বর (পৌষ,১৩৩২) প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ছিলেন মৌলভী শামসুদ্দীন হুসেন। বেঙ্গল পাবলিশিং হোম, ৫ নূর মহম্মদ লেন, কলিকাতা। ১৫ নং নয়ান চাঁদ (দত্ত) ষ্ট্রীট, কলিকাতা, মেটকাফ প্রেসে শ্রীমণিভূষণ মুখার্জী কর্তৃক মুদ্রিত হয়। এতে পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৩২, এবং মুদ্রিত মূল্য ছিল মাত্র দুই আনা। ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে মোট ১১টি কবিতা সঙ্কলিত হয়েছিল; কবিতাগুলো হচ্ছে– ‘সাম্যবাদী’, ‘ঈশ্বর’, ‘মানুষ’, ‘পাপ’, ‘চোরডাকাত’, ‘বারাঙ্গানা’, ‘মিথ্যাবাদী’, ‘নারী’, ‘রাজাপ্রজা’, ‘সাম্য’ ও ‘কুলিমজুর’। পরে ‘সাম্যবাদী’সহ এর চারটি কবিতা ‘সর্বহারা’ কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে সঙ্কলিত হয়। লাঙলের বিশেষ (প্রথম) সংখ্যায় ‘সর্ব্বপ্রধান সম্পাদকীয় রূপে ‘সাম্যবাদী’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়।

নজরুলের সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে অসামান্য মানবপ্রীতি, অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সাম্যবাদী চেতনা ও সর্বহারা মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। গভীর মানবপ্রীতি নজরুলকে করে তুলেছে মানবতাবাদী। মানুষে মানুষে তীব্র বৈষম্য নজরুল ব্যথাহত হৃদয়ে তাঁর সৃষ্টির নিদর্শন রেখে গেছেন। তিনি অত্যাচারিত মানুষের নীরব বেদনার সার্থক রূপকার। দরিদ্র সাধারণ মানুষের উপর ধনীর নির্মম অত্যাচার অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর বলিষ্ঠ প্রতিবাদ লেখনিতে প্রকাশ করেছেন দ্বিধাহীন চিত্তে। কৃত্রিম সমাজব্যবস্থায় মানুষে মানুষে সৃষ্টি করেছে যে ব্যবধান বজ্রকণ্ঠে তিনি বারবার প্রতিবাদ করেছেন তার অমূল্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে-“গাহি সাম্যের গান-/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধাব্যবধান/যেখানে মিশছে হিন্দুবৌদ্ধমুস্‌লিমক্রীশ্চান।/গাহি সাম্যের গান!/ কে তুমি?-পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল,ভীল,গারো?/কন্‌ফুসিয়াস্‌? চার্বআখ চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!… ।”

কুলিমজুর’ কবিতায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মানব সভ্যতার রূপকার শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের কথা বলেছেন। শ্রমজীবী মানুষের জয়গান করেছেন। যুগে যুগে শ্রমজীবী মানুষের অক্লান্ত শ্রমে গড়ে উঠেছে এই সভ্যতা। যাঁরা শ্রম দিয়ে সভ্যতা গড়েছেন, তাঁরাই আজ সমাজে অবহেলিত। যাঁরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শরীরের রক্ত পানি করে শ্রম দিয়েছেন, যাদের শ্রমের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে বর্তমান সভ্যতা। সেই শ্রমিকই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত ও উপেক্ষিত। এই শ্রমজীবীরাই সমাজে সবচেয়ে লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত। এসব মহৎ মেহনতি মানুষকে শোষণ করেই বিত্তবানেরা সুখের অট্টালিকায় বাস করে। অবজ্ঞা এবং বঞ্চনাই যেন শ্রমজীবী মানুষের একমাত্র পাওনা। সুবিধাবাদী লোকেরা শ্রমিকদের শোষণ করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে, অথচ শ্রমজীবী মানুষ তাঁদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। সমাজের অবস্থাসম্পন্ন মানুষেরা দরিদ্র শ্রমজীবীদের সর্বদা অবজ্ঞা আর অবহেলা করে আসছে। পৃথিবীর সবখানে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চলে। যুগ যুগ ধরে সমাজের গরিব তথা শ্রমিককুলিমজুরেরাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত ও উপেক্ষিত। যাদের শ্রমের ওপর ভর করে যাঁরা ধনী হয়েছেন, তাঁরাই সব সুবিধাভোগী। এই ধনি শ্রেণির লোকেরা জোঁকের মতোই রক্তচোষা। গরিবদের রক্ত চুষে এরা ফুলে ফেঁপে ওঠে। তাই কবির কন্ঠ উচ্চারিত হয়েছে মেহনতী মানুষের করুণ চিত্র…. দেখিনু সেদিন রেলে,/কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!/ চোখ ফেটে এল জল,/এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?/ যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্পশকট চলে,/বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।/ বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল…”

নারীপুরুষের যতটুকু অধিকার পাওয়ার তা নিয়েও নজরুল সোচ্চার ছিলেন । তিনি উপলব্ধি করেছেন সমাজে নারীর ভূমিকা ও অবদান পুরুষের চেয়ে কোনো আংশে কম নয়। তাই নারীকে অবহেলা করা যাবে না। পৃথিবীর সকল কাজেই নারীর অংশীদারিত্ব ছিল, রয়েছে এবং থাকবে। সমাজের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে নারীরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণ করেছেন এবং প্রেরণা যুগিয়েছেন। জীবন চলার পথেও নারীর ভূমিকা কখনো মাতা হিসেবে, কখনো কন্যা হিসেবে, কিংবা কখনো প্রেয়সী হিসেবে। এইসব গুণেই নারীরা মহিমান্বিত। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, ইনসাফ ভিত্তিক সমতার এক অনন্য স্তরে নারীকে স্থান দিয়েছে নজরুল। তাই কবির কন্ঠ উচ্চারিত হয়েছে নারীর মর্যাদাদানের কথা-“সাম্যের গান গাই/আমার চক্ষে পুরুষরমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।/বিশ্বে যাকিছু মহান্‌ সৃষ্টি চিরকল্যাণকর /অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।/বিশ্বে যাকিছু এল পাপতাপ বেদনা অশ্রুবারি /অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী। /নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়জ্ঞান? /তারে বল, আদিপাপ নারী নহে, সে যে নরশয়তান। /অথবা পাপ যে শয়তান যে নর নহে নারী নহে, /ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।/বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,/ নারী দিল তাহে রূপরসমধুগন্ধ সুনির্মল।…”

নজরুল তার সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থে যে অসাম্যের আলাপ করেছেন, তিনি যেমন পৃথিবীর আশাবাদী ছিলেন তেমন পৃথিবী এখনো হয়ে উঠেনি। বর্তমান পৃথিবীর পরিস্থিতির প্রতি আলোকপাত করলেই দেখা যাবে, যে বর্তমানে আমরা একটি অসম, অস্থির, অস্থিতিশীল এবং অমানবিক পৃথিবীতে বাস করছি। আজকে পৃথিবীর সর্বত্র অসাম্য। অসাম্য রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পাদ নিজস্বীকরণে, অসাম্য রয়েছে দেশেদেশে, জাতিতেজাতিতে, অঞ্চলেঅঞ্চলে। অসাম্য রয়েছে বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মধ্যে, ধর্মীয় সমপ্রদায়ের মাঝে, নারীপুরুষের মাঝে। এই অসাম্যের পরিবেশে মানুষেমানুষে বিভাজন বাড়ছে, মানুষের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে গেছে। ব্যক্তিপর্যায়ে, সমাজপর্যায়ে এবং রাষ্ট্রপর্যায়ে ক্ষমতার অসমতা একটি অস্থির, অস্থিতিশীল কাঠামোর জন্ম দিয়েছে। জন্ম নিয়েছে সহিংসতা ও সন্ত্রাস। সামাজিক সংহতি বিনষ্ট হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে মানবিক সহনশীলতা। এক অর্থে, এর ফলে সামাজিক অবক্ষয় ক্রমশ বাড়ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নজরুলের বিশ্বমানবতার ধারণা, সাম্যদর্শন, মানবিকতার চিন্তাচেতনা আমাদের বিশ্ব, রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমাদের মানসিকতাকে পরিবর্তন করে একটি সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা নজরুলের মানবিকতাকে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে পারি। সেই মানবতা বোধ থেকে মানব ইনসাফের পথযাত্রা শুরু হতে পারে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগল্প বলার গল্প
পরবর্তী নিবন্ধডা. মুসা খানের ইন্তেকাল