শত ফাটল, বেরিয়ে পড়েছে রড

হাসান আকবর | বৃহস্পতিবার , ২৩ নভেম্বর, ২০২৩ at ৭:০৭ পূর্বাহ্ণ

নগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে গেছে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠা ব্রিজটি আর সংস্কারের পর্যায়েও নেই। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালুর সাথে সাথে এই ব্রিজটি ভেঙে নয়া একটি ব্রিজ নির্মাণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। দেশের প্রথম ফ্লাইওভার খ্যাত দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম মহানগরীর যান চলাচলের ক্ষেত্রে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা। বিগত পাঁচ যুগের বেশি সময় ধরে ব্রিজটি নগরীর যান চলাচলের ধকল সামলে আসছে। শহরের দুইটি অংশের যোগাযোগ এবং ট্রেন চলাচল অব্যাহত রাখতে এটি নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ষাটের দশকে পাকিস্তান আমলের মাঝামাঝিতে ব্রিজটি নির্মাণকাজ শুরু হয়। দ্য ইঞ্জিনিয়ার্স নামের একটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ব্রিজটি নির্মাণ করে। নির্মাণকালীন কিছু ত্রুটির জন্য স্বাধীনতার পরে এটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের দিকে এসে ব্রিজটিতে বড় ধরনের সংস্কার কাজ পরিচালনার পর সেটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

বর্তমানে ব্রিজটির উপর দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি চলাচল করে। শহরের প্রধান সড়কের এই ওভারব্রিজে ওজন নিয়ন্ত্রণের কোনো নিয়ম না থাকায় কন্টেনারমুভারসহ ওভারলোড শত শত গাড়ি ব্রিজটির উপর দিয়ে চলাচল করে। ষাটের দশকে ব্রিজটি যখন নির্মাণ করা হয়েছিল তখন এই ধরনের ওজনের কথা কল্পনাও করা যায়নি বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন। তারা বলেন, ভারী যানবাহনের অবাধ চলাচল ব্রিজটিকে আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

৬০ বছরেরও বেশি পুরানো ব্রিজটির স্ট্রাকচারাল আয়ুষ্কাল হারিয়ে গেছে বলে মন্তব্য করে একাধিক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, জোড়াতালি দিয়ে ব্রিজটিকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। তবে এর মূল কাঠামো যেমন পিলার, গার্ডার এবং ক্রস গার্ডারে কোন সংস্কার বা জোড়াতালির সুযোগ নেই। এজন্য এতে শত শত ফাটল দেখা দিয়েছে। ব্রিজে ব্যবহৃত সেকালের রডগুলোর অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রডগুলো ভিতরে ফুলে গেছে, মরিচা ধরেছে। এগুলোর উপর আর ভরসা করার অবস্থা নেই। তারা দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ যেকোনো সময় বড় ধরনের একটি বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন।

ব্রিজ নির্মাণে অভিজ্ঞ সড়ক ও জনপথ বিভাগের একজন দায়িত্বশীল প্রকৌশলী গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে জানান, ব্রিজটি শুধু যানবাহনের অস্বাভাবিক ওজনের ধকলই সামলাচ্ছে না, এর নিজের ওজনও অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এটির ‘ডেথ ওয়েট’ অনেক বেড়ে গেছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এজন্যই ব্রিজটির বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে।

তিনি বলেন, পুরনো ব্রিজ সংস্কারের প্রচলিত এবং স্বীকৃত নিয়ম হচ্ছে রিসাইক্লিং কার্পেটিং। ব্রিজের ওজন যাতে বেড়ে না যায় সেজন্য এই রিসাইক্লিং কার্পেটিং করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ব্রিজের উপরের রাস্তা কার্পেটিং করার সময় আগেকার কার্পেটিং পুরোপুরি তুলে নেয়া হয়। ওই খাদের মধ্যেই নতুন করে কার্পেটিং করা হয়। এতে ব্রিজ সংস্কার হয়, কিন্তু ওজন বাড়ে না। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ব্রিজটির সংস্কারে এই নিয়ম অনুসরণ করেনি। প্রায় প্রতিবছরই ব্রিজটি কার্পেটিং করা হয়। যাতে ব্রিজের বিদ্যমান কার্পেটিং এর উপর নতুন করে ঢালাই দেয়া হয়। এতে করে ব্রিজটির উপর অন্তত দুই ফুট উচু আস্তর তৈরি হয়েছে। যা ব্রিজের নিজের ওজন কয়েক হাজার টন বাড়িয়ে দিয়েছে। এই ওজন বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটি আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে যাওয়া ব্রিজটির জন্য কাল হয়ে উঠেছে বলেও ওই প্রকৌশলী মন্তব্য করেছেন।

গতকাল সরজমিনে ব্রিজের নিচে গিয়ে শত শত ফাটল দেখা গেছে। বিশেষ করে পিলার, গার্ডার, ক্রসগার্ডারে বিপুল সংখ্যক ফাটলের পাশাপাশি মরিচা ধরা প্রচুর রড বেরিয়ে থাকতে দেখা গেছে। উপর দিয়ে গাড়ি চলার সময় ব্রিজের নিচে মারাত্মক রকমের কাঁপুনিও টের পাওয়া গেছে। সবকিছু মিলে ব্রিজটির অবস্থা মোটেও ভালো নয় বলেও স্থানীয়রা মন্তব্য করেছেন।

চট্টগ্রামের স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, রাজশাহী প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের স্ট্রাকচারাল আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে গেছে। এটিকে আর সংস্কার করার পর্যায়ে নেই। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই ব্রিজটি রিমুভ করে যত তাড়াতাড়ি একটি নতুন ব্রিজ নির্মাণ করা হবে ততই মঙ্গল হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এটির রডে মরিচা ধরে গেছে। রড ফুলে গেছে। এটির স্ট্রাকচারাল ডিজাইন লাইফ ফুরিয়ে গেছে। তাই শত শত ফাটল তৈরি হয়েছে। ব্রিজটি ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে চালু হয়ে যাচ্ছে। এটি চালু হলে কিছু পরিকল্পনা নিয়ে বিদ্যমান দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের উপর যান চলাচলের চাপ বহুলাংশে কমানো যাবে। তাই এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দ্রুত ব্রিজটি ভেঙে নতুন একটি ব্রিজ করার উদ্যোগ নেয়া দরকার। এই ব্রিজের আর কোনো ভবিষ্যত নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

অপরদিকে বিদ্যমান দেওয়ানহাট ওভারব্রিজে উচ্চতা নিয়েও বড় ধরনের সংকটে পড়বে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ব্রিজটি ভূমি থেকে পাঁচ মিটারের মতো উঁচু। অথচ রেলওয়ে নিয়মানুযায়ী বর্তমানে ব্রিজের উচ্চতা ৮.৫ মিটার রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিদ্যমান ব্রিজ বহাল রেখে দোতলা ট্রেন চালুর যে স্বপ্ন রেলওয়ে দেখছে তা বাস্তবায়ন কোনোদিনই সম্ভব হবে না। তাছাড়া ব্রিজটি ট্রান্স এশিয়ান রেল যোগাযোগ প্রকল্পেরও অন্তরায় হয়ে উঠবে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।

ব্রিজটির পুরোপুরি দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের। সিটি কর্পোরেশনই এটির রক্ষণাবেক্ষণ করে। ব্রিজটির বেহাল দশা নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবু ছিদ্দিক দৈনিক আজাদীকে বলেন, দেওয়ানহাট ব্রিজ সংস্কার বা এ সংক্রান্তে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ব্রিজটির অবস্থা খারাপ বলে স্বীকার করে তিনি বলেন, সংস্কারের বিষয়ে আমরা মেয়র মহদোয়কে জানাব। তিনি যে সিদ্ধান্ত দিবেন সে আলোকে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে বলেও ইঞ্জিনিয়ার আবু ছিদ্দিক উল্লেখ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধউপজেলা চেয়ারম্যানের পদ ছাড়লেন মোতাহের ও মোতালেব
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজার রুটে ট্রেনের টিকিট বিক্রি আজ শুরু