সাতকানিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলার সীমানা বরাবর বয়ে চলেছে খরস্রোতা শঙ্খ। উৎপত্তিস্থল মিয়ানমারের মদক পাহাড় থেকে এটি বান্দরবান, চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া উপজেলার সীমান্ত দিয়ে বাঁশখালী হয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। শুকনো মৌসুমে শঙ্খে পানি কম থাকলেও বর্ষায় থাকে যেন তার পূর্ণ যৌবন। পাহাড়ি ঢলের পানি তীব্র গতিতে প্রবাহিত হওয়ায় বর্ষায় আগ্রাসী রূপ ধারণ করে শঙ্খ। এসময় দু’কূলে ভাঙনও শুরু হয় ভয়াবহ। শত শত বসতবাড়ি, গাছপালা, রাস্তাঘাট, বিস্তীর্ণ ফসলী জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শঙ্খের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। যুগ যুগ ধরে চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী পৌরসভার চাগাচর, ধোপাছড়ি, বৈলতলী, বরমা এবং সাতকানিয়া উপজেলার কালিয়াইশ, বাজালিয়া, ধর্মপুর, খাগরিয়া, আমিলাইশসহ বিস্তীর্ণ এলাকা বিলীন হয়েছে। ফলে নদী ভাঙনের মতো দুর্যোগকে সঙ্গী করে সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যেও জীবনধারণ করছে শঙ্খ তীরবর্তী এসব অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষ। অথচ স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘ এই সময়ে চন্দনাইশ সাতকানিয়ার দুঃখ শঙ্খের ভাঙনরোধে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। বিগত গত ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী চট্টগ্রাম- ১৪ চন্দনাইশ-সাতকানিয়া (আংশিক) আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শঙ্খের ভাঙন প্রতিরোধে প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেন। তা পর্যায়ক্রমে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে চন্দনাইশের দোহাজারী চাগাচর, ধোপাছড়ি ও সাতকানিয়ার কালিয়াইশ, ধর্মপুর অংশে কয়েক কিলোমিটার এলাকা আরসিসি ব্লক দিয়ে টেকসই প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করা হয়। ফলে বিগত কয়েক বছর ধরে এসব অঞ্চলের মানুষ ভাঙন থেকে রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু ২/৩ বছর না যেতেই এ অঞ্চলের মানুষ তাদের ভিটে বাড়ি রক্ষায় আবারো পড়েছে চরম অনিশ্চয়তায়। কারণ দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন স্থানীয় কতিপয় অসাধু ব্যক্তির সাথে আঁতাত করে বিআইডব্লিউটিএ এর অত্যাধুনিক মেগা ড্রেজার মেশিনের সাহায্যে ড্রেজিংয়ের নামে সাতকানিয়ার কাটগড়-কালিয়াইশ অংশের বিপজ্জনক স্থান থেকে নির্বিচারে বালি উত্তোলন শুরু করছে। এছাড়াও আশেপাশে আরো বেশ কয়েকটি ড্রেজার মেশিন দিয়ে নিয়মিত তোলা হচ্ছে বালি। অথচ বিআইডব্লিউটিএ’র একটি পত্রে শঙ্খের কিছু কিছু অংশে ড্রেজিংয়ের কথা থাকলেও সেখানে ড্রেজিং না করে বিপজ্জনক স্থান থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে অপরিকল্পিতভাবে বালি উত্তোলনের ফলে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রতিরক্ষা বাঁধের ভিত্তিও দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে।
এব্যাপারে সাতকানিয়ার কাটগড়-কালিয়াইশ গ্রামের প্রাচীনতম সংগঠন নবকল্লোল যুব সংঘের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী শঙ্খের গতি ও প্রকৃতি অনুযায়ী বিশদ পরিকল্পনা না করে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু স্থানে ড্রেজিং করা হলে নদীর মরফোলজিক্যাল পরিবর্তন হয়ে ভাঙনের পরিমাণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে বাপাউবো কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন দোহাজারী ব্রিজ হতে বাঁশখালীর তৈলারদ্বীপ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে মোট ২১.৮৩ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং ছাড়া শঙ্খের অববাহিকার ডিটেইলড ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি ব্যতিত বিচ্ছিন্ন ও অপরিকল্পিতভাবে বালি উত্তোলন করা সমীচীন হবে না। অথচ সাতকানিয়ার কাটগড়-কালিয়াইশ গ্রাম সেই ২১.৮৩ কিলোমিটারের মধ্যেও অর্ন্তভুক্ত নয়। তিনি বলেন, কোনো ধরনের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি ব্যতিত অপরিকল্পিতভাবে বালি উত্তোলন করে ভাঙন কবলিত কাটগড়-কালিয়াইশের বাসিন্দাদের আবারো ভিটেমাটি ভাঙনের মুখে ফেলে বাস্তুহারা করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। যেভাবে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে তাতে শঙ্খের বিস্তীর্ণ চরও ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এতে এ চরে সবজি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করা হাজার হাজার কৃষক পরিবারকেও পথে বসতে হবে। তাছাড়া শঙ্খের তলদেশ থেকে বালু উত্তোলনে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডেরও কোনো অনুমোদন নেই। তিনি আরো বলেন, এ ব্যাপারে সংঘের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ দেয়ার পর জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে গত ৮ মার্চ বালু উত্তোলন বন্ধ করতে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর পত্র প্রেরণ করা হলেও এ পর্যন্ত কোনো ধরনের অভিযান চালানো হয়নি। অথচ যে স্থান থেকে বিআইডব্লিউটিএ এর ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে, সে স্থান থেকে পূর্বে বালি উত্তোলন করার কারণে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে উপজেলা প্রশাসন বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে বালু উত্তোলন বন্ধ করেছিল। এছাড়া বিআইডব্লিউটিএ এর ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালি উত্তোলনের আপত্তি জানিয়ে গত ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকেও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক বরাবরে পত্র প্রেরণ করা হয়।
বিআইডব্লিউটিএ এর সহকারী প্রকৌশলী রেজাউর রশিদ খন্দকার জানান, নৌ-পথ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সাতকানিয়ার কাটগড়-কালিয়াইশ অংশে নদী ড্রেজিং করা হচ্ছে। অথচ এ নদীতে কোনোদিন চলতে দেখা যায়নি বড় লঞ্চ কিংবা ইঞ্চিন চালিত নৌকা। তাছাড়া বিআইডব্লিউটিএ এর একটি পত্রে শঙ্খের কাটগড়-কালিয়াইশ এ অংশে ড্রেজিংয়ের কথা বলা হয়নি। এব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, লোকাল এমপি, জেলা প্রশাসকসহ সকলেই অবগত আছেন।
কাটগড়-কালিয়াইশ অংশের শঙ্খচরের কৃষক মো. মোস্তফাজামান, মোজাম্মেল হক, আবুল কাশেম, মো. হাসান, আবুল মনসুর, আহমদ নবী, নুরুল ইসলাম, জহুর আহমদ, ওয়াচ্ছুন্নবীসহ বেশ কয়েকজন জানান, ভারী ড্রেজার মেশিন দিয়ে নদীর তলদেশ থেকে বালি উত্তোলনের কারণে নতুন করে আমাদের ঘরবাড়ি হারাবার আশংকা জেগেছে। নদীর তলদেশ থেকে যেভাবে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে তাতে আমাদের চাষাবাদকৃত বিস্তীর্ণ জমিও নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। ইতিমধ্যে ফলসি জমির কিছু কিছু অংশ ভাঙতে শুরু করেছে। স্থানীয় কৃষকরা ড্রেজিংয়ের নামে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ বলেন, বালি উত্তোলন বিষয়ে আমরা বিআইডব্লিউটিএ এর সাথে আন্তঃমন্ত্রণালয় মিটিং করেছি। যেহেতু এ ব্যাপারে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি, সেহেতু ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়া অন্য আরেকটি প্রকল্পের সহযোগিতায় বালি উত্তোলন করা কতটুকু যুক্তিসংগত তা আমরা ডিসি অফিসসহ সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগে চিঠি প্রেরণ করে জানিয়েছি।