লেবাননে সর্বাত্মক যুদ্ধের শঙ্কা : অস্থির বিশ্ব

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ৪ অক্টোবর, ২০২৪ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

বর্বর ইসরায়েলি বাহিনী আবারও রক্ত ঝরাতে শুরু করেছে লেবাননে। যুদ্ধবাজ, রক্তপিপাসু নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার প্রতিহিংসার বিস্তার ঘটিয়েছে লেবাননের অভ্যন্তরে। প্রথমে বিশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমে পেজার নামক ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ভেতর বিষ্ফোরক দ্রব্য রেখে তা স্বয়ংক্রিয় উপায়ে বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে অনেক মানুষকে হত্যা করেছে হিটলার খ্যাত নেতানিয়াহু। পরবর্তীতে ওয়াকিটকি বিষ্ফোরণ, মধ্যপ্রাচ্যে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ কমান্ডার ইবরাহীম আকিলকে হত্যালেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে বিমান হামলা করে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৭ শতাধিক বেসমারিক নাগরিককে হত্যা করেছে বর্বর ইসরায়েলি বাহিনী। যাদের মধ্যে অধিকাংশ নারী ও শিশু। পৃথিবীর অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র বিশ্বমোড়ল খ্যাত তথা আরেক সন্ত্রাসী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে এই বর্বর ইসরায়েলি বাহিনী ইদানিং বেশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। একদিকে তারা গাজায় নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে, সাথে পশ্চিম তীরেও আগ্রাসন চালাচ্ছে আবার এদিকে যুদ্ধের নতুন মাত্রা শুরু করেছে লেবাননের অভ্যন্তরে হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করার নাম করে। অর্থাৎ ইসরায়েলি বাহিনী দু’টি দেশে তাদের যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে। এই পর্যন্ত গাজায় ৪১ হাজার মানুষকে জায়নবাদী ইহুদীরা শহীদ করেছে, লাখের উপর মানুষকে আহত করেছে। গাজা নামক উপত্যকাটিকে বিরান মরুভূমিতে পরিণত করেছে। মনে হয় যেন এক জনমানব শূন্য দ্বীপ, যেখানে জনমানুষের কোন অস্তিত্ব নেই। এর ধারাবাহিকতায় তারা লেবাননে আগ্রাসন চালাচ্ছে। গত সোমবার থেকে বিমান হামলা শুরু হয়েছে। এখন চলতি সপ্তাহে তারা স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। হয়তো এই লেখা ছাপা হওয়ার সাথে সাথে সে আশংকা সত্যি পরিণত হবে। সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা সহ বেশ কিছু রাষ্ট্র লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসনের নতুন মাত্রাকে বিশ্বের জন্য অত্যন্ত ভয়ানক হিসাবে অভিহিত করেছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ এরদোয়ান বর্বর ইহুদিবাদীদের নেতা রক্তখেকো নেতানিয়াহুকে হিটলারের সাথে তুলনা করেছেন। বরাবরই দেখা যায়মুসলিম রাষ্ট্রগুলো এভাবে বক্তৃতা, বিবৃতি ও ভাষণের মধ্যেই তাদের প্রতিবাদসমূহ সীমাবদ্ধ থাকে কিন্তু সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিতে তারা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। যদিও ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠী ও ইরাকের রেজিস্ট্যান্স গ্রুপ কয়েক দফা তেলআবিবকে লক্ষ্য করে মিসাইল ছুঁড়েছে। অধিকৃত গোলান মালভূমিতেও হামলা করেছেহাইফা বন্দরেও বোমা ফেলেছে, যদিও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যৎসামান্য। গত কয়েকদিনের আগ্রাসনে লেবাননের সাধারণ মানুষদের মাঝে ব্যাপক আতংক ছড়িয়েছে। হাজার হাজার মানুষ লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ছেড়ে নিরাপদ স্থানে সরে যাচ্ছে। এদিকে লাখখানেক বাংলাদেশির অবস্থান লেবাননের বিভিন্ন শহরে। তাদের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছে লেবাননে অবস্থিত বাংলাদেশের দুতাবাস। যদিও লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বড় কোন হামলা ঘটায়নি এখনও বর্বর ইসরায়েল। এই কয়দিনের ইসরায়েলি হামলার জবাবে সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সামরিক স্থাপনায় স্বল্প মাত্রার ফাদি১ নামক মিসাইল নিক্ষেপ করেছে, যা ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে সক্ষম। তেলআবিবে অবস্থিত মোসাদের হেড কোয়ার্টারে হামলা করেছে হিজবুল্লাহযদিও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুবই নগণ্যই বলা যায়। ৬শতাধিক লেবানিজ বেসামরিক নাগরিককে হত্যার বদলে হিজবুল্লাহর অর্জন এখনো শূন্য। যদিও ইরান অত্যাধুনিক ব্যালিস্টিক মিসাইল ও অন্যান্য সমরাস্ত্র প্রদর্শনী করে ইসরায়েলসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশকে তাদের সক্ষমতা জানান দিয়েছে। এদিকে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের পক্ষে বরাবরের মতন সাফাই গেয়ে চলেছে। তারা বারবার এই আগ্রাসনের জন্যে হিজবুল্লাহকে দায়ী করে চলেছে। এ পর্যন্ত লেবাননের ৯০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যূত হয়েছে। লেবাননে আগ্রাসন বন্ধে ২১ দিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশটির পশ্চিমা ও আরব মিত্ররা। তবে এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে বর্বর ইসরায়েল। বিশ্ব নেতারা জাতিসংঘ অধিবেশনে লেবাননকে আরেকটি গাজা বানানোর বিরোধিতা করে ভাষণ দিয়েছেন কিন্তু ‘চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী’। পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ইসরায়েল এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, এই বাণীগুলো যেন যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুর কর্ণকূহরে প্রবেশ করছে না। ২০০৬ সালে লেবাননইসরায়েল যুদ্ধে চরমভাবে পরাজিত হয়েছিল বর্বর ইসরায়েল। সেই পরাজয়ের গ্লানি যেন এখনো বর্বর ইহুদিরা মুছতে পারেনি। স্থল অভিযানে চরমভাবে পর্যদসু্ত হয়েছে বর্বর ইসরায়েল তখন। পরবর্তীতে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সেই যুদ্ধ থেকে তড়িঘড়ি করে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে ইসরায়েল। দীর্ঘ আঠারো বছর পর সেই হিজবুল্লাহ এখন শতগুণ শক্তিশালী হয়েও অপ্রতিরোধ্য রণকৌশল দেখাতে পারেনি এখনও। ইসরায়েলের উন্নতমানের প্রযুক্তির কাছে এক ধরনের অসহায় ভাব দেখা দিচ্ছে হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের মাঝে। যদিও হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ হিজবুল্লাহর আসল চেহারা এখনো দেখায়নি বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের যোদ্ধা রয়েছে ১ লক্ষ, মিসাইল সমরাস্ত্র রয়েছে দেড় লাখের মতনযার যৎসামান্য এখনও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। এখন স্থল অভিযানের দিকে চেয়ে রয়েছে পুরো বিশ্ব। যদি স্থল অভিযান শুরু হয়ে যায় তাহলে আঁকা বাঁকা পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত সুড়ঙ্গগুলো থেকে ভিন্ন মাত্রার কৌশলে হয়তো আক্রমণ চালাতে পারে হিজবুল্লাহ। এদিকে লেবাননের গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে এখন পর্যন্ত ২২ হাজারের বেশি মানুষ সীমান্ত পার হয়ে সিরিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে। বর্বর ইহুদি নেতা নেতানিয়াহু বিশ্ব নেতাদের পক্ষ থেকে দেওয়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখান করে আরও সর্বশক্তি দিয়ে লেবাননে হামলার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনীকে। ইসরায়েল সহজেই যুদ্ধ বিমান দিয়ে হিজবুল্লাহর শতশত সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করে দিতে পারে মুহূর্তেই। এমনকি বৈরুত বিমানবন্দরেও যদি বোমা ফেলা হয় তাহলে এক ভয়ংকর নারকীয় অবস্থার সম্মুখীন হবে লেবানিজ সরকার। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী যদিও বলেছেএই যুদ্ধ লেবাননের সাধারণ মানুষদের বিরুদ্ধে নয়, এটি হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে কিন্তু দিন শেষে দেখা যায় লেবাননের বেসামরিক নাগরিকরাই বেশি হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে। ইসরায়েল সরকার লেবাননকে আরেকটি গাজা বানানোর পাঁয়তারা করছেতা এখন স্পষ্ট প্রতীয়মান বলে ধরে নিয়েছেন বিশ্লেষকরা। ইসলামের পুণ্যভূমিখ্যাত ফিলিস্তিনে রয়েছে মুসলমানদের প্রথম কাবা ‘মসজিদুল আকসা’ যে মসজিদের কথা আল্লাহর কোরআনে উল্লেখ রয়েছে, ‘মহিমান্বিত (আল্লাহতায়ালা), যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের বেলায় মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে গেলেন, যার পারিপার্শ্বিকতাকে আমি বরকতপূর্ণ করে রেখেছিলাম, আমি যেন তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি; অবশ্যই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বস্রষ্টা’সূরাবনি ইসরাঈল১। আর এই মসজিদকে দিনের পর দিন চরমভাবে অপমান করে চলছে বর্বর ইসরায়েলি সেনারা। কোন পবিত্রতার তোয়াক্কা না করে এই পবিত্র মসজিদে ঢুকে পড়ছে জুতা পায়ে। যে মসজিদে মে’রাজে যাওয়ার প্রাক্কালে আমার রাসূল (সাঃ) সোয়া লক্ষ পয়গম্বরের উপস্থিতিতে নামাজে ইমামতি করেছিলেন। যে পবিত্র ভূমিতে অসংখ্য নবী রাসূলের জন্ম হয়েছেন। আর এই পবিত্র ভূমিতে বর্বর ইসরায়েলি বাহিনী কয়েক দশক ধরে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। ফিলিস্তিনের সাধারণ নাগরিকদেরকে বছরের পর বছর নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞ চালিয়েও তারা ক্ষান্ত হয়নি। পরবর্তীতে প্রতিরোধ সংগঠন হামাস সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলে ৭ অক্টোবর ২০২৩। ১২০০ ইসরায়েলিকে জাহান্নামে পাঠিয়ে তাদের জেহাদ শুরু করল আর এর জবাবে ইসরায়েল বাহিনী অর্ধ লক্ষাধিক সাধারণ ফিলিস্তিন নাগরিকদেরকে শহীদ করেছে। তাহলে ১৪০০ বছর আগে সেই আল্লাহর কালাম হুবহু মিলে যাচ্ছে। ‘ইহুদি খ্রিস্টানরা কখনও তোমার উপর খুশি হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের দলের অনুসরণ করতে শুরু করবে, তুমি তাদের বল, আল্লাহতায়ালার হেদায়াতই হচ্ছে একমাত্র হেদায়াত’সূরাবাকারা১২০। অন্য আরেকটি আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘ হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা ইহুদি খ্রিস্টানদের নিজেদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ কর না। এরা নিজেরা একে অপরের বন্ধু; তোমাদের মধ্যে কেউ যদি এদের কাউকে বন্ধু বানিয়ে নেয় তাহলে সে অবশ্যই তাদের দলভুক্ত হয়ে যাবে; আর আল্লাহতায়ালা কখনও জালেম সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না’সূরামায়েদা ৫১। অতএব ইহুদি খ্রিস্টানদের ব্যাপারে আল কোরআনের স্পষ্ট ঘোষণাতাদেরকে কখনও আপন হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না। তাদের বিরুদ্ধে শেষ রক্ত বিন্দু থাকা পর্যন্ত সামরিক শক্তি প্রয়োগ করা ফরজ ইবাদতের মতই ফরজ। আর এখনও বিশ্ব মুসলিম মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে লেবাননগাজার অসংখ্য মুসলিমের রক্তস্নাত দৃশ্য। কবে হুঁশ হবে এই বাকশক্তিহীন, জন্তু জানোয়ারের মতই নিকৃষ্ট মুসলিম বিশ্ব নেতাদের?

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),

রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রাথমিক শিক্ষা : ভাষা শিক্ষাদানে পঠন-দক্ষতা বৃদ্ধির কৌশল