কবি ফাউজুল কবির নগরীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আমি অন্যের সমালোচনার জন্যে একটি শব্দও ব্যয় করবো না। যদি আমি সুনাম করতে না পারি, তাহলে কোনো কথাই বলবো না। ফেসবুক একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এটি একটি লেখার কাগজ। এটিকে অপচয় করবেন না। ভালো লিখতে না পারেন, খারাপ কিছু লিখে সেই পাতাটিকে নষ্ট করবেন না।’ সাম্প্রতিক নেতিবাচক কিছু মন্তব্য তুলে ধরে তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করেন। আমি তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেই বলবো, সৃজনশীলতার চর্চা যাঁরা করেন, তাঁদের প্রয়োজন প্রেরণা। বিরূপ সমালোচনা সংশ্লিষ্ট লেখক বা শিল্পীকে আহত করে। তাঁরা যদি কোথাও আঘাতপ্রাপ্ত হন, কিংবা অবহেলার শিকার হন, তাহলে তাঁদের সৃষ্টিশীলতাও এখানে থমকে দাঁড়ায়। লেখালেখি এমন এক সৃজন–প্রক্রিয়া, যার স্রষ্টা লেখক নিজে। এটা এমন এক আশ্চর্য জগত, যেখানে শিল্পের সাধনা প্রবলভাবে ব্যক্তিনির্ভর। ব্যক্তি নির্ধারণ করবেন তাঁর পরিসর। ব্যক্তি নির্মাণ করবেন সেই পরিসরের ভুবন।
জগদীশ গুপ্ত লিখেছিলেন, ‘মানুষের প্রেমের ট্র্যাজেডি মৃত্যুতে নয়, বিরহে নয়, অবসাদে আর ক্ষুদ্রতার পরিচয়ে, আর উদাসীনতায়।’ জগদীশ গুপ্ত ছিলেন ভারত উপমহাদেশের অন্যতম বাঙালি ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্পকার। ‘গভীর জীবনবোধ, সুঠাম কাহিনিবিন্যাস ও চরিত্রচিত্রণের নৈপুণ্যে তার ছোটগল্প সমৃদ্ধ হয়েছে’। ইমতিয়ার শামীমের এক লেখায় পাই, বাজারে যাওয়ার ভয়ে জগদীশ গুপ্ত নাকি সাতসকালেই লিখতে বসে যেতেন। স্ত্রী এসে দেখতেন, গভীর মনোযোগের সঙ্গে স্বামী লেখালেখি করছেন। তা দেখে স্ত্রীর খুব গর্ব হতো, কী বিদ্বান তাঁর স্বামী– ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই ফের লেখা নিয়ে বসেছেন! স্বামীকে বিরক্ত না করে আস্তে নীরবে সরে যেতেন তিনি। অন্য কাউকে দিয়ে বাজার করিয়ে নিতেন। অথবা বাজারই হতো না সেদিন। বাজার করার অস্বস্তিই শুধু নয়, প্রধানত টাকা–পয়সার অভাবই জগদীশ গুপ্তকে বাধ্য করতো দিনের শুরুতেই কাগজকলম নিয়ে বসতে। আর তাঁর সে চেষ্টা বাধাহীনও হতো স্ত্রীর সুবাদে। কিন্তু সব লেখকের ও–রকম স্ত্রীভাগ্য নেই– অনেককে বরং সকালে উঠেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে হয় বাজারের দিকে। লেখকের জন্য তাই দরকার প্রেরণাদানকারী মানুষ। যিনি প্রতিনিয়ত উস্কে দেবেন, প্রাণিত করবেন।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের প্রেরণার মানুষ ছিলেন তাঁর এক শিক্ষক। এক স্মৃতিচারণে সেলিনা হোসেন বলেছিলেন, ‘আমি যখন ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন আমার শিক্ষক প্রয়াত আবদুল হাফিজ আমাকে আমার লেখালেখির সূত্র ধরে বলেছিলেন, মেয়ে হয়েছো বলে একটি গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আটকে রেখো না, দুই চোখ ভরে তোমাকে বিশ্ব দেখতে হবে। তোমাকে মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। সাহিত্যের জন্য মানুষকে চেনা খুবই জরুরি প্রসঙ্গ। সাধারণ মানুষের জীবন দেখা আরো জরুরি। শিল্পের জন্য শিল্প–এই ভাবনা যেন তোমাকে আচ্ছন্ন করে না রাখে। আমি আমার শিক্ষকের এই পরামর্শটুকু মেনেছিলাম। আমার সাহিত্য জীবনের ৫৫ বছর ধরে আমি এই পরামর্শ অনবরত বিভিন্ন সূত্রে খুঁজে বেড়িয়েছি। আমার শিক্ষকের এই পরামর্শ তরুণ লেখকদের জন্য নয়, আমি বলতে চাই এই পরামর্শ কেউ যদি মানে, তাহলে বৃহত্তর জগৎ তার সামনে উঠে আসবে।… আমার শিক্ষক বলেছিলেন দুই চোখ ভরে বিশ্ব দেখতে। তাঁর পরামর্শে আমি আমার বিশ্ব দেখতে শিখেছি। কিন্তু দেখাটা আমার নিজের।’
সেলিনা হোসেনের মতে, সাহিত্য লেখকের মানস জগতের খুঁটিনাটি অন্তর্জাল। তার জন্য দরকার সৃজনশীলতার, পাশাপাশি দরকার অভিজ্ঞতার সঞ্চয়। অভিজ্ঞতা লেখকের মাত্রার বিস্তার ঘটায়। অভিজ্ঞতা কাহিনিকে গতি দেয়। অভিজ্ঞতা লেখকের সহায়ক শক্তি।
লেখালেখি, বই প্রকাশ, বিপণন ও তার বিস্তার নিয়ে নানাজন নানা অভিমত প্রকাশ করেছেন। বই যেহেতু বিশেষ পণ্য এবং যেহেতু তার বিশেষ ভোক্তা আছে, তাই তার প্রচারণাতেও আছে নানা কৌশল। এই বিশেষ প্রচারণা ও বিপণন–প্রক্রিয়ায় প্রধানত যাঁর দায়িত্ব এসে পড়ে, তিনি হলেন প্রকাশক। যদিও এ দায়িত্ব ইদানীং পালন করেন স্বয়ং লেখকরা।
ফেসবুকে ও বিভিন্ন পত্রিকায় নিজেদের বইয়ের সংবাদ প্রচার করে তাঁরা বইয়ের প্রচার–প্রসারে ভূমিকা পালন করেন। লেখকরা লেখার কাজে যেমন আত্মনিবিষ্ঠ থাকেন, তেমনি আত্মপ্রচারণা যদি দৃষ্টিকটূ না হয়, তাহলে তা নিয়ে উদ্বেগ থাকার কথা নয়। সংযোগ বাড়ানোর মধ্যে আছে ব্যাপক পরিচিতি। এই পরিচিতি বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের লেখকের সাফল্যও প্রত্যক্ষ করি আমরা।
এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, শিল্পীরা শিল্পের সঙ্গে সম্পূর্ণ অঙ্গীকৃত। একটা অতৃপ্ত মন সবসময় তাদের তাড়া করে ফেরে। সমস্ত শিল্পের মধ্যে সাহিত্যকে আমি একটু আলাদা ভাবি। আবার সাহিত্যেরই যতগুলি মুগ্ধ শাখা আছে, তার মধ্য থেকে আমি প্রাধান্য দিই কবিতাকে। কেননা, ‘কবিতা হচ্ছে এমন জিনিস, যার মধ্যে অন্তত এক ফোঁটা আত্ম–আবিষ্কারের চিহ্ন লেগে থাকে’। আমরা চারপাশের বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারবো না, অস্বীকার করতে পারবো না বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির বর্তমান অগ্রগতির জগৎকে। কিন্তু সেগুলোকে হার মানাতে পারে একটি মাত্র বিষয়, সেটি হচ্ছে মানুষের স্বপ্ন, মানুষের কল্পনাশক্তি। সেই স্বপ্ন বা কল্পনা শক্তির ছন্দোময় প্রকাশ হচ্ছে কবিতা।
আমি সাধারণত অল্পে তুষ্ট একজন মানুষ। যা পাই, তাতে তৃপ্তি পাই, তুষ্ট হই। ক্ষুধার্ত মানুষ যেমন খাদ্য–অখাদ্যের বাছবিচার না করে যা সামনে পায় গোগ্রাসে খেয়ে ফেলে এবং তাতেই সন্তুষ্ট হয়, ঠিক তেমনি জীবনের নানা পরতে আমি যা পেয়েছি, তা–ই গ্রহণ করেছি এবং তুষ্ট থেকেছি। একমাত্র লেখালেখি ছাড়া। সাহিত্যের নানা শাখায় আমি টুকটাক বিচরণ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখনো এমন কোনো লেখা লিখতে পেরেছি বলে মনে হয় না, যাতে আমি সহজেই তুষ্ট হই, তৃপ্তি পাই। তবে আমার লেখা যখন কারো ভালো লেগেছে বলে শুনি, তখনই খুশিতে নেচে ওঠে আমার মন। নিজের ভাবনাকে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারার আনন্দই আলাদা। তাই বলি, আমার প্রেরণা হলো আমার পাঠক। তারা সবসময় আমাকে প্রাণিত করে, ভালোবাসায় আগলে রাখে। তারাই আমার শক্তি।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর : ৪২২), বাংলা একাডেমি।