লালনের গানের অসাধারণ কাব্যগুণ ও বিচিত্র শব্দসম্ভার

ইকবাল হায়দার | সোমবার , ২২ জুলাই, ২০২৪ at ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ

জগতের শোক, শ্লোক, বেদনা ও দুঃখ সন্তপ্ত চিত্ত, বাণী, ছন্দ, সময়, সূত্র, আনন্দ, রূপ, রস, গন্ধ, বর্ণ, শব্দ, স্পর্শ, আপন মনের ভাবনা, কল্পনা কে যে লেখক অনুভূতিস্নিগ্ধ, ছন্দবদ্ধ, শিল্পসংগত তনুশ্রী দান করতে পারে তাকেই আমরা কবি নামে বিশেষিত করি।

সময় বিশেষে কোন একটি সূত্রকে অবলম্বন করে কবির আনন্দ বেদনা যখন কল্পনা প্রকাশের পথ পায় তখনই কবিতার জন্ম। কবি নিজের অন্তর থেকে বচন, কথা বা শব্দ সম্ভার সংগ্রহ করে আনন্দলোক সৃষ্টি করেন আর যখন কোন অবশ্যম্ভাবী বাণী বিন্যাস, মানব মনের ভাবকল্পনা, অনুভূতি রঞ্জিত, যথাবিহিত শব্দসম্ভারে, সুসমামন্ডিত, চিত্রাত্মক ও ছন্দোময় রূপ লাভ করে তখন তার নাম কবিতা। শব্দে, সংগীতে, উপমায়, চিত্রে ও অনুভূতির নিবিড়তা থেকেই কাব্যের জন্ম তাই কোন মহৎ কবির কাব্য দৃশ্যত হয়ে ওঠে ভাব,দরদ, ছন্দ, অলংকার ও অসাধারণ কলার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে।

কবিতার বিষয়বস্তু এবং রূপকলার মিলিত সত্তা যখন আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় তখনই আমরা তাকে কালোত্তীর্ণ, রসোত্তীর্ণ ও লাবণ্যময় কাব্য বলি। কবির বেদনাবোধ এবং স্বকীয় দুঃখ সন্তপ্ত চিত্তের সাথে নিজের অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশের আনন্দ বেদনাই কবিতা।

কবি কোলরিজের মতে, অপরিহার্য শব্দের অবশ্যম্ভাবী বাণী বিন্যাস কে কবিতা বলে। Best words in the best oeder.

ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর মতে, কবিতা হচ্ছে প্রবল কল্পনা বা ভাবের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ।

মেথিউ আরনোল্ড বলেনমৌলিক কথায় কবিতা হচ্ছে জীবনের সমালোচনা, যে সমালোচনা কাব্যিক সৌন্দর্য ও সত্যের নিয়মের মধ্যে শর্তাধীনে নির্ধারিত। কড্‌ওয়েল বলেছেন, কবিতা হচ্ছে মানুষের আত্মসচেতনতার সূতিকাগার, যা একক ব্যক্তির কিছু নয় সমগ্র বিশ্বের মানুষের সাধারণ আবেগের অংশ। ওয়াট্‌স ডানটনের মতে, Absolute poetry is the concrete and artistic expressions of the human mind in emotional and rhythmic language.

মোহিতলাল মজুমদারের মতে, কাব্য লক্ষীর সঙ্গে আত্মার রতিসুখ সম্ভোগকালে রস মুচ্ছিত মানবের দিবাভাব বিধুর গদ গদ ভাবই কবিতা। এসে বলেন, A thought is not thought for us, unless it be possible to formulate in words. লেখকের কল্পনা বা অনুভূতিস্নিগ্ধ অন্তর হতে স্বতঃ উৎসারিত শব্দ থেকে কবিতার সৃষ্টি । শব্দের রসাত্মক বাণীর অবশ্যম্ভাবী বিন্যাসই কবিতা। অপরিহার্য শব্দের সংগে আবেগ ক্স ছন্দ, চিত্রগুণের সমন্বয়ে কবি কবিতাকে বাস্তব, সুষমামন্ডিত রূপ দেন। কবি নিজের অন্তর থেকে বচন কথা বা শব্দ সম্ভার সংগ্রহ করে আনন্দ লোক সৃষ্টি করেন।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, অন্তর হতে আহরি বচন / আনন্দ লোকে কবি বিরচন / গীতরসধারা করি সিঞ্চন / সংসার ধূলি জালে।

আমরা কাব্যের বিষয়, ভাব, কল্পনা, গঠন শৈলী, কাঠামো কাব্য গুণের উপরোক্ত আলোচনার আলোকে সিরাজ সাঁই রূপী লালন সাঁইজীর বাউল সাধনার চরম ও পরম লক্ষ্য ও পরমাত্মা বা ঈশ্বরের স্বরূপ উপলব্ধির প্রয়াসে তার সৃষ্ট সকল বাণীরূপ লালন গীতির কাব্য গুণ, শব্দের অপূর্ব প্রয়োগ, নান্দনিকতা, মহাভাবনা, দর্শন ও বাউল গানের মনোরম বর্ণনাভঙ্গি, শব্দ সম্ভার ও কাব্য গুণের যে আশ্চর্য ও সমৃদ্ধরপ তার কিয়ৎ পরিমাণ উপস্থাপন করব।

লালন সাঁইজীর গানের বাণী ও কাব্য গুণ বাংলার লোকসাহিত্যে, লোকসংগীতে, বাংলাদেশের অন্তরে বিরাজিত ভাব সম্পদের অজগ্রতাকেই প্রকাশনা করে।

লালনের সৃষ্ট গানে ছন্দ মাত্রা অন্ত্যমিল ঠিক রেখে যে নিখুঁত ভাব তা নিতান্তই সহজাত ও স্বভাব সুলভ।

আমরা দেখি লালনের গানের প্রতিটি চরণে কবির মেধা, মনন, শিল্পসৌন্দর্য, সুকুমার চিন্তা চেতনা, আধ্যাত্মিকতা, তত্ত্বরস ও কথার দীপ্তি ছড়িয়ে আছে।

যেমন দেহতত্ত্বের এ গানে তার চরম পাণ্ডিত্যের প্রমাণ পাই, লালন লিখেছেন, কেমন দেহভান্ড চমৎকার, ভেবে অন্ত পাবে না তার আগুন, জল, আকাশ, বাতাস আর মাটিতে গঠন তার সেই পঞ্চতত্ত্ব করে একত্র, কীর্তি করে কীর্তিকর্মার।

মেরুদণ্ড শতখন্ড তাহার উপরে হয় ব্রম্মান্ড সাত সমুদ্র চৌদ্দ ভুবন নয় নদী বয় নিরন্তর ইড়া, পিংগলা, সুষুম্মা দেখ রঙ হয় তিন প্রকার উপরে ব্রহ্মানাড়িতে ব্রম্মরন্ধ্রে রয় মূলাধার।

সপ্তদল পাতালের নীচে চতুর্দল আর কুলকুন্ডলিনী সদাই স্থির তার উপর নির্জনেতে দশমদল কমলের উপর মণিপুরের ঘর তার উর্ধ্বে দ্বাদশদলে ঊনপঞ্চাশ পবনের ঘর পান অপান সমানউদানের ব্যাস হতে গতিকার।

ষড়দলে দুলক্ষ যোজনের পরে ষোল কলা গণ্য শরীরে বিশুদাক্ষ নাম তার উর্ধ্বে মহাজ্ঞানে দিদ্বল কমলের পরে চন্দ্রবিন্দু অঙ ইন্দুরে জীবের বিন্দু ঝরে সিন্ধু হয় পাথার লালন বলে জোড়পদ্ম, নীলপদ্ম, ভেদ কর মন অতি দীপ্ত কার।

গান্ধীজীর জন্মের পঁচিশ বছর আগে ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম লালনকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেয়া হয়েছিল। তারই ধারায় আমেরিকান কবি এলেন গিন্সবার্ণ লালনের দর্শনে প্রভাবিত হয়ে তার রচনায় লালনের রচনাশৈলী অনুকরণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল লালনের প্রভাবে ও গুণ ধারায় অনেকখানি প্রভাবিত। লালনের গান একাধারে ধর্মশাস্ত্র, দর্শন, সাধন সংগীত ও অমর গীতিকবিতা ।

তার রচিত গানসমূহ বহুধা বৈশিষ্ট্যের কারণে ও কল্যাণে আজ বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই ইউনেস্কো masterpiece of the oral and intangible heritage of humanity বলে লালনের গানকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

লালনের অসামান্য সাংগীতিক গুণাবলি ও প্রতিভা সাধন সংগীত ও সামাজিক দ্রোহের পদাবলী, লালনের গানের শব্দ ও বাক্যের অর্থ তাৎপর্য, সামাজিক, ভাষাতাত্ত্বিক, সাধনতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য, কৃতঋণ শব্দের ব্যবহার বৈচিত্র্য অসাধারণ। গুঢ়গুহ্য সাধনার নির্দেশক, মরমী সাধন রহস্যের ভাব, তার জীবনযাত্রা, ধর্মসাধনা ও সংগীতত্ত্ব আমাদের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করেছে। গীতি কবিতা ও সংগীত রচনায় তার পাণ্ডিত্য বিচ্ছুরিত হয়। তার তথ্য সমৃদ্ধ ও শিল্প সফল নানা পর্যায়ের গান আমাদের বিমোহিত করে। লালনের গানের সাহিত্য মূল্য অমূল্য, ছন্দ অলংকারে অতি উন্নত। গানে, শব্দ, ব্যবহারে লালন ছিলেন তুখোড় শব্দকুশলী। তার গানে তৎসম, তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, রূপক ও তত্ত্ব প্রধান শব্দের ব্যবহার যে কোন ভাষাবিদকে আকৃষ্ট করবে। তার গানে শব্দ প্রয়োগ ও অনায়াস বয়ন কুশলতাই আমাদের মুগ্ধ করে। উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষাচিত্রকল্পে মহিমান্ডিত গান গুলির শব্দ নির্বাচন ও প্রয়োগের নৈপুণ্যতা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। যেমন ইসলামী, হিন্দু, ইংরেজী, ফারসী, চলতি ভাষার শব্দ, আধ্যাত্মিক, দেহতাত্ত্বিক, মরমী, সুফীতত্ত্ব, প্রবাদ, প্রচলন, বাগধারা ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার আমাদের মুগ্ধ করে।

ইসলাম ধর্মের শব্দাবলী যেমন,অজু, আলমিন, আদম, আরশ, আহাদ, আহাম্মদ, আলেফ, আল্লাহ্‌, আরফী, আল্লাগণি, আয়াত আরশ, কুরছি, আবদুল্লা, আউজুবিল্লাহ, আত্ত্যাহিয়াতু, আরাফাত, আমেনা, ইমাম, ইল্লিন, ইব্রাহীম, ইসা, ইঞ্জিল, ইলাহি, ইবলিশ, ইস্রাফিল, ইবাদত, ইউছুফ, ইমান, উম্মত, এখলাস, এরাফ, এক্তেদা, ওসমান গনি, কাফের, কবির, কুন, কবুল, কোরান, করিম, কোরবানি, কেয়ামত, কুল আরেফিন, কাদেরিয়া, কালুল্লাহ, খোদা, খাতুনে জান্নাত, খলিল, গন্ধম, গায়েবী,চার কোরান, ছয়খলিফা, জবুর জিয়ারত, জিবরাইল, জানাজা, জবরুত, তসবী, ত্বরীকা, তাওরাত, তরিকত, তাওহীদ, তফসীর, দাউদ, দরগাতলা, দরবেশ, দরূদ, নূহ, নিজাম, নবী, নবুয়ত, নোক্তা, নুর তাজেল্লা, নুরীতন, নাসুত, পীর, পাঁচ, পাচাতন, পুলচেরাত পারা, ফানা ফিল্লাহ, ফাতেমা, ফরজ, ফাত্তারাহু, ফাতেহা, বান্দা, বিসমিল্লাহ, বেদাত, বরজোক, বদরগাজী, বেমরিদ, মোয়াহেদ, মক্কা, মদিনা, মালেক সাঁই, মুসা, মোকাত্তায়াত, মালেকুল মউত, মাজার, মালাকুত, মিম্বর, রব্বানা, রহিম, রুকু, রওজা, রাকাত, লতিফা, লামোকাম, শরা শরীয়ত, শেরেক, শরীক,শিরনী, সেজদা, সিজ্জীন,সালাত, সিদরাতুল মুনতাহা, সালাম, হাজী, হাদিস, হারাম, হায়াত, হাওয়া, হেরা, হাসান, হোসেন ইত্যাদি।

যেমন

আলিফ লাম মিমেতে কোরান তামাম শোধ লিখেছে

আলিফ আল্লাহজী মীম মানে নবী

লামের হয় দুই মানে

এক মানে হয় শরায় প্রচার

আরেক মানে মারফতে।

বা

আলেখ সাঁই আল্লাহিজ মিশে ফানাফিল্লাহ মোরাকাবায় নাহি পায় দিশে।

মক্কা মোয়াজ্জেমা যারে বলে সে কি আহাদে আহম্মদ মেলে মোশাহেদায় কপাট প’লে থাকে গুরুর আড়ার পাশে। হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু পুরানে, যেমন অবতার, অনাদি, অহল্লা, অংকুর আক্রুর অযোধ্যা অভিমন্যু, আদ্যাশক্তি, ইন্দ্র, ইস্ট, ইন্দ্রডংকা, উর্বশী, কলিযুগ, কৃষ্ণ, কালা, কাশী, কানাই, কুফের, কৌশিক, কালাচান, কালিদহ, কালনাগ, কুব্জা, কংস, কালী, কানাইলাল, গোপাল, গয়া, গিরিধর, গোষ্ঠ, গোকুল, বিহারী, গোবিন্দ, চন্ডাল, চন্দ্রাবলী, চিকনকালা, চন্ডী, চন্ডীমন্ডপ, চন্ডীদাস, চিত্রগুপ্ত, জগন্নাথ, জগন্নাথমিশ্র, জানকী, ত্রিলোচন, তীর্থব্রত, দ্বাপর, দেব, ধন্বন্তরী, নন্দ, নন্দরাণী, নারায়ণ, নিমাই, ননীচোরা নারদ, নটবর, নন্দলালা, নন্দবালা, পীতধরা, প্যারী, পন্‌চানন, পুরন্দর, প্রহলাদ, পুজা, ব্রাহ্মণ, বৈদিক, বেদান্তর, ব্রহ্ম, বিষ্ণু, বেদ, ব্রজপুর, ব্রজধাম, ব্রহ্মান্ড, বেদী, বিরিঞ্চি, বৃন্দাবন, বিরজা, ব্রহ্মা, বনমালী, বৈদ্য, বামন, বিশাখা, বৈকুণ্ঠ, বিষ্ণুপ্রিয়া, বিশ্বম্ভর, বালাকুন্‌জ, মদন, মহাদেব, মন্দির, মুকুন্দ, মথুরা, মন্দাকিনী, মহেশ্বর, ব্রজলীলা, যোগমায়া, রাম রাই, রাধা, রোহিণী, রাইকুন্‌জ, ললিতা, লক্ষণ, শাক্তশৈব, শ্মশান, শ্যাম, শ্রীচরণ, শম্ভু, শ্যামচাদ, শ্রীমতি, শিব, শ্যামরায়, শ্যামচাদ, শূল, শূলপানি, শক্তি, শেল, সীতা, সনাতন, সুবল, সুদাম, স্বরস্বতি, সুভদ্রা, হরি, হনুমান, হরিবোল, হেমাংগ, হিরণ্যকশিপু ইত্যাদি ।

যেমন

অনাদির আদি শ্রীকৃষ্ণনিধি

তার কি আছে কবু গোষ্ঠ খেলা

ব্রহ্মরূপে সে অটলে বসে

লীলাকারী তার অংশকলা ।

পূর্ণচন্দ্র কৃষ্ণ রসিক যেজন শক্তির উদয় শক্তিতে সৃজন মহাভাবে সর্ব চিত্ত আকর্ষণ বৃহদাগমে তারে বিষ্ণু বলা গুরু কৃপাবলে কোন ভাগ্যবান দেখেছ সে রূপ পেয়ে চক্ষুদান সেরূপ নিহারি যে অজ্ঞান লালন বলে সে তো প্রেমের ভোলা।

ইংরেজী শব্দও আছে জজ, মেজিস্ট্রেট।

চলতি ভাষার শব্দ, অনা্থসে, আইল, আলিগেলি, আনাযানা, আষ্ঠেপিষ্ঠে, কৈতে, কৈলে, কয়ো,কোপনি ধ্বজা, গেরাম, থুয়ে পড়গে, পোছে, সই হবা, র্থল, মলাম ইত্যাদি।

যেমন

আপন ঘরের খবর নে না

অনা’সে দেখতে পাবি কোনখানে কার বারামখানা ।

বা

আজ আমায় কৌপিনী দে গো ভারতী গোঁসাই

কাঙাল হব মেংগে খাব রাজ রাজ্যের আর কার্য নাই।

সুফী সাধনার শব্দাবলী যেমনআঠারো মোকাম, আশেক, ইশক, এরফানি কিতাব, ফানাফিল্লাহ, ফানাফিসশেখ, ফানাফিররসুল, ফকিরি, বেনা, বাকাফানা, বিলায়েত, ভেদ, মোরাকাবা, মারিফাত মাশুক, মুর্শিদ, মুরিদ, লাহুত, সেফাত, সাধু, হকিকত ইত্যাদি।

যেমন

লাহুত নাসুত মলকুত, যবরুততার উপরে আছে সাহুত

কোরানে রয়েছে সাবুদ পড়ে কর গুরু ধ্যান

নয় দরোজা ভেরে তালা স্বরূপ রূপ যাকে বলে মোর্শেদের মেহের হলে জবরুতের পর্দা খুলে দেখায় তারে স্বরূপ বর্তমান সিরাজসাই বলেরে লালন আর কফে তোর হফে সাধন জ্ঞান। বরজোখ কর ছোড়ান।।

দেহতাত্ত্‌িবক শব্দ যেমনঅগাধ পানি, আয়না মহল, আঠারো মোকাম, আজগুবি ফুল, গরলচাঁদ, ঘাঠে মাছ ধরা, চাঁদের উদয়, চার চাঁদ, চন্দ্র সাধন, ত্রিবেণীর ঘাট, তেহাটা, ত্রিবেণী, দেহ নির্ণয়, নবীন চাঁদ, নীরাকার পুল, নীরে ক্ষীরে জ্যোতি, পাঁচ ধ্বনি, প্রবর্তক, পঞতত্ত্ব, ভূংগরতি, মনিকোটা, মন্থন, রাহুর চন্দ্র গ্রহণ, রসিকা, সাধক, সিদ্ধতত্ত্ব, ষোলজন বোম্বেটে, হাওয়ার পথ, হাওয়ার ঘর, হাওয়ার খেলা, হৃদকমল, হৃদগারদ ।

যেমন

ঘরের মধ্যে ঘর বেঁধেছেন মনমোহিনী মনোহর

ঘরের আট কুঠুরি নয় দরজা

আঠার মোকাম চৌদ্দ পোয়া

দুই খুঁটিতে পাড়া সুসারা।

ঘরের বায়ান্ন বাজার তেপান্ন গলি

কোন মাকামে কোথা চলি

ঐ বাজারে বেচা কেনা করে মনোচোরা ।।

ঘরের মটকাতে আছে নামটি তার অধরা

ফকি লালন বলে ঐ রূপ নিহারে অনুরাগী যারা ।।

ঐতিহাসিক ভৌগলিক স্থান যেমনঢাকা, দিল্লি, মক্কা, মদিনা, জগন্নাথপুর, বৃন্দাবন, নদিয়া, নবদ্বীপ, ওড়িশা, গয়া, কাশী, বালাকুন্‌জ, বানারসী, মথুরা ইত্যাদি ।

যেমন

হাতে কাছে মামলা থুয়ে কেন ঘুরে বেড়াও ভেয়ে ঢাকা শহর দিল্লি লাহোর খুঁজলে মেলে এই ঠাঁয়ে।।

গয়া কাশী মক্কা মদিনা বাইরে খুঁজে ফাঁকড়ায় পড়ো না দেহরতি খুঁজলে পাবি সকল তীর্থের ফল তাহে।

নাম বাচক বিশেষ্য পদ যেমনসিরাজ সাঁই, চৈতন্যদেব, নিত্যানন্দ দাস,অদ্বৈত আচার্য, কৃষ্ণ দাস, রামদাস, কুবীর দাস, কৃষ্ণ দাস, রাম দাস, জগাই, মাধাই, জগন্নাথ মিশ্র, মলম শাহ, জামাল খাঁ, মনসুর খাল্লাজ, বদর গাজী, বিষ্ণুপ্রিয়া, খাজা মইনুদ্দিন, রামানন্দ, রূপসনাতন, সচীমাতা প্রমুখ।

যেমন

জগাই মাধাই দস্যু ছিলতাহে প্রভুর দয়া হল

লালন পথে পড়ে রইল তোমার আশাতে।

আবার

মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো বলেছিল আমি সত্য

সই পলো শাঁইর আইন মতো শরায় কি তার মর্ম পায়।

তার গানে পাই আসবাব পত্রের অনেক নাম, যেমনআরশী, আয়না, দর্পন, কূপ, কুয়ো ।

সংগীত বিষয়ক শব্দ যেমনডংকা, যন্ত্র, যন্তর, সামা, সামগান, সারিন্দা । বাংলা ব্যাকরণের বাগধারার প্রয়োগ লালনের রচনাকে পরিপুষ্ট করেছে। যেমনবামন হয়ে চাঁদ ধরা,হাটে হাড়ি ভাঙা,বিধিবাম,কাকের স্বভাব, কলুর বলদ, ষোল কলা পূর্ণ, অনুরোধে ঢেকি গেলা ইত্যাদি।

ফারসী শব্দের ঈর্ষণীয় ব্যবহার আমাদের মুগ্ধ করে। যেমনআউলিয়া, কুদরত, কুওকার, কবুল, কেফায়া, খান্দান, খলিফা, জের, বাতুন, বেওফা, সিরকা, লাহুত ইত্যাদি।

নাম বাচক বিশেষ্য পদে আরো আছে অনেক প্রাণীর নামকাছিম, কুম্ভীর, টুনী, বলদ, কাক, গরু, চিল, জোক, টেপা, মাছ, দুম্বা,পানি খাউর, ময়ূর, পেঁচা, অলি, ভ্যাদা, রুই, ভেক, মাকড়া, মীন, রাজহংস, হস্তী ইত্যাদি ।

এ ছাড়াও হিন্দি নান্দনিক কিছু প্রতিশব্দ ব্যবহার দেখি যেমনএয়ছা, কভি, পুছি।

প্রচলিত প্রবাদ প্রবচনের ব্যবহার লালনের গান কে আকর্ষণীয় করেছে। যেমনকাক মারিতে কামান দাগা, সুইঁ চিদ্রে চালায় হাতি, পিঁড়েয় পায় পেড়োঁর খবর,হাওয়ার চিড়ে কথার দধি ফলার হচ্ছে নিরবধি ইত্যাদি ।

ব্যঞ্জনা সৃষ্টির জন্য অনুপ্রাসের ব্যবহার লক্ষণীয় ।

যেমন

গুরু তুমি তন্ত্রের তন্ত্রী

গুরু তুমি মন্ত্রের মন্ত্রী

গুরু তুমি যন্ত্রের যন্ত্রী

না বাজাও বাজবে কেনে।

লালনের গানে ব্যবহৃত ভিন্ন ভিন্ন ভনিতা ভিন্ন ভিন্ন ভাব প্রকাশ করে। যেমন অধীন লালন, অবোধ লালন, ফকির লালন, দরবেশ লালন, লালন সাঁই ইত্যাদি।

লালনের যে খ্যাতি তার পেছনে লুকিয়ে আছে এ সকল শব্দের সফল ব্যবহারে তথ্য, তত্ত্‌ব সম্বৃদ্ধ ও শিল্প সফল সৃষ্ট নানা পর্যায়ের মোহিনীকর গানে। লালন তার গানের অনেক কথাই রূপক করে প্রকাশ করেছে। এর ফলে একদিকে যেমন লালন দর্শনের সাহিত্যিক মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে অপরদিকে তেমনি এর ভাবগাম্ভীর্য ও দার্শনিক মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার রূপক, সাংকেতিক কিম্বা প্রতীকী ভাষা ব্যবহারের ফলে সর্ব সাধারণের চিন্তা চেতনার সাত থেকে লালন দর্শনের নিগূঢ় রহস্য সংরক্ষিত হয়েছে।

ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ আবদুল হাই বলেছেন, ্তুসহজ সরল বাংলা শব্দের মধ্যে কত যে রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে তাঁর গানের শব্দ প্রয়োগ ও অনায়াস বয়ন কুশলতাই সে সাক্ষ্য বহন করছে। এমন ঝকঝকে নির্ভার তদ্ভব শব্দ প্রয়োগের কারুকলা আর কোন লোক কবির গানে দখা যায় না ।

আব্দুল হাই ও আহমদ শরীফ (সম্পাদিত) মধ্য যুগের বাংলা গীতিকবিতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২৯৬১, পৃ.ঝ ‘লালন’ একটি মহানাম, একটি মহাভাবনা,এবং একটি দর্শন।এক ঈশ্বর এবং সকল মানবের অভেদ কল্পনা এটি সর্ব মানব ধর্ম দর্শনের মূলকথা। লালন এই অখন্ড মানবধর্মের মাহাত্ম্য গেয়ে সবর্দা নিজেকে জাতপাতের উর্ধে এক মানব সন্তান রূপে পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করেছে। লালন প্রদত্ত বাউল ধর্ম দর্শন সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন একটি গুরুবাদী মানব ধর্ম দর্শন । এটি একটি বস্তুবাদী ও মিশ্র দর্শন। তন্ত্র বা সহজিয়া নারীবাদ, বৈষ্ণব ভক্তি বা দ্বৈতবাদ এবং সুফি দর্শনের অদ্বৈতবাদ এ তিনটি মতাদর্শের সমন্বিত দর্শন ই লালন দর্শন নামে বিশ্বে নন্দিত ।

পরম প্রভুগুরু সূফী খাজা সদরউদ্দীন আহমদ চিশতি তার কালজয়ী কোরান দর্শনে (পৃ ৪৩৬ )উল্লেখ করেছেন ‘কোরান দর্শন’ এবং ‘লালন দর্শন’কে একই মুদ্রার এপিট ওপিট বলা যায়। কেননা আলকোরান হল সৃষ্টি

রহস্যজ্ঞাপক সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ধর্ম দর্শন এবং তা মানব জীবনের একটি উচ্চাংগীক প্রতিচ্ছবি। ‘লালন দর্শন’ ও জালালউদ্দিন

রুমীর ‘মসনবীর’ মত রূপকাচ্ছাদিত সৃষ্টিরহস্যজ্ঞাপক একটি শ্রেষ্ঠ মানব ধর্ম দর্শন যা মানবজীবনের দেহশুদ্ধি তথা আত্মমুক্তির উচ্চাংগীক একটি প্রতিচ্ছবি।

সুফী সদরউদ্দীন আহমদ বলেন,‘এই যুগের কয়েক শতাব্দীর মধ্যে বাংলার মরমী সাধক ও স্বভাব কবি লালন শাহ ই এ কাজের জন্য যোগ্য ব্যক্তি ছিলে বলে আমরা মনে করি। তাহার নিকট হইতে কোরানের ভাষ্য কেহ উদ্ধার করিতে চাহিলে তিনি হয়তো পূর্ণাঙ্গ একটি তফসীর বাঙালি জাতিকে দান করিতে পারিতেন। (সদর উদ্দীন আহমদ চিশতি, কোরান দর্শন, প্রথম খন্ড, ঢাকা, ২০০০, পৃ.৪৩৬ও দ্বিতীয় খণ্ড, সংশোধিত ও পরিমার্জিতসংস্করণ, ঢাকা, ২০০৫,পৃ.০৫।)

তথ্যপঞ্জি : . উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, বাঙলার বাউল ও বাউল গান, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, তৃতীয় সংস্করণ, কলিকাতা, ১৪০৮। ২.ইমাম আহমেদ, লালনের গান: আধ্যাত্মিকতার স্বরূপ, সদর প্রকাশনী, ঢাকা ।

.বাঙলার বাউল ফকির, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত, অক্ষর বিন্যাস,ভারবি, ১৩/১ বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রিট, কোলকাতা। ৪.লালন সমগ্র, ইমাম আহমেদ ও আব্দুল মমিন সম্পাদিত, শব্দ বিন্যাস, হেরাবন, ১১/১ বাংলা বাজার, ঢাকা। ৫.লালন অভিধান,শাহীনুর রেজা, হাওলাদার প্রকাশনী, বাংলা বাজার, ঢাকা । ৬. অন্নদাশংকর রায়, লালন ফকির ও তার গান, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, কোলকাতা ১৩৯৮। ৭.মওলানা সুফি সদরউদ্দীন আহমদ চিশতি (.) কোরান দর্শন, তৃতীয় খন্ড, রামগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর। ৮.মুহাম্মদ আব্দুল হাই ও আহমদ শরীফ সম্পাদিত মধ্য যুগের বাংলা গীতিকবিতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ১৯৬১।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগীত শিল্পী

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণ : অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন আহমদ
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল