আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল কদর। এ লাইলাতুল কদর গোটা মানবজাতির জন্যে একটি পুণ্যময় রজনী। আমাদের মাঝে এসেছে আল্লাহপাক যে একটি রাত ইবাদত বন্দেগিতে হাজার মাসের চেয়েও অধিক সাওয়াব অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সে গৌরবময় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রজনী। কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ রজনী। মহান আল্লাহ এ রজনীর গুরুত্ব বোঝানোর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা অবতীর্ণ করেছেন। পবিত্র কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন– ‘নিশ্চয় আমি কুরআনকে অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে। আর আপনি কী জানেন কদরের রাত কি? কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতাগণ ও রুহ (হজরত জিবরাইল) অবতীর্ণ হয়, প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি সেই রাত, ফজরের সূচনা পর্যন্ত।’ -(সুরা আল–কদর, আয়াত: ১–৫) একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) বনী ইসরাইলের শামউন নামক একজন আবিদ ও জাহিদের দীর্ঘকালের কঠোর সাধনা সম্পর্কে বলছিলেন। সে মহৎ ব্যক্তি এক হাজার মাস লাগাতার সিয়াম ও জিহাদে রত থাকতেন এবং সারারাত জেগে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগি ও জিক্র –আজকারে কাটিয়ে দিতেন। সাহাবায়ে কিরাম আবিদ ও জাহিদের কথা শুনে নিজেদের স্বল্প আয়ুর কথা ভেবে আফসোস করে বললেন– হায়! আমরাও যদি ঐ লোকটির মতো দীর্ঘ হায়াত পেতাম তাহলে আমরা ওই রকম ইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতাম। এ সময় মহান আল্লাহ এ সম্মানিত সুরা আল–কদর অবতীর্ণ করেন।
‘লাইল’ এবং ‘কদর’ দু’টিই আরবি শব্দ। ‘লাইল’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রাত। আর ‘কদর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে সম্মান। পূর্ণাঙ্গ অর্থ হলো সম্মানিত রাত। তবে কদর শব্দের অর্থ আরবি ভাষা বিশেজ্ঞদের মতে– মাহাত্ম্য, তাকদির, আদেশ ইত্যাদিও হতে পারে। লাইলাতুল কদরকে শবে কদরও বলা হয়। ‘শব’ শব্দটি ফার্সি। এর অর্থও রাত। ইমাম জুহরী (রহ.) বলেছেন, লাইলাতুল কদর বা মহিমান্বিত রজনী এ জন্য বলা হয় যে, মানব জীবনের জন্যে এ রাত অত্যন্ত মূল্যবান ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন। শেখ আবু বকর ওয়াররাক (রহ.) বলেছেন– এ মহান রাতে ইবাদতের কারণে এমন লোকেরও মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি পায়, ইতোপূর্বে যাদের কোনো মর্যাদা ও সম্মান ছিলো না। তাই এ রাতকে মহিমান্বিত রজনী বলা হয়। ‘কদর’ শব্দের অন্য অর্থ হচ্ছে আদেশ ও তাকদির। সৃষ্টির প্রথম দিনে প্রত্যেক মানুষের ভাগ্যে যা কিছু লিখা থাকে তা এক রমজান থেকে অপর রমজান পর্যন্ত সরবরাহের হুকুম ও দায়–দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা এ রাতেই ফেরেশতাদের দিয়ে দেন। হজরত আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (রা.)-এর এক বর্ণনা মতে, শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে আল্লাহ তায়ালা এক বছরের জন্যে বান্দার রুজি, রিজিক, হায়াত–মউত ও অন্যান্য তাকদিরি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আর শবে কদরে সে সকল সিদ্ধান্তের প্রয়োগ এবং রুজি–রিজিক প্রভৃতি সরবরাহের দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের দিয়ে থাকেন। -(তাফসিরে কুরতুবি, খণ্ড– ২০, পৃ.- ১১৫)
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেছেন, ‘হা–মিম! শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। নিশ্চয় আমি তা (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রজনীতে। নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়।’ -(সুরা আদ–দুখান, আয়াত: ১–৪) লাইলাতুল কদর হচ্ছে কুরআন নাজিল হওয়ার ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত রাত। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে ২৭ রমজানের এ রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জিবরাইল (আ.) কুরআনের বাণী নিয়ে এসেছিলেন। হজরত আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, হজরত জিবরাইল (আ.) লাইলাতুল কদরে কুরআনুল কারিমকে লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে বায়তুল ইজ্জত পর্যন্ত একত্রে নিয়ে আসেন এবং হজরত জিবরাইল (আ.) অন্য ফেরেশতাদের নিয়ে লিপিবদ্ধ করান। এরপর হজরত জিবরাইল (আ.) ২৩ বছরে কুরআনুল করিমের কিছু কিছু অংশ নিয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে হাজির হতে থাকেন। -(তাফসিরে কুরতুবি, খণ্ড– ২০, পৃ.- ১১৫)
লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব অপরিসীম। হাজার মাস ইবাদত করে যে সাওয়াব হয়, কদরের এক রাতের ইবাদত তার চেয়ে বেশি সাওয়াব হয়। লাইলাতুল কদরের এ ফজিলতপূর্ণ রাতে মুমিনদের ওপর আল্লাহর অশেষ রহমত ও নিয়ামত বর্ষিত হয় এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে মাগফিরাত ও নাজাতের পরম সুযোগ লাভ করা যায়। লাইলাতুল কদর সম্পর্কে হাদিসে এসেছে– হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, একদা রমজান আগমন করলে রাসুল (সা.) ইরশাদ করলেন– ‘তোমাদের সামনে এমন একটি মাস এসেছে। এ মাসে একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি এ রাতে ইবাদত থেকে বঞ্চিত হলো; সে যেন যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো। একমাত্র হতভাগ্য ব্যক্তিই এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে।’-(সুনানে ইব্ন মাজাহ, হাদিস নং– ১৬৪৪)
লাইলাতুল কদর অনির্দিষ্ট রাখার মধ্যেও অসংখ্য তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। যদি নির্দিষ্ট তারিখ থাকতো তাহলে সবাই একটি মাত্র রাতে ইবাদত করে নিশ্চিত মনে স্বীয় আমলের ওপর নির্ভর করে বসে থাকতো। কিন্তু প্রত্যেকটি মানুষ যাতে লাইলাতুল কদর খুঁজতে গিয়ে বেশি বেশি ইবাদত করে তাই আল্লাহ তায়ালা এই তারিখটি অনির্দিষ্ট রেখেছেন। তবে বুজুর্গানে দ্বীন গবেষণার মাধ্যমে বেজোড় রাতের মধ্যে ২৭ তারিখের রাতকে নির্ধারণ করেছেন। মোট কথা, লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য রমজানের শেষ দশকের রাতসমূহে ইবাদতে মশগুল থাকা বাঞ্চনীয়। তবে সাতাশতম রাতের ব্যাপারে বেশি বর্ণনা পাওয়া যায় এবং এ মোতাবেক উম্মতের মধ্যে আমল জারি রয়েছে। তবে হাদিসে এ রাতের কিছু বৈশিষ্ট্য এসেছে। সেই রজনীটি চন্দ্রালোকিত রজনীর মতো উজ্জ্বল, পরিস্কার, নীরব ও নাতিশীতোষ্ণ হবে। সকাল পর্যন্ত কোনো তারকা খসে পড়বে না। পরবর্তী সকালের সূর্যকিরণ পূর্ণিমার চাদের ন্যায় উষ্ণতাহীন হবে। -( মুসনাদ আহমাদ, হাদিস নং– ২২৭৬৫)
লাইলাতুল কদরের আমল সম্পর্কে আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন– আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি লাইলাতুল কদর পেয়ে থাকি তাহলে সে রাতে কী দোয়া করবো? উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি বলবে– ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফায়ফু আন্নী।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমা করা পছন্দ করেন। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন।-(সুনানুত তিরমিজি, হাদিস নং– ৩৫১৩)
আজকের রাতে কুরআন নাজিল হয়েছে। তাই এ রাতে বেশি বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করুন। কুরআন শরিফ তিলাওয়াতের সাওয়াব সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন– ‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি অক্ষর পাঠ করবে, সে ব্যক্তি এর বদলে একটি নেকী লাভ করবে। আর একটি নেকী হলো দশটি নেকীর সমান।’ -(সুনানুত তিরমিজি, হাদিস নং– ২৯১০) হাদিসের মধ্যে আরো এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন– তোমরা কুরআন পড়। কেননা, এ কুরআন কিয়ামতের দিন পাঠকারীদের জন্যে সুপারিশ করবে।-(সহিহ মুসলিম, হাদিস নং– ৮০৪) রাসুলুল্লাহ (সা.) অন্য হাদিসের মধ্যে ইরশাদ করেছেন– ‘যে ব্যক্তি কুরআনুল কারিম অধ্যয়ন করবে এবং তদানুযায়ী আমল করবে কিয়ামতের দিন তাঁর পিতা–মাতাকে এমন মুকুট পরানো হবে যার আলো দুনিয়ার সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল হবে।’ -(মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং– ২১৩৯)
আজকের এ পুণ্যময় রজনী লাইলাতুল কদর অবহেলায় না কেটে সারারাত জেগে ইবাদত–বন্দেগি করার নির্দেশ রয়েছে। আজ ২৬ রমজান সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে লাইলাতুল কদর এবং সকাল না হওয়া পর্যন্ত এ রাতের সৌন্দর্য, মাধুর্য ও মাহাত্ম্য বিরাজ করবে। আজকের এ রাতে মাগরিব, ইশা, তারাবিহ ও ফজরের নামাজ আদায় করার পাশাপাশি প্রচুর নফল নামাজ, জিক্র–আজকার, কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ পাঠ, দান–খায়রাত, আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে ক্ষমা প্রার্থনা, মৃত পিতা–মাতা, উস্তাদ, আত্মীয়–স্বজন এবং সকল মুমিন–মুমিনাত ও মুসলিম–মুসলিমাতের মাগফিরাতের জন্যে দোয়া করা উচিত। আসুন, আমরা প্রতিটি মুমিন বান্দা আজকের এ মোবারক রাত ইবাদত–বন্দেগির মাধ্যমে অতিবাহিত করি।
লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক; প্রফেসর, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।