যখন গান কি জানা ছিল না তখনও লতা মঙ্গেশকরের সুর পূজোর প্রার্থনার মতো দূর থেকে ভেসে আসতো। আর যখন বুঝতে শিখেছি তখন লতার গানে আশ্রয় খুঁজেছি। শৈশবের সনাতন ধর্মের পূজা বিশেষ করে দুর্গা পূজার স্কুলের লম্বা ছুটিটায় একটা উৎসব উৎসব ভাব থাকতো। মাইকে নিরবচ্ছিন্ন গান বেজে চলতো, ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে নাতো মন’ … ‘নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিরা’ …
উপমহাদেশের কিংবদন্তি, সুর সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর প্রয়াত হয়েছেন এই খবরটাই যেন কেউ মেনে নিতে পারছেন না। শোকে স্তব্ধ কোটি-কোটি সংগীতপ্রেমী মানুষ। ৯২ বছর বয়সে গত ৬ ফেব্রুয়ারি মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দেশ বিদেশের অনেক বরেণ্য ব্যক্তিকে কোভিড ঝড় কেড়ে নিয়েছে। এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। লতা মঙ্গেশকর সংগীত জগতে গত আট দশক জুড়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অদ্বিতীয় ছিলেন। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। তিনি উপমহাদেশের সংগীতকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর গলায় স্বয়ং ইশ্বর বসে আছেন বলে মন্তব্য করেছেন আর এক কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দে। ইশ্বর বসেছিলেন কিনা জানি না ভবিষ্যতে তাঁর এই যাদুকরী গলায় কি ছিল তা নিয়ে নিশ্চিত গবেষণা হবে এটা বিশ্বাস।
শামসাদ বেগম, নূর জাহানের ভারী গলার জনপ্রিয়তার সময় নাকি লতার কণ্ঠকে ‘বড় সরু’ মনে হয়েছিল কারো কারো। ১৯৪৯ সালে মহল সিনেমায় তাঁর গান সুপারহিট হওয়ার পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম হয়নি তাঁর। লড়েছেন দারিদ্র্যতার সাথেও। বাবা পন্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর শিল্পজগতের লোক। তিনি ধ্রুপদী সংগীত পিয়াসী ও সাধক। একাধারে সংগীত শিক্ষক, অভিনেতাও ছিলেন । তিনি সন্তানদের সংগীতের তালিম দিতেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে লতা পিতৃহারা হন। ঐ এতটুকু বয়সে মা-সহ চার ভাইবোনের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। আজীবন তিনি তাঁর পরিবারের পাশেই ছিলেন। সংগীতের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা, প্রেম, একনিষ্ঠতা, একাগ্রতা। বাবা ছাড়াও তিনি তালিম নিয়েছেন উস্তাদ আমানত খান এবং আমানত আলীর কাছে। তিনি কে এল সায়গলের অনুরাগী ভক্ত। তাঁর জীবনের প্রথম সামর্থ্য হওয়ার পর তিনি একটা রেডিও কেনেন। রেডিও কিনে ঘরে আনার পর রেডিওর নব ঘুরাতেই তিনি যে-খবরটা শুনতে পান তা হলো কে. এল সায়গল আর বেঁচে নেই! তখন সঙ্গেসঙ্গে তিনি রেডিওটা ফেরত দিয়ে আসেন। তাঁর গানের সংখ্যা ত্রিশ হাজার। মতান্তরে আরো বেশি। তিনি ৩৬টি ভাষায় গান করেছেন। বাংলা গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন দুইশ’য়ের উপরে। ১৯৭৪ সালে গিনেস ওয়ার্ল্ড বুক রেকর্ডে লতা মঙ্গেশকরকে ইতিহাসের সবচেয়ে রেকর্ডকৃত গানের শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেন। তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেন। তিনি ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ভারত রত্ন, (২০০১), দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার পদ্মবিভূষণ (১৯৯১), তৃতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ (১৯৬৯) অর্জন করেন। দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারও অর্জন করেন। এছাড়াও অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা তিনি পেয়েছেন দেশবিদেশের। সবচেয়ে বড় পুরস্কারটা তিনি পেয়েছেন লক্ষ কোটি সংগীতপ্রেমী মানুষের ভালোবাসায়। বিনয় এবং সততা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, পুনঃজন্মে বিশ্বাস করলেও আর কোনও জীবন তিনি চান না। এই একটি জীবনই যথেষ্ট তাঁর কাছে। তবে কত হাজার বছর অপেক্ষা করলে এমন একজন লতা মঙ্গেশকর পাওয়া যায় আমার জানা নেই। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি ছয় বছর রাজসভার সদস্য ছিলেন বটে কিন্তু কিন্তু রাজনীতি তাঁর হয়ে ওঠেনি। রাজনীতির মতো জটিল বিষয় আত্মস্থ করতে পারেননি এই সুরের মানুষটি। তিনি উপস্থিত থাকতেন কিন্তু কথা বলতেন না। রাজনীতির কলাকৌশল তিনি বুঝে উঠতে পারতেন না। তিনি নিজেই বলেছেন, সংগীতের সঙ্গে রাজনীতির দূরত্ব ঠিক ততটাই যতটা আসমানের সঙ্গে জমিনের দূরত্ব! সংগীত আসে একটি কোমল হৃদয় থেকে। রাজনীতির জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিকতার প্রয়োজন হয়। তাছাড়া রাজ্যসভার সদস্য হওয়াটা তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহের বিষয় ছিল না। অবিরাম চাপের মুখে থেকে তিনি তা প্রত্যাখান করতে পারেননি। তাই রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে তিনি কোন সম্মাননা বা কোনরকম সুবিধা গ্রহণ করেননি। বাংলাদেশের প্রতিও এই মানবিক শিল্পীর ভালোবাসা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধচলাকালে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তার জন্য ভারতীয় শিল্পীরা এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁরা গান গেয়ে তহবিল সংগ্রহ ছাড়াও বিশ্বব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের কাজ করেছিলেন। এই দলে লতা মঙ্গেশকরও ছিলেন। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে একটি সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশে তাঁর অসংখ্য গুণগ্রাহী আছে। তারাও তাঁর মৃত্যুতে শোকাভিভূত।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর পরিবারের সবাই সংগীত জগতের সাথে জড়িত। আশা, উষা, মিনা ও হৃদয় নাথ মঙ্গেশকর তার ভাইবোন। যাদের মানুষ করার জন্য, অর্থ উপার্জনের জন্য তিনি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। সারাজীবন তিনি তাঁর পরিবারের পাশেই ছিলেন। গানের বাইরে তাঁর ভালবাসা ছিল ক্রিকেটের প্রতি। ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডেও সভাপতি প্রয়াত রাজসিংহ লতাজীর বন্ধু ছিলেন। ক্রিকেট জগতের আর এক কিংবদন্তি সচীন টেন্ডুলকার ছিল তাঁর খুব প্রিয়জন। সচীন তাঁকে মা বলে ডাকতেন।
আশি নব্বইয়ের দশকে হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। সম্পূর্ণ নতুন প্রজন্মের দখলে চলে যায় হিন্দি সিনেমা। কিন্তু লতা মঙ্গেশকর থেকে গেছেন নিজের জায়গায়।
লতা করোনামুক্ত পৃথিবী দেখতে চেয়েছিলেন। সে-সুযোগ তিনি পাননি। করোনাপরবর্তী শারীরিক জটিলতা তাঁর জীবন কেড়ে নিয়েছে। নাইটিংগেল অফ ইন্ডিয়ার জীবন অবসান ঘটেছে। যে-সুরে তিনি বেঁধে রেখে গিয়েছেন সুর পাগল মানুষকে তার অবসান কখনও হবে না, সেই বাঁধন কখনো কেটে যাবে না প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে!
সংগীতের সঙ্গে রাজনীতির দূরত্ব ঠিক ততটাই যতটা আসমানের সঙ্গে জমিনের দূরত্ব! সংগীত আসে একটি কোমল হৃদয় থেকে। রাজনীতির জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিকতার প্রয়োজন হয়।