লইট্টা মাছ বা বম্বে ডাক লিজার্ড জাতীয় মাছ। এটি সাধারণত ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বড় হয়। সর্বোচ্চ সাইজ ৪০ সেন্টিমিটার রেকর্ড করা হয়েছে। পুষ্টিতে ভরপুর লইট্টা মাছ, আছে প্রচুর প্রোটিন। লইট্টা মাছকে শুটকি করা হলে এই প্রোটিনের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পায়। প্রোটিন আমাদের শরীরের টিস্যু গঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। লইট্টা মাছ চট্টগ্রামবাসীর প্রিয় মাছ। দামও নাগালের মধ্যে। লইট্টা মাছে উপকারী ব্যাকটেরিয়া ও প্রোটিনের খোঁজ পেয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। ‘Hydrolytic Exoeûymes Produced by Bacteria Isolated and Identified From the Gastrointestinal Tract of Bombay Duck’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে খ্যাতনামা ওয়াইড ফ্রন্টিয়ার্স ইন মাইক্রোবায়োলজি জার্নালে। কাজটির মূল দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী ড. তানিম জাবিদ হোসাইন। ছিলেন একই বিভাগের শিক্ষক ড. ফেরদৌসী আলী ও সুজন দে-সহ বিভাগের ল্যাবটেরি অফ অ্যাপ্লাইড মাইক্রোবায়োলজি অ্য্যান্ড প্যাথজেনেসিসের গবেষকবৃন্দ।
গবেষণাটি ছিল লইট্টা মাছের খাদ্যনালীর ব্যাকটেরিয়া নিয়ে। খাদ্যনালী থেকে ব্যাকটেরিয়া আলাদা করে সেগুলো কী ধরনের হাইড্রোলেজ নিঃসরণ করতে সক্ষম, মাছের খাদ্যাভ্যাসের সাথে তাদের সম্পর্ক কেমন, হজমে কোনো ধরনের ভূমিকা আছে কিনা-এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই করাই ছিল এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। হাইড্রোলেজ এমন এনজাইম, যা পানির অণুর সাহায্যে রাসায়নিক বন্ধন ভাঙার যে প্রক্রিয়া তাকে ত্বরান্বিত করে। এছাড়া ছিল ডিএনএ বারকোডিং করে হাইড্রোলাইটিক ব্যাকটেরিয়াগুলোর শনাক্তকরণ ও শ্রেণীবিন্যাস বিশ্লেষণ করা।
লইট্টা মাছ মূলত মাংসাশি। এর প্রধান খাবার হলো অন্যান্য ছোট মাছ, মাছের লার্ভা, চিংড়ি বা কাঁকড়া। এসব খাবারে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের মাঝে প্রোটিন ও চর্বির প্রাধান্য বেশি। সে অনুযায়ী ধারণা করা যায়, প্রোটিন-লিপিড ভাঙতে পারদর্শী এমন ব্যাকটেরিয়াও তুলনামূলকভাবে বেশি থাকবে। অন্যদিকে কার্বোহাইড্রেড জাতীয় পদার্থ যেমন সেলুলোজ, অ্যামাইলোজ ইত্যাদি মূলত উদ্ভিদ থেকে আসে, সেগুলো তেমন একটা থাকার কথা না।
ড. তানিম জাবিদ হোসাইন জানান, লইট্টা মাছের এই যে খাদ্যাভ্যাস বা ডায়েট, এর সাথে ব্যাকটেরিয়াগুলোর হাইড্রোলেজ-প্রোফাইল প্রায় পুরোপুরি মিলে গেছে। অর্থাৎ প্রোটিন আর চর্বি ভাঙে এ ধরনের হাইড্রোলেজ সত্যিকার অর্থেই পাওয়া গেছে অনেক বেশি, সংখ্যা আর পরিমাণ উভয় বিবেচনাতেই। অন্যদিকে সেলুলোজ বা অ্যামাইলোজকে ভাঙতে পারে এমন এনজাইম পাওয়া গেছে মাত্র একটি করে ব্যাকটেরিয়াতে, উৎপাদনও হয়েছে খুব অল্প পরিমাণে, যেমনটা ধারণা করা হয়েছিল। আমাদের পেটের ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলোও একইভাবে আমাদের হজমে সহায়তা করে। অন্যান্য অনেক উপকারও করে। কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে যেগুলো প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া বলে পরিচিত। এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এই প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়াগুলো উন্নত দেশের দোকানগুলোতে বেশ সহজলভ্য। লোকজন দরকার মতো কিনে খায়। ব্যাকটেরিয়া খেতে কেমন? বিশেষ কোনো ফ্লেভার ছাড়া এটা সুস্বাদু। এই যে মাছের খাবার ভেঙে তার ভাগ নিচ্ছে, এতে ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি মাছেরও কিন্তু লাভ। মাছের খাবার থেকে ব্যাকটেরিয়াগুলো নিজের জন্য যেমন পুষ্টির ব্যবস্থা করছে, সেইসাথে খাবারকে ভেঙে ছোট করার কারণে মাছের হজমেও সাহায্য হচ্ছে। হাইড্রোলেজ নিঃসরণকারী সব ক’টা ব্যাকটেরিয়াকেই ১৬এস আর আরএনএ জিন বারকোডিং করে শনাক্ত করা গেছে।
দেখা গেছে, এগুলোর মাঝে আটটা ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া আছে, যার মধ্যে শুধুমাত্র স্টাফিলোকক্কাস প্রজাতিরই আছে ছয়টা স্ট্রেইন। অন্যদিকে এক্সিগুয়োব্যাকটেরিয়াম প্রজাতিভুক্ত একটা প্রজাতি পাওয়া গেছে, যাকে কয়েক ধরনের হাইড্রোলেজ উৎপাদনের জন্য বেশ সম্ভাবনাময় বলে মনে হচ্ছে। কমপক্ষে চার ধরনের ভিন্ন ভিন্ন এক্সোএনজাইম নিঃসরণ করতে সক্ষম এই স্ট্রেইন। বিশেষ করে প্রোটিওলাইটিক, লিপোলাইটিক আর পেকটিনোলাইটিক এনজাইম উৎপাদন করতে পারে তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণে।
পরবর্তী পর্যায়ে, ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহার উপযোগী বিভিন্ন ধরনের পরিবেশে এই এক্সোএনজাইমগুলোর উৎপাদনের মাত্রা কেমন তা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। বেশি উৎপাদনশীল যে প্রজাতিগুলো শনাক্ত করা হয়েছে তাদের প্রকৃত সক্ষমতা বা কার্যকারিতা কতটুকু তা-ও জানা প্রয়োজন। মাছের খাদ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যায় এমন উপযুক্ত কোনো প্রোবায়োটিক বা উপকারী প্রজাতি আছে কিনা সেটাও যাচাই করে দেখা যায়। গবেষণার লিঙ্ক: যঃঃঢ়ং://িি.িভৎড়হঃরবৎংরহ.ড়ৎম/ধৎঃরপষবং/১০.৩৩৮৯/ভসরপন.২০২০.০২০৯৭/ভঁষষ
জানা গেছে, আর্থাইটিসে আক্রান্ত রোগীর জন্যে লইট্টা মাছ খুবই উপকারী। এই মাছের তেল ব্যথানাষক ওষুধ হিসেবে কাজ করে। এছাড়া লইট্টা মাছ কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। লইট্টা শুটকিতে থাকা ক্যালসিয়াম উচ্চ রক্তচাপ কমায়।
ড. তানিম চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাধনপুর বাণীগ্রামের সন্তান। প্রচারবিমুখ তানিম নিরন্তর গবেষণায় থাকতে চান। তিনি জানান, গবেষণাপত্রটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশিত হওয়ায় বেশ ভালো লাগছে, যা আমার কর্মস্পৃহা আরো বাড়াবে।