গত শুক্রবার হেগে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের (আইসিসি) ২১তম বার্ষিক সমাবেশ চলাকালীন একটি ইভেন্টে বক্তারা বলেছেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর টেকসই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় এবং রোম সংবিধি স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রপক্ষগুলোকে দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে হবে। নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশ দূতাবাস, গাম্বিয়া সরকার এবং নো পিস উইথআউট জাস্টিস যৌথভাবে ‘রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায়বিচার’ শিরোনামের একটি সাইড ইভেন্টের আয়োজন করে। দৈনিক আজাদীতে গত ১০ ডিসেম্বর প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, নেদারল্যান্ডসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ, আইসিসির ডেপুটি প্রসিকিউটর নাজহাত শামীম খান, বার্মা রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকের প্রেসিডেন্ট তুন খিন, রাখাইন রাজ্যের উপদেষ্টা কমিশনের সাবেক সদস্য ল্যাটিশিয়া ভ্যান ডেন অ্যাসুম এবং গাম্বিয়ান সলিসিটর জেনারেল হুসেইন থমাসি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, টেকসই সমাধানের জন্য মিয়ানমারের নতুন ফেডারেল কাঠামোর মধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিয়ানমারের অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। আঞ্চলিক গোষ্ঠী, সুশীল সমাজ, থিংকট্যাংক, আসিয়ান অঞ্চলের নেতাদের এ অঞ্চলের যৌথ স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের পরিস্থিতির দিকে নজর দেওয়া দরকার। মানবিক সহায়তার পাশাপাশি রাজনৈতিক সমাধানে সমানভাবে নজর দেওয়া উচিত। রোহিঙ্গা নেতা থুন খিন রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশের মাটিতে স্থান দেওয়া এবং রোহিঙ্গাদের পক্ষে ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য আর্জেন্টিনার আদালতে চলমান মামলার উপর আলোকপাত করেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ডেপুটি প্রসিকিউটর নাজহাত খান রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্তের আইসিসি মামলার তদন্তের অগ্রগতি তুলে ধরেন। গাম্বিয়ান সলিসিটর জেনারেল বলেন, গাম্বিয়া নিজেই দুই দশকের স্বৈরাচারী শাসনের শিকার হয়েছে। তাই তারা গণহত্যা কনভেনশনের সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা লড়ছে।
সারা বিশ্ব আজ অবগত যে, শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান করতে গিয়ে বাংলাদেশ এক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আগমন, তাদের নিরাপত্তা বিধান ও পরিচর্যার জন্য বড় ধরনের কর্মযজ্ঞের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার সীমাবদ্ধতা, সম্পদের স্বল্পতা, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে দারিদ্র্যের মাত্রা ও পরিকাঠামোগত স্বল্পতা এবং একই সঙ্গে শরণার্থী মোকাবিলার প্রয়োজনীয় আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অনুপস্থিতি বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের উচ্চতম পর্যায় থেকে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘভুক্ত প্রতিষ্ঠানকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে বেশ কিছু সেক্টর চিহ্নিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে এই চাপ মোকাবিলায় দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছে, যার সাড়া ইতিমধ্যে মিলছে।
যদিও আমরা জানি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অনেক রকম ঝুঁকির মধ্যে আছে। তম্মধ্যে খাদ্যঝুঁকি একটি। দেশ–বিদেশ থেকে খাদ্যের সহায়তা আসছে। কিন্তু তা শরণার্থীদের চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ফলে খাদ্যের অভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে শিশুরা অপুষ্টি এমনকি অকালমৃত্যুর শিকার হতে পারে। এখানে প্রণিধানযোগ্য যে এ বছর নানা কারণে ইতিমধ্যে প্রচুর খাদ্যশস্য নষ্ট হয়েছে। তদুপরি রোহিঙ্গাদের খাদ্য সংস্থানের চাপ যোগ হয়ে তা বাংলাদেশের খাদ্য মজুতেরও নতুন সংকট তৈরি করছে, যেটা দেশের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি হিসেবে ধরা যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সুদূরপ্রসারী সমাধানে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় যখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে, একই সময়ে ৯–১০ লাখ শরণার্থীর জন্য ত্রাণ এবং সুরক্ষা প্রদান করার গুরুদায়িত্ব বাংলাদেশের ওপর বর্তেছে, এমন এই পরিস্থিতিতে এই সম্ভাব্য প্রলম্বিত শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। সে ক্ষেত্রে শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের যথেষ্ট বিচক্ষণতা ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। মানবিকতার সঙ্গে প্রয়োজন বিরাজমান বাস্তবতার সঠিক মূল্যায়ন। এ ক্ষেত্রে জরুরি হচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আমরা কীভাবে আখ্যায়িত করছি, তা নির্দিষ্ট করা এবং সরকারের উদ্যোগকে যথাযথভাবে প্রতিপূরণ (সাপ্লিমেন্ট) করতে পারে, এমন সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া যার শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলায় অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা রয়েছে।








