৫০ বছরের সামরিক শাসনের পর মিয়ানমারে আগামীকাল রোববার দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন হবে। তবে নির্বাচন নিয়ে ইতোমধ্যে সংশয় প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক নানা সংস্থা। মনে করা হয়, সামরিকতন্ত্রের পথ থেকে বাকবদল করে গণতন্ত্রের দিকে মিয়ানমার নতুন যাত্রা শুরু করেছিল ২০১০ সালের নভেম্বরে। সে বছর দীর্ঘ বন্দীত্ব শেষে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল গণতন্ত্রপন্থী হিসেবে সুপরিচিত নেত্রী অং সান সু চিকে। ২০১৫ সালের প্রথম নির্বাচনে বড় বিজয় পাওয়া সু চি এখন আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ওঠা রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগের জবাব দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কোনো কোনো মহলের অভিযোগ, তিনি ওই অপরাধের যৌক্তিকতা প্রমাণেরও চেষ্টা করছেন। খবর বিবিসি বাংলার।
দেশটির রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে অন্তত ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমান। আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গত কয়েক বছরে এটিই মিয়ানমারের বিষয়ে সবচেয়ে বড় ইস্যু। এবারের নির্বাচনে সেটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ পাচ্ছে? নাকি রোহিঙ্গাদের বিষয়ে দেশটির সেনাবাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গি রাজনৈতিক দলগুলো বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করে? এর জবাব পাওয়া কঠিন।
দেশটির ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) নেতা উ থান থে সমপ্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারের দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) বিপরীতে প্রধান বিরোধী দল হলো ইউএসডিপি। তারা দেশটির সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হয়। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল ইউএসডিপি। সেই নির্বাচনে অংশ নেয়নি সু চির দল। এবারের নির্বাচনের প্রচারণায় ইউএসডিপি তাদের প্রতিপক্ষ এনএলডির বিরুদ্ধে যেসব কথা জোরেসোরে বলছে, তার মধ্যে একটি হলো, এনএলডি বাঙালি মুসলিমদের স্বাগত জানিয়েছে। মিয়ানমারে সাধারণত রোহিঙ্গাদের বোঝাতে ‘বাঙালি মুসলমান’ শব্দ ব্যবহার করা হয়।
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমার ডট নেটে। সেখানে ইয়াঙ্গুনভিত্তিক বিশ্লেষক খিন ঝ উইন বলেছেন, রোহিঙ্গা বা মুসলিমদের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাধারণত মিয়ানমারে কোনো সমস্যা হয় না।
দেশটির সাড়ে ৫ কোটি জনসংখ্যার মাত্র চার শতাংশ মুসলমান। তাদের কোনো মূলধারার রাজনৈতিক দল নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা খাতে তাদের প্রতি বৈষম্যের অভিযোগ করে থাকেন দেশটির মুসলমান জনগোষ্ঠী। তবে এসব ইস্যু ছাপিয়ে সেখানে বিতর্ক হচ্ছে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে। কারণ এই নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে কিনা, তা নিয়ে ইতোমধ্যে সংশয় প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়।
মিয়ানমার টাইমস গত ৪ নভেম্বর জানিয়েছে, দেশটির প্রভাবশালী সামরিক বাহিনী নিজেই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে ইউনিয়ন ইলেকশন কমিশন (ইউইসি) সক্ষম কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সামরিক বাহিনী ১৯৬২ সাল থেকে দেশটির ক্ষমতা দখল করে রেখেছিল। তারাই এখন বলছে, নির্বাচনের দুর্বলতাগুলো এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সংশয় তৈরি করতে পারে।
আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় এ নির্বাচনকে যেসব কারণে অস্বচ্ছ বলছে, তার মধ্যে একটি হলো, উত্তর রাখাইনের লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা। ফ্রন্টিয়ার টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনএলডিই রোববারের ভোটে জিতে ক্ষমতায় থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আরেক সংবাদ মাধ্যম দি ডিপ্লোম্যাট বলছে, এনএলডিকে ভোট দেওয়া মানে সু চিকে দেওয়া। কারণ আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের পক্ষে দাঁড়ানোর কারণে তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতার কারণে দেশটিতে সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে, সে সম্পর্কে কেউ স্পষ্ট ধারণা করতে পারছে না। ২০১৫ সালে রাখাইনের ভোটাররা রাখাইন জাতীয়তাবাদী আরাকান ন্যাশনাল পার্টিকে নির্বাচিত করেছিল রাখাইন স্টেট পার্লামেন্টে। কিন্তু এনএলডি প্রেসিডেন্ট এটি আমলে না নিয়ে নিজ দলের একজনকে চিফ মিনিস্টার করেছিলেন রাখাইন রাজ্যে।
অধিকারহীন গণতন্ত্র : দ্যা কনভারসেশন ডট কমের এক প্রতিবেদনের একটি অংশের শিরোনাম ‘অধিকারহীন গণতন্ত্র’। এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, রোহিঙ্গা ইস্যুকে আড়ালেই রাখা হয়েছে। বরং আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার পক্ষে সাফাই গেয়ে অং সান সু চি প্রমাণ করেছেন যে, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তিনি সেনাবাহিনীর প্রতি তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রেখেছেন।
তবে নির্বাচনকে যত অবাধ ও নিরপেক্ষই বলা হোক না কেন, যতদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের নিধন অব্যাহত থাকবে ততদিন গণতন্ত্রের পথে যাত্রা দুর্বলতর হবে-এমন মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।
নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আগেই বলেছে, আসন্ন এই নির্বাচন ত্রুটিতে ভরা। তারা বলছে, সেনাবাহিনীর জন্য আসন সংরক্ষিত রেখে এবং গণমাধ্যমে অবাধ চলাচলের সুযোগ না দিয়ে যে নির্বাচন করা হচ্ছে তা অবাধ ও সুষ্ঠু হতে পারে না। সংস্থাটি অভিযোগ, দেশটির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোকেও তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।